ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্

বিজ্ঞাপন দেখে কী শিখছি?

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৭ জানুয়ারি ২০১৬

বিজ্ঞাপন দেখে কী শিখছি?

আপনার কাছে কিনবার মতো টাকা নেই এবং যা আপনার কোন প্রয়োজন নেই তা কিনতে উদ্বুদ্ধ করার নামই বিজ্ঞাপন। পণ্য প্রসারে বিজ্ঞাপনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অন্যদিকে একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায় তার ভাষায়, আচরণে। ভাষা আবার পারিপার্শ্বিক অবস্থানের প্রভাবে পরিবর্তনশীল। বিজ্ঞাপন প্রচারের বড় মাধ্যম টিভি ও বিলবোর্ড। বিলবোর্ডের শরীরী ভাষা নিয়ে দেশের স্বনামধন্য একজন মন্ত্রীর বক্তব্যই প্রমাণ করে কতটা অনুপযোগিতায় ডুবেছে বিলবোর্ড। তার পরও কি থেমে আছে? বরং কে কাকে কতটা ছাপিয়ে যেতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় খোলা পিঠের মডেলকে আমরা দেখেছি অলঙ্কারের বিজ্ঞাপনে। বিজ্ঞাপনে পণ্যের মান নিয়ে তথ্য থাকবে, থাকবে উপকারিতা। এই পণ্য ব্যবহারে গ্রহক কী ধরনের উপকার পাবেন এমনটাই। আমরা আসলেই কি তাই দেখছি? কোমলপানীয় মানব শরীরে কতটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা নিয়েই যখন একের পর এক গবেষণাধর্মী মতামত আসছে তখন আমরা দেখছি ভিন্নটা। আমরা জানছি কোমলপানীয় শরীরে মেদ বৃদ্ধি, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণ। আর দেখছি, কোমলপানীয় সাহস বাড়ায়, কাজে উদ্যম আনে, শক্তি বাড়ায়, ভালবাসায় মজবুত করে। আরও কত কী। কোন কোন কোমলপানীয় পানে দেশের সব মানুষকে হলিউডি সুপাার হিরো হাল্ক এর চেয়েও শক্তিধর বানিয়ে দিতে পারে, এমনটাও দেখানো হয়। এছাড়া এতটাই হাস্যকর মিথ্যা তথ্যে ভরপুর থাকে যা মানে হয় নামকরা কমেডিয়ানরাও এদের কাছে কিছুই না। বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল, উপস্থাপনা ও এর সঙ্গে মডেলদের উপস্থিতি এবং নৃত্য অনেক সময় পরিবারের সঙ্গে দেখার উপায় থাকে না। মেহেদীর বিজ্ঞাপনগুলো এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়া শরিষার তেল, ইলেক্ট্রিক পণ্য, প্রসাধনীসহ অনেক বিজ্ঞাপনে নারীর উপস্থিতি এতটাই অশালীন যে, দুই ভাই একসঙ্গে দেখাই বিব্রতকর। পরিবারের অন্য সদস্যের কথা বাদই দিলাম। গত মাসে মানারাত ইন্টারন্যশনাল ইউনিভার্সিটির ‘টিভি বিজ্ঞাপন ও এর ক্ষতিকর প্রভাব’ শীর্ষক এক সেমিনারে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ডক্টর চৌধুরী মাহমুদ হাসান বলেন ‘টেলিভিশন আমাদের বেডরুম মিডিয়া নয়, অথচ বিজ্ঞাপন দেখলে তাই মনে হয়।’বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পণ্যকে অতিরঞ্জিতরূপে প্রকাশ করা হয় যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বাচ্চাদের একটা বিজ্ঞাপন প্রচারে বলা হচ্ছিল এই পণ্য বাচ্চাদের দ্রুত উচ্চতা বৃদ্ধি করে। তখন পাশে বসে থাকা পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া ছেলে মাকে প্রশ্ন করে, এটা খেলে যদি সবাই লম্বা হয় তাহলে জাপান, নেপাল, ভুটান এসব দেশে না পাঠিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হয় কেন? এবার বুঝুন এত টাকা পয়সা খরচ করে, নামী-দামী লেখকদের দিয়ে পা-ুলিপি লিখিয়ে এমন সব বিজ্ঞাপন নির্মাণ করা হচ্ছে যা চতুর্থ/পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া বাচ্চাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। এছাড়া নির্দিষ্ট টিনে ঘর তুললে মেয়ের বিয়ে হওয়া, দাঁত ব্রাশের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক মৃত স্বামী ফিরে আসায় তার হাতে বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দেয়াসহ অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। যা দেখলে আমাদের সমাজ ও বাস্তবতার সঙ্গে প্রদর্শিত বিজ্ঞান কতটা সাংঘর্ষিক সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। তরুণ প্রজন্মকে লক্ষ্য করে নির্মিত বিজ্ঞাপনে প্রবীণ তথা বাবা-মাকে অসম্মান, তাদের সিদ্ধান্তকে যুগ-অনুপযোগী হিসেবে দেখানোর পাশাপাশি নির্বোধ বানানো হচ্ছে। বাবা-মাকে মিথ্যে বলে বোকা বানানো পক্ষান্তরে সন্তানকে চালাক হিসেবে জাহির করা হচ্ছে অহরহ। শিক্ষককে বোকা বানানোর বিজ্ঞাপনগুলো এসময়ের ছেলে-মেয়েদের মুখস্থ। এমন আবেগময় বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে যে দর্শক আরেকটু হলেই কেঁদে দেবে। ঠিক সে সময় পণ্যের নাম ও ব্যবহার দেখানো হলে দর্শক বিরক্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাচ্ছেন। এমন বিজ্ঞাপনের সংখ্য বাড়ছেই। পণ্যের সঙ্গে সম্পর্ক নেই তা সংলাপ ও চিত্র প্রদর্শন কতটা বিরক্তিকর, কেবল ভুক্তভোগী জানেন। দ্বীপ্তিময় ত্বক হলেই ভাল চাকরি পাওয়া যায়। কালো বলে নতুন বউকে নিয়ে কানাকানি। পোশাক অনুজ্জ্বল থাকলে আত্মবিশ্বাস শেষ। এমনটা দেখতে দেখতে আমাদের সমজ কি তথ্য পাচ্ছে নতুন করে বলার কিছু নেই। যে মেয়েটা এসব ক্রিম মেখে কাক্সিক্ষত ফর্সা হতে পারছে না তার চাকরি বা বিয়ে হচ্ছে কি না কে জানে। প্রতিবছর মহান ভাষার মাস একুশে ফেব্রুয়ারি এলে আমরা ভাষাপ্রীতি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠি। কিন্তু বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের ভাষা দিন দিন কোনদিকে যাচ্ছে তা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। যে ভাষায় দেশের সাধারণ মানুষ কথা বলে না সেটাকেই জনসাধারণের ভাষা হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। মজার বিষয় হলো এসব দেখে অল্প শিক্ষিত অতি আধুনিক শ্রেণীর তরুণ-তরুণীরা মনের অজান্তে গ্রহণ করছে। এভাবেই কালের বিবর্তনে বিকৃত হয় ভাষা। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুজ্জামান রুমান বলছিলেন, ‘একটি ভাল বিজ্ঞাপনের দ্বারা সুন্দর গঠনমূলক মেসেজ প্রদানের মধ্য দিয়েও পণ্যের প্রচার সম্ভব। সদিচ্ছার অভাবেই আমাদের টিভি বিজ্ঞাপনের এই দশা।’ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মামুন উদ্দিন ও বাণিজ্য সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন ফয়সাল বলেন, ‘সময় এসেছে বিজ্ঞাপন নীতিমালা প্রণয়ন ও সেন্সর বোর্ড গঠন করে বিজ্ঞাপনের ভাষা ও উপস্থাপনার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। না হলে চলচ্চিত্রের মতো টেলিভিশনও চুপিসারে দেখতে হবে।’
×