ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দগ্ধ সময়ের আলোকচিত্র

মানুষ পুড়িয়ে মারার বীভৎস রাজনীতি ক্ষমাহীন নিষ্ঠুরতা

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ৭ জানুয়ারি ২০১৬

মানুষ পুড়িয়ে মারার বীভৎস রাজনীতি ক্ষমাহীন নিষ্ঠুরতা

মোরসালিন মিজান ॥ আগুন তো! আগুন বলে কথা! জলজ্যান্ত মানুষের গায়ে কেউ আগুন ধরিয়ে দিতে পারে? চিরচেনা এই বাংলায়, এই স্বজন সুহৃদের দেশে মানুষ হয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মারতে পারে কেউ? অথচ তাই হলো। যে জনগণের নামে রাজনীতি, সে জনগণকে পুড়িয়ে কাঠকয়লা করা হলো। এখনও চোখ বন্ধ করলে বার্ন ইউনিট। চোখ বন্ধ করলে একদলা থু সেই রাজনীতিকে। সময়টি পার করে এসেছে বটে বাংলাদেশ। ক্ষত শুকোয়নি। কলঙ্কের ইতিহাসটিকে আবারও সামনে এনেছে দগ্ধ দিনের আলোকচিত্র। বুধবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় বিশেষ এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। আর সব প্রদর্শনীর মতো নয়। একদম আলাদা। একদমই যা সত্যি, হুবহু তুলে ধরা হয়েছে। গত বছর ঠিক এই সময় অবরোধ ডাকে বিএনপি-জামায়াত। রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে, আহা, কী পৈশাচিক হত্যাকা- চালানো হয় তখন! সাধারণ যাত্রীবাহী বাসে ছোড়া হয় পেট্রোলবোমা। চলন্ত বাস। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল মানুষ। অবলীলায় তাদের পুড়িয়ে মারা হয়। কর্মচঞ্চল যে মানুষটি সকালে সুস্থ, অফিস করতে বের হয়েছে, বিকেলে সে ভস্ম! ছাই! সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়ে ঘর থেকে বের হওয়া কলেজছাত্রীটি দুপুরেই আর নিজেকে চিনতে পারে না। মিষ্টি মুখ পুড়ে প্লাস্টিকের মতো গলে গেছে। গ্যালারিতে প্রবেশ করার আগেই অগ্নিদগ্ধ এ সময় সামনে এসে দাঁড়ায়। এখানে শিল্পী প্রদ্যুত কুমারের গড়া একটি স্থাপনা শিল্প। অগ্নিসন্ত্রাসের চেহারাটি তিনি বাসের পরিত্যক্ত অংশ দিয়ে গড়ে নিয়েছেন। তার বিবরণে উঠে আসে, পেট্রোলবোমার আগুনে ভস্মীভূত একটি গাড়ি। গাড়ি মানে, লোহার কঙ্কাল। বাকিটুকু গিলে খেয়েছে আগুন। গাড়ির পুড়ে গলে যাওয়া আসনের দিকে তাকিয়ে গা শিউরে ওঠে। অনুমান করা যায়, এই আসনে বসা মানুষ আর বাড়ি ফেরেনি! মানুষ পুড়ে মরেছে। কত কত স্বপ্ন ছিল তাদের। স্বপ্নেরা হয়েছে কফিনবন্দী। কাঠের কফিনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসছে নীল বেদনা। আলো প্রক্ষেপণের মাধ্যমে এই বেদনাকে গাঢ় করে তুলেন শিল্পী। স্থাপনা শিল্পটি দেখে তাই থমকে দাঁড়াতে হয়। আর ভেতরে পা রাখতেই বেদনার বিস্তার। প্রতি দেয়ালে আলোকচিত্র। সেখানে আগুন আগুন আর আগুন। মানুষ পুড়ে ছাই। পুড়ে ছাই সোনার বাংলা। বহু আলোকচিত্রে আগুনের দাউ দাউ। চলন্ত বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। বাস ডিপোতে আগুন। একসঙ্গে পুড়ছে বহু বাস। বিশাল ট্রেনের বগি জ্বলছে। জ্বলছে সিএনজি অটোরিকশা। সবখানে মানুষ। মানুষ পুড়ছে। দগ্ধ হচ্ছে। এই মৃত্যু কত ভয়ঙ্কর কত বীভৎস হতে পারে তার প্রমাণ সোহাগ হাওলাদারের পোড়া শরীরটি। ১৮ জানুয়ারি বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কে দেয়া আগুনে পুড়ে কঙ্কাল হন বাসের এই হেল্পার। ছবিটি একবার দেখা যায়। দ্বিতীয়বার সেদিকে তাকানোর সাহস হয় না। আরও বহু ছবিতে একই বিভীষিকা। প্রদর্শনীতে ঘুরে ফিরে আসে বার্ন ইউনিট। এখানে আহত মানুষের ছটফটানি। আর্তচিৎকার। ঢাকা মেডিক্যালের বেড শেষ হয়। আগুনে পোড়া মানুষের আসা থামে না। বেশ কিছু ছবিতে পোড়া শরীর। কারও দুই হাত পুড়ে গেছে। কারও দুই পা। ঝলসে যাওয়া শরীর নিয়ে শুয়ে থাকা অনেকেই আর বেঁচে নেই। চিরতরে ছবি, কেবল ছবি হয়ে গেছে! একটি ছবিতে ফুটফুটে শিশু মুখ। মুখটিই দেখা যায় শুধু। বাকিটুকু শরীর ব্যান্ডেজ করা। শিশুটির নাম রূপা। মাত্র ৬ বছর বয়সে চরম নিষ্ঠুরতার শিকার হয় সে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ক্ষমা পায়নি। ১৮ জানুয়ারি মিরপুর থেকে বাসে উঠেছিলেন ইডেন কলেজের এক ছাত্রী। কলেজে আর পৌঁছা হয়নি তার। স্থান হয় বার্ন ইউনিটে। আগুন সন্ত্রাসের বড় শিকার হন বাস ও ট্রাক চালকরা। ড্রাইভার হেলপারের মতো খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে পুড়িয়ে মারা হয়। একটি ছবিতে দেখা যায়, সিলেট ওসামানী মেডিক্যাল কলেজের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে এক ট্রাকচালকের সহকারী। আহারে! মুখ হা করে একটু পানি খাওয়ার অবস্থা তার নেই। মুখের ওপর বোতল উপুর করে ধরা হয়েছে। সেভাবেই পান করতে হচ্ছে পানি। প্রদর্শনী মনে করিয়ে দেয়, বিএনপি-জামায়াতের দেয়া আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে এমনকি গবাদিপশুদের। একটি ছবিতে মুরগি ভর্তি খাঁচা। আগুনে পুড়ে ছাই হয়েগেছে। পণ্যপরিবহন বাধাগ্রস্ত করতে আগুন দেয়া হয়েছে চালের ট্রাকে। পেঁয়াজ ভর্তি ভ্যানে। বিভিন্ন ছবিতে আক্রন্ত পুলিশ সদস্যদের চেহারা। রক্তাক্ত। এমন অসংখ্য ছবিতে আগুন সন্ত্রাসের খ-চিত্র। একত্রিত করলে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির চেহারাটিও দেখা হয়ে যায়। রাজনীতিতে স্খলন ছিল। আছে। রাজনীতি খারাপ হয়। পথভ্রষ্ট হন নেতারা। কর্মীরা উশৃঙ্খল হন। পতনের এই ইতিহাস নতুন নয় বাংলাদেশে। তাই বলে যে মানুষের নামে রাজনীতি, সে মানুষকেই পুড়িয়ে মারতে হবে? এও সম্ভব? এতটা বর্বর কী করে হয় রাজনীতি? প্রদর্শনী দেখতে দেখতে মনে প্রশ্ন জাগে। দেশ ও দেশের মানুষকে পুড়িয়ে মারার এই খেলা বন্ধ চিরতরে বন্ধ হোক। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত প্রদর্শনী যেন সেই দাবিও জানাচ্ছে। বিশেষ এই প্রদর্শনী কয়েকদিন চলার কথা রয়েছে।
×