ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কার্যকর হবে সব আইনী প্রক্রিয়া শেষে- আইনমন্ত্রী ;###;মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির আনন্দ মিছিল

নিজামীর ফাঁসি বহাল ॥ বুদ্ধিজীবী হত্যার তৃতীয় চূড়ান্ত রায়

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ৭ জানুয়ারি ২০১৬

নিজামীর ফাঁসি বহাল ॥ বুদ্ধিজীবী হত্যার তৃতীয় চূড়ান্ত রায়

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবী গণহত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর আমির শীর্ষ নেতা আলবদর বাহিনীর প্রধান বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর ট্রাইব্যুনালের দেয়া ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-াদেশ বহাল রেখেছেন আপীল বিভাগ। একইসঙ্গে ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদ-ের রায়ের বিরুদ্ধে করা জামায়াতের আমির নিজামীর আপীল আবেদন আধা মিনিটে আংশিক খারিজ করে দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ বুধবার সকালে পিনপতন নীরবতার মধ্যে এই রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেন। এই বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। বুধবার সকাল নয়টা তিন মিনিটে বিচারপতিগণ এজলাসে ওঠেন। নয়টা ৪ মিনিটে মাত্র আধা মিনিটের মধ্যে দেশের এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়। ট্রাইব্যুনালের দেয়া চারটির পরিবর্তে তিনটি অপরাধের জন্য মৃত্যুদ-, দু’টিতে যাবজ্জীবন এবং তিনটি অপরাধের জন্য তাঁকে খালাস দেয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার পর আদালতে মুক্তিযোদ্ধা ও আইনজীবীগণ উল্লাস করে সেøাগান দিতে থাকেন। ফাঁসি হলো, ফাঁসি হলো, নিজামীর ফাঁসি হলো। এ নিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ফাঁসির তৃতীয় চূড়ান্ত রায় দিলেন সুপ্রীমকোর্ট। যার মধ্যে আলবদর কমান্ডার বুদ্ধিজীবী হত্যার মাস্টারমাইন্ড আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। অন্য একটি রায়ে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই ঘাতক জামায়াত নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিন পলাতক থাকায় তাদের দ- কার্যকর করা যায়নি। রায় ঘোষণার সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির ও মুরাদ রেজা। অন্যদিকে নিজামীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, এসএম শাহজাহান, মোঃ শিশির মনির ও নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমিনসহ জামায়াতে ইসলামীর অর্ধশতাধিক আইনজীবী। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও তদন্ত সংস্থার প্রধানসহ অন্যরা। এছাড়াও দেশী-বিদেশী মিডিয়ার শতাধিক সংবাদকর্মী নিজামীর রায়ের খবর সংগ্রহ করার জন্য আদালতের এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। নিজামীর মামলার রায় ঘোষণার জন্য সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বুধবারের কার্যতালিকার এক নম্বরে ছিল। এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ৬ জানুয়ারি দিন ধার্য করে আদেশ দেয় আপীল বিভাগ। এদিকে রায়ের পর আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হকসহ রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা, প্রসিকিউটরবৃন্দ ও তদন্ত সংস্থার প্রধান, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের সংগঠন সেক্টর কমান্ডার্স সন্তোষ প্রকাশ করেছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, নিজামীর ফাঁসির চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সব আইনী প্রক্রিয়া শেষ করে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হবে। অন্যদিকে আসামি পক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন রায় মেনে নিয়ে বলেছেন, ‘আমার ক্লায়েন্ট নিজামী সাহেব যেভাবে নির্দেশনা দেবেন সেভাবেই ব্যবস্থা নেব।’ তিনি আরও বলেন, একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে নিজামী সরাসরি জড়িত ছিলেন না। তিনি সহযোগী আসামি ছিলেন। তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে কোন অপরাধ করেননি। কাজেই একজন অপরাধীর যে শাস্তি, একজন সহযোগীর সে শাস্তি দেয়া হলে এটা তার জন্য হবে অনেক বড় শাস্তি। এদিকে আপীল বিভাগে রায়ের পর গণজাগরণ মঞ্চসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিগুলো আনন্দ মিছিল করেছে। রায়কে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই সুপ্রীমকোর্টের ভেতর ও বাইরে কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। সুপ্রীমকোর্টের মূল প্রবেশদ্বারসহ অন্য প্রবেশদ্বারগুলোতে সুপ্রীমকোর্টে আগতদের চেক করে ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। এ ছাড়া এজলাসে ঢোকার সময় সাংবাদিকসহ অন্যান্যের আইডি কার্ড প্রদর্শন করে ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। অন্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায়ের সময় যেভাবে নিরাপত্তা নেয়া হয় তার চেয়ে নিজামীর রায়ের দিন বেশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। আপীলের রায়ে বলা হয়, যে আট অভিযোগে তিনি (নিজামী) ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন, তার মধ্যে ১, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে তিনি খালাস পেয়েছেন। আর ২, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে তার দ- বহাল রয়েছে। এর মধ্যে ২, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে পাবনার বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানী সেনারা হত্যা ও ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ; পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা এবং পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী গণহত্যার দায়ে নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। ৪ নম্বর অভিযোগে পাবনার করমজা গ্রামে নয়জনকে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদ- হলেও আপীলে তিনি খালাস পেয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে আটক, নির্যাতন, হত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার চারটি অভিযোগে নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালত প্রথম দুটিতে খালাস দিয়ে পরের দুটিতে সাজা বহাল রেখেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে এটি হবে আপীল বিভাগের ষষ্ঠ রায়। এর আগে আরও পাঁচটি মামলার আপীল নিষ্পত্তি হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা (মৃত্যুদ- কার্যকর), নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (আমৃত্যু কারাদ-), সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান (মৃত্যুদ- কার্যকর) ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ (মৃত্যুদ- কার্যকর) বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী (মৃত্যুদ- কার্যকর)। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়েছে। তবে সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ করবে বলে জানিয়েছে। বর্তমানে জামায়াতের নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাশেম আলীসহ আরও ৮টি মামলা আপীল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। মীর কাশেম আলীর মামলাটি শুনানির জন্য ২ ফেব্রুয়ারি দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। বুদ্ধিজীবী গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করা, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের রায় দেন তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আলবদর বাহিনীর প্রধান বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। ৪ অভিযোগে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের আদেশ দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। অপর ৪টি অভিযোগে তাকে যাবজ্জীন করাদ- দেয়া হয়। বাকি ৮টি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম (বর্তমানে হাইকোর্টে) ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক (বর্তমান চেয়ারম্যান)। এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৩ নবেম্বর আপীল করা হয়। আপীলে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ৮ ডিসেম্বর রায় ঘোষণার জন্য ৬ জানুয়ারি দিন নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তী ব্যবস্থা ॥ আপীল বিভাগে নিজামীর মৃত্যুদ- বহাল থাকার পর পরবর্তী কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তা জানতে সবাই অধীরভাবে আগ্রহী হয়ে রয়েছেন। এখন নিয়ম অনুয়ায়ী এই মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। ট্রাইব্যুনাল সেই পূর্ণাঙ্গ রায়টি হাতে পেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে। সেই মৃত্যু পরোয়ানা ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনাবে কারা কর্তৃপক্ষ। পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে আসামিপক্ষ। তবে রিভিউ যে আপীলের সমকক্ষ হবে না, তা যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ‘রিভিউ’ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়েই স্পষ্ট করা হয়েছে। রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে এবং তাতে মৃত্যুদ- বহাল থাকলে আসামিকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেয়া হবে। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। ন্যায়বিচার হয়েছে ॥ রায়ের পর আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, আইনী প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণের মাধ্যমে মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকর করা হবে। অন্য আসামিদের ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে নিজামীর ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। বুধবার সকালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ-াদেশ আপীল বিভাগ বহাল রাখার পর সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এ রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে এদেশে ন্যায়বিচার হয়। ইনশাল্লাহ, এ রায় কার্যকর করা হবে।’ ন্যায়বিচার পেয়েছি ॥ জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ-াশে আপীল বিভাগে বহাল থাকার বিষয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘এ রায়ের ফলে আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি এবং স্বস্তি বোধ করছি।’ তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারগুলোর কথা স্মরণ করে বলেন, ‘তারাও স্বস্তি পেয়েছে আজকের এই রায়ে।’ ‘যারা বিচারপ্রার্থী ছিলেন, তারা ন্যায়বিচার পেয়েছেন। এ রায়ে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ রায় বের হওয়ার পর নিজামী রিভিউ আবেদন করলে তার রায় কী আসে সে জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এর পরই রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হবে।’ সন্তুষ্ট প্রসিকিউশন পক্ষ ॥ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-াদেশ পাওয়া জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপীলে রায়েও ফাঁসির দ-াদেশ বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে প্রসিকিউশন পক্ষ। প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ’৭১-এ নিজামীর ভূমিকা ছিল একজন রিং লিডারের। দেশজুড়ে যে হত্যাযজ্ঞ চলেছে সেটা নিজামীর নির্দেশে ঘটেছে তা প্রমাণিত।’ ’১৩ সালের যখন মামলাটি ট্রাইব্যুনালে চলছিল সে সময় দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে আমাদের অনেক অনেক কষ্টে সাক্ষীদের হাজির করতে হয়েছিল। কোন কোন অভিযোগের ক্ষেত্রে সাক্ষী হাজির করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় ট্রাইব্যুনালের রায়ের পাঁচটি দ- বহাল থাকাটা আনন্দের বিষয়।’ যে মাত্রায় হত্যা, গণহত্যা ঘটিয়েছেন, তাতে সর্বোচ্চ সাজা না দিলে তা হবে ন্যায়বিচারের ব্যর্থতা। ক্লায়েন্টের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা ॥ আসামি পক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ‘আমার ক্লায়েন্ট নিজামী সাহেব যেভাবে নির্দেশনা দেবেন সেভাবেই ব্যবস্থা নেব।’ তিনি আরও বলেন, একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে নিজামী সরাসরি জড়িত ছিলেন না। তিনি সহযোগী আসামি ছিলেন। তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে কোন অপরাধ করেননি। কাজেই একজন অপরাধীর যে শাস্তি, একজন সহযোগীর সে শাস্তি দেয়া হলে এটা তার জন্য হবে অনেক বড় শাস্তি। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-াদেশ পাওয়া আগের মামলাগুলোর বেশিরভাগই রিভিউয়ের আবেদন করে কোন ফল পায়নি আসামিপক্ষ। তাই জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী আপীল বিভাগের দেয়া রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) করতে রাজি নাও হতে পারেন বলে মনে করেছেন তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। বিচার ব্যবস্থায় আস্থা বাড়াবে ॥ রায় ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান মোঃ আব্দুল হান্নান খান বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের আমির নিজামীর ফাঁসির আদেশ বহাল থাকায় বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। বুধবার সকালে নিজামীর রায় ঘোষণার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন। ছেলের প্রতিক্রিয়া নেই ॥ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে আপীল বিভাগের রায়েও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- বহাল রাখার পর কোন প্রতিক্রিয়া জানাননি তার ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমিন। বিচার চলাকালীন পুরোটা সময়ই তিনি মামলার তদারকি করেছেন। বুধবার সকালে আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার সময়ও তিনি আদালত কক্ষেই ছিলেন। তবে রায় ঘোষণার পর তিনি কোন প্রতিক্রিয়া জানাননি। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নিজামীর ছেলে বলেন, ‘এ ব্যাপারে বাবার আইনজীবীই প্রতিক্রিয়া জানাবেন। পরিবারের পক্ষ থেকে আমার কিছু বলার নেই।’ অনুলিপির অপেক্ষা ॥ সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির আদেশ বহাল থাকায় এবার দ- কার্যকরে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির অপেক্ষা শুরু হলো। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ বুধবার এই রায় ঘোষণা করে। ওই অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর আসামি রায় পর্যালোচনার আবেদন করতে পারবে। রায়ের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, রায় পর্যালোচনা করে তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। ‘আমার ক্লায়েন্ট নিজামী সাহেব যেভাবে নির্দেশনা দেবেন সেভাবেই ব্যবস্থা নেব।’ রিভিউ নিষ্পত্তিতে সাজা না কমলে নিজামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন। দুটোই নাকচ হয়ে গেলে সরকার দ- কার্যকরের ব্যবস্থা নেবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর চূড়ান্ত রায়কে কেন্দ্র করে সুপ্রীমকোর্ট এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বুধবার সকাল ৮টার আগেই কোর্ট এলাকায় অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা সুপ্রীমকোর্টের প্রধান ফটক, মাজার গেট এবং বার কাউন্সিলের গেটে সাধারণের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। প্রত্যেকের দেহ ও ব্যাগ তল্লাশি শেষে তাদের প্রবেশ করতে দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতির আদালতের আশপাশেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। বিচার কার্যক্রম ॥ মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে দুই দফায় যুক্তিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম দফায় প্রথম দফায় প্রসিকিউশন পক্ষ ২০১৩ সালের ৩ নবেম্বর থেকে ৬ নবেম্বর পর্যন্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এরপর ৭ নবেম্বর থেকে চারদিন আসামিপক্ষের যুক্তিতর্কের জন্য দিন রাখা হলেও তারা নিজামীর আইনজীবীরা আসেননি। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৩ নবেম্বর মাওলানা নিজামীর পক্ষের সিনিয়র আইনজীবীরা আদালতে না আসায় মামলার রায় যেকোন দিন দেয়া হবে মর্মে অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখে দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১৪ নবেম্বর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালের আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। ওই আবেদনের শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল ফের যুক্তি উপস্থাপনের সময় দেন। ১৯ নবেম্বর নিজামীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন সম্পন্ন করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। ২০ নবেম্বর আসামি পক্ষের আইনজীবী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এর পর ট্রাইব্যুনাল ২০ নবেম্বর আদেশে ১৩ নবেম্বররের সিএভি আদেশই বহাল রাখেন। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসা বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে গেলে এই আদালতের বিচার কার্যক্রমে কার্যত স্থবিরতা তৈরি হয়। বিচার কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মতিউর রহমান নিজামীসহ ৫টি মামলার যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই থাকে। অবশেষে ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করে পুনরায় নিজামীর মামলায় যুক্তিতর্ক শোনার জন্য নির্দেশ দেন। দ্বিতীয় দফায় প্রসিকিউশন পক্ষ ১০, ১১ ও ১২ মার্চ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। আর আসামি পক্ষ ১২, ১৯, ২০ ও ২৩ মার্চ চারদিন যুক্ততর্ক উপস্থাপন করেন। আসামি পক্ষ যুক্ততর্ক উপস্থাপন শেষে ২৩ মার্চ শেষে প্রসিকিউশন পক্ষ পাল্টা যুক্তিতর্ক শুরু করেন। ২৪ মার্চ ২০১৪ সালে যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। বিচার শেষে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল যে রায় দেয় তাতে প্রসিকিউশনের আনা ১৬ অভিযোগের মধ্যে আটটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এই আট অভিযোগের মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর ঘটনায় নিজামীর ফাঁসির রায় হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৩ নবেম্বর সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করেন নিজামী। নিজামীর মামলায় শুনানি ৯ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে চলে ২৫ নবেম্বর পর্যন্ত। পরে ৩০ নবেম্বর নিজামীর আপীলের যুক্তিতর্ক শুরু করে ২ ডিসেম্বর আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক পেশ শেষ করে। ট্রাইব্যুনালে নিজামীর বিরুদ্ধে প্রমাণিত আটটি অভিযোগে সাক্ষ্য-প্রমাণ বিষয়ে তিন কার্যদিবস যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে আসামিপক্ষ। এর বিপরীতে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক পেশ করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আপীল বিভাগে নিজামীর মামলাটির যুক্তিতর্ক ১১তম কার্যদিবসের মধ্যে শেষ হয়। আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এস এম শাহজাহান। ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করার পর একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৮ মে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে জামায়াত আমিরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়। মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তাসহ প্রসিকিউশন পক্ষে ২৬ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। অন্যদিকে মতিউর রহমান নিজামীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ৪ জন সাক্ষী নির্ধারণ করে দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। বদর বাহিনী থেকে মন্ত্রী অতঃপর ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জমায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর পরিচয় কি। প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (মূলত তার নাম মতিউর রহমান রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে পাবনা জেলার আটঘরিয়ার শিবপুর ইসলামীয়া মাদ্রাসায় পড়াকালীন ক্লাসের সহপাঠী বন্ধুগণ তাকে ‘নিজামী’ টাইটেল উপাধি দেয়। তখন থেকেই তিনি মতিউর রহমান নিজামী নামই ব্যবহার করে আসছেন )। আসামি মতিউর রহমান নিজামী, পিতা মৃত- লুৎফর রহমান, মাতা মৃত- মোমেনা খাতুন, সাং মনমথপুর, থানা-সাঁথিয়া, জেলা-পাবনা। বর্তমান ঠিকানা বাড়ি নং-৬০, রোড নং-১৮ বানানী, থানা-গুলশান। তিনি ৩১/৩/১৯৪৩ ইং তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বহিরাগত ছাত্র হিসেবে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজে এমএ কোর্সে ভর্তি হন। কিন্তু কোর্স সম্পন্ন করতে পারেন নাই। তিনি বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময় মতিউর রহমান নিজামী শিল্পমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী ছিলেন। ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত করা হয় আলবদর বাহিনী। যার প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। উক্ত বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য শান্তি কমিটি ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য যারা পরবর্তীতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে সংঘটিত অপরাধের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। আসামি মতিউির রহমান নিজামী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধসমূহ করেন। তৎকালীন নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। প্রসিকিউশন সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হল এ একাত্তরে মতিউর রহমান নিজামী বলেছেন, পাকিস্তান একটি আদর্শের নাম। সেই আদর্শ হচ্ছে ইসলাম। রক্তের বিনিময়ে প্রমাণ করে দিব যে, কোন বিদেশী চর পাকিস্তানের মূল ভূখ-ে আঘাত হানিতে পারিবে না তিনি আরও বলেন, আমরা ভারতের উপর সিংহের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়িব এবং তাদের যুদ্ধের স্বাদ চিরতরে মিটাইয়া দিব। এভাবেই মতিউর রমান নিজামী ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার ছাত্র সংঘ আয়োজিত অপর একটি সমাবেশ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন সশস্ত্র ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও তাদের স্থানীয় দালালদের দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত করার জন্য যে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা চালাচ্ছে একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক যুবকরাই তাদের কার্যকরীভাবে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম। নিজামীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ ॥ মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা মোট ১৬টি অভিযোগ (চার্জ) আনে। যার মধ্যে রয়েছে, অভিযোগ-১ নিজামী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংঘের সভাপতি হিসেবে ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম হল ইনস্টিটিউটে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। অভিযোগ-২ একাত্তর সালের ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে নিজামী বক্তৃতা করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ইসলামের শত্রু হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে প্ররোচনা দেন। অভিযোগ-৩ একাত্তরের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে দেয়া এক বক্তৃতায় স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের ভারতের দালাল উল্লেখ করে তাদের নির্মূলের আহ্বান জানান নিজামী। অভিযোগ-৪ একাত্তরের ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর যাশোর বিডি হলে আয়োজিত এক সভায় স্বাধীনতাকামী বাঙালী জনগোষ্ঠীকে নির্মূলে তার সহযোগীদের প্রতি আহ্বান জানান। অভিযোগ-৫ একাত্তরের ১৪ এপ্রিল পাবনার সাঁথিয়া থানার বাউশগাড়ী গ্রামে ৪৫০ জন নিরীহ নারী-পুরুষকে নির্বিচারে হত্যায় নিজামীর বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিাযোগ। অভিযোগ-৬ একাত্তরের ৮ মে সাঁথিয়ায় সুরেন্দ্র নাথ ঠাকুরের পূজা ঘরের সামনে নিজামীর পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা সংঘটিত হয়। অভিযোগ-৭ একাত্তরের ২৭ নবেম্বর পাবনার সাঁথিয়া থানার ধুলাউড়ি গ্রামে আব্দুল আওয়ালের বাড়ি ঘেরাও করে ৩০ জনকে হত্যা, বাড়িতে লুট, নারীদের ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ। অভিযোগ-৮ ১৬ এপ্রিল পাবনার ঈশ্বরদী থানার আরপাড়া ও ভূতের গাড়ি গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে লুট, অগ্নিসংযোগ ও নিরীহ হাফেজ ওমর আলীসহ ১৯ জনকে হত্যার অভিযোগ। অভিযোগ-৯ পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা শহীদ মাওলানা কছিম উদ্দিন আহমদসহ তার দুই সঙ্গীকে একাত্তরের ১০ জুন হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিজামী জড়িত। অভিযোগ-১০ পাবনা শহরের নুরপুর ওয়াপদা পাওয়ার হাউজে একাত্তরের ৯ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধা আব্দুল মাজেদ ও মোহাম্মদ আলীকে হত্যার ঘটনা। অভিযোগ-১১, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাবনার বেড়া থানার বৃশালিকা গ্রামের সোহরাব আলী প্রামাণিককে হত্যার ঘটনা। এছাড়া প্রফুল্ল প্রামাণিক, ষষ্টি প্রামাণিকসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭০ জন নর-নারীকে হত্যা, তাদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। অভিযোগ-১২ একাত্তরের আগস্ট মাসে সাঁথিয়া থানার সোনাতলা গ্রামে মুক্তিযুদ্ধা অনিল চন্দ্র কু-ের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটের ঘটনা। অভিযোগ-১৩ মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাক বাহিনীর ক্যাম্প, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মানবতাবিরোধী অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে নিজামীর জড়িত থাকার ঘটনা। তিনি নিখিল পাকিস্তানের ছাত্রসংঘের সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে এ ক্যাম্পে সব সময় গমন করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কার্যক্রম চালাতেন। অভিযোগ-১৪ একাত্তরের ৩০ আগস্ট ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরাতন এমপি হোস্টেলে স্থাপিত পাক ক্যাম্পে বন্দী জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আযাদÑ এদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকিদের নিজামীর নির্দেশে হত্যা করা হয়। অভিযোগ-১৫ পাবনার সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্প থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে নিজামী জড়িত থাকার ঘটনা। অভিযোগ-১৬ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের দ্বারপ্রান্ত একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে নিজামী জড়িত থাকার ঘটনায় অভিযোগ গঠিত হয়েছে।
×