ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঘুম ভাঙ্গানিয়া সী-মোরগ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৭ জানুয়ারি ২০১৬

ঘুম ভাঙ্গানিয়া সী-মোরগ

প্রাচীনকালে অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রচলন বহুল চর্চিত এবং লোকশ্রুত। রাজা তার সাম্রাজ্য নির্ধারণে পোষ্য ঘোড়া সজ্জিত করে ছেড়ে দেয়। ঘোড়া অপরাপর রাজ্য সীমানা অতিক্রম করলে হয় অপর রাজ্যের রাজা তাকে আদরে আপ্যায়নে খাইয়ে-দাইয়ে ঐ রাজার বীরত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে। নচেৎ ঘোড়াকে আটকিয়ে রাখার মতো ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে ঐ রাজার সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। অর্থাৎ ঘোড়া এখানে সাম্রাজ্য বিস্তার এবং দখলদারিত্ব প্রকাশের হাতিয়ার। অনেকটা সেভাবে সিলেটের পাহাড়ী জঙ্গল থেকে কুড়িয়া পাওয়া, বাঘাবাড়ী গ্রামের জোতদার শিকদারের পোষ্য মোরগের প্রতি ভালবাসা এবং মোরগের নিরুদ্দশার সুবাধে জোতদার শিকদারের দখল দারিত্বের মানসিকতার নাটক সী-মোরগ। নাট্যকার আসাদুল্লাহ ফারাজী রচিত, নির্দেশক হুমায়ুন কবির হিমু নির্দেশিত, বাংলাদেশ থিয়েটারের ষষ্ঠ প্রযোজিত নাটক সী-মোরগ মঞ্চস্থিত হলো গত ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল হলে। জীবনের কোলাহলে তিন স্ত্রী, চার চাকর আর প্রাণপ্রিয় সী-মোরগ নিয়ে একরকম সুখের আবহে জীবন কাটাচ্ছিলেন জোতদার শিকদার। জলের নিম্নগামিতার মতো নিম্ন বয়সী স্ত্রীর প্রতি তার অধিক ভালবাসা, চাকরদের পিঠে কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয়া তার মনিবনা আর হৃষ্টপুষ্ট সী মোরগের ঝুটি-পালক ছুঁয়ে সৌন্দর্যের অনুরাগ প্রকাশ তার উপার্জিত সম্পদের প্রতি সম্মাননা। তথাপি পিতা-মাতার ভালবাসার অর্থপূর্ণতায় তার জন্ম হলেও বিয়ের মাত্র এক মাসের মাথায় বাবার মৃত্যু যেমন লোক সমাজে তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তেমনি হঠাৎ সী-মোরগের নিরুদ্দশায় পাগলা বাবার কুমন্ত্রণা তাকে প্রতিটি সম্পর্কের ব্যাপারে শঙ্কিত করে তোলে। স্ত্রীদের প্রতি তার অবহেলাকে বড় না করে দেখে, সেভাবে স্ত্রীরা বুঝি অন্য কোথাও আসক্ত। চাকররা সী মোরগ খুঁজে না পেলে সেভাবে চাকররাই বুঝি মোরগটাকে খেয়েছে বুভুক্ষের মতো। হিন্দু বাড়ির পাশে মোরগের পশম পেয়ে হিন্দু সহায়-সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে সে উন্মত্ত। প্রতিটি চরিত্রের সাইকোলজি ধরতে যথোপযুক্ত অভিনেতা অভিনেত্রীর নির্বাচন এবং প্রশিক্ষণ নয়নাভিরাম। জীবনের ভাসমানতার তলের গহিনের সংলাপ ও অদৃশ্যমানতা ফুটিয়ে তুলতে মাঝে মাঝে আলোর জোন বিভাগ তীক্ষè ও তীব্র। তবে কণ্ঠের তালে ঢোলের বেতালও শোনা যায়। শুনতে মন চায় না চোরের মুখে চোর হওয়ার কাহিনী। তথাপি সুমন চোর রূপে চোরের মরমীয় কাহিনী শুনাতে সক্ষম হলেন। পাগলা বাবা হয়ে রফিক উল্যাহ মঞ্চ কাঁপালেন। আখতার ঘটকালিতে অনুকরণীয় ঘটক। নাসির উদ্দিন ও রাজা এককে অসহায় কিন্তু সকলের সঙ্গে একত্রিত হয়ে সহায়। মাসুদ বড়বিবি চরিত্রে স্বামীর অনন্যা অনুগত, আঁখি মেঝ বিবি চরিত্রে প্রতিবাদী এবং সুমী ছোট বিবি চরিত্রে কৌশলী। সতীনের ঝগড়া বিলাপ-প্রলাপ না হয়ে শেষ পর্যন্ত কিভাবে শৈল্পিক সংলাপে উত্তীর্ণ হয় তা তাদের অভিনয় না দেখলে বোঝা দায়। নাটকটির প্রথম থেকে শেষাবধি মরমীয় দায় কাঁধে বয়ে নেয়ায় শিকদাররূপী অভিনেতা খন্দকার শাহ্ আলম কোমলে-কঠোরে এবং বহুধা বৈচিত্র্যে অতুলনীয়। যন্ত্রণায় জর্জরিত, স্ত্রীদের ভালবেসেও প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত, চাকরদের মাসোহারা ঠিকমতো দিয়েও তাচ্ছিল্যতায় ক্লান্ত, পাগল বাবার বিশ্বাসকে বিশ্বাস করেও ঠকতে বাধ্য, ঘটকের উপযুক্ত কন্যার সন্ধান পেয়েও ঘরে তুলতে অসমর্থ, জমি অধিগ্রহণে ঘরের শত্রু বিভীষণদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত প্রভৃতি নায়গ্রার জলপ্রপাতে পতিত অথচ পুরোটা সময় হিমালয়ের শীর্ষে অধিষ্ঠিত এই বৈপরীত্য অভিনয় কিভাবে করলেন অভিনেতা এবং প্রযোজনা অধীকর্তা খন্দকার শাহ্ আলম তা সত্যিই শৈল্পিক মানদ-ে বিবেচ্য।
×