ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ

রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী স্পোর্টস পাঠাগার

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৬ জানুয়ারি ২০১৬

রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী স্পোর্টস পাঠাগার

বালাদেশে ক্রীড়া পাঠাগারের সংখ্যা শুধু যে কম তাই নয়, বলা যায় হাতেগোনা। অনেকেই ভাববেন পাঠাগার তো পাঠাগার। ক্রীড়া পাঠাগার আবার কী! অনেকে হয় তো জানেনই না আলাদা করে কোন ক্রীড়া পাঠাগার আছে। হ্যাঁ, আছে। সরকারীভাবে ঢাকায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে একটি ক্রীড়া পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত করা হলেও যে লক্ষ্যে তা করা হয়েছিল সেটা অনেকাংশেই বাস্তবায়িত হয়নি। সে ক্রীড়া পাঠাগারের সুফল ঢাকা তথা দেশের মানুষ ভোগ করতে পারছে না। আরেকজন ক্রীড়ানুরাগী ডাঃ অনুপম হোসেন ইস্কাটনে একটি ক্রীড়া পাঠাগারের উদ্যোগ নিলেও সেটাও খুব বেশিদূর এগোতে পারছে না। এ ছাড়া মুহম্মদ কামরুজ্জামান ভাইয়ের বাসায় খেলার বইয়ের একটা বড় কালেকশন থাকলেও আধুনিক সময়োপযোগী একটি ক্রীড়া পাঠাগারের অভাব থেকেই যাচ্ছে। আধুনিক ক্রীড়া পাঠাগারের এই দৈন্যকে দূর করতে ঢাকা থেকে কয়েক শ’ কিলোমিটার দূরে গ্রামীণ পরিবেশে ছায়াঘেরা নিরিবিলি একটি অত্যন্ত মনোরম বিভাগীয় শহর রাজশাহী নগরীর ছোট বনগ্রাম শাহ মখদুম আবাসিক এলাকায় নিজ উদ্যোগে ‘মেমোরি স্পোর্টস পাঠাগার’ নামে একটি অত্যাধুনিক ক্রীড়া পাঠাগার গড়ে তুলেছেন একজন সরকারী স্কুল শিক্ষক (সহকারী প্রধান শিক্ষক) শেখ মনিরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও বাংলাদেশ দারা ফেডারেশনের নির্বাহী সদস্য। তিনি তার নিজের বাড়ির তিন তলার পুরোটাকে ‘মেমোরি স্পোর্টস পাঠাগার’ গড়ে তুলেছেন। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, দারা, শূটিং, জুডো ক্যারাটে কুংফুসহ সব ধরনের খেলার বই রয়েছে এখানে। অনেক দুর্লভ খেলার বইয়ের পাশাপশি আছে অনেক ঐতিহাসিক অনেক ম্যাগাজিন ও স্যুভেনির। যা কিনা দেশের অমূল্য সমাপদ। ‘মেমোরি স্পোর্টস পাঠাগার’কে কেবলমাত্র একটি ক্রীড়া পাঠাগার বললে যথার্থ হবে না। কেননা পাঠাগারে কেবল বই থাকে। এখানে শুধু বই নয় আছে খেলার সবকিছু। তার এই ক্রীড়া পাঠাগারে দেশী-বিদেশী অগণিত খেলার বইয়ের পাশাপাশি রয়েছে একটি বড় হল (কনফারেন্স) রুম। যেখানে সপ্তাহে তিন দিন (শনি, রবি, সোম) বই পাঠ, দাবাসহ বিভিন্ন রকম ক্রীড়াবিষয়ক গেমসের নিয়মিত আয়োজন ছাড়াও ক্রীড়াবিষয়ক সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করা হয়। এ পাঠাগারটি আর দশটা পাঠাগার থেকে ভিন্নতর বলতেই হয়। তার কারণ হচ্ছে, এখানে ক্রীড়াবিষয়ক বই ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ক্রীড়াবিষয়ক কোর্টপিনের সমাহার। এসব কোর্টপিনের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ক্রীড়াঙ্গনের অনেক তথ্য, ঐতিহ্য ও অনেক ইতিহাস। আছে ক্রীড়াঙ্গনের যত আমন্ত্রণপত্র (কার্ড)। ঈদের শুভেচ্ছা, নববর্ষের শুভ কামনা, টুর্নামেন্টের দাওয়াতপত্রসহ হরেক রকমের কার্ড। এসব কার্ড ঘাটলে বেরিয়ে আসবে ক্রীড়াঙ্গনের অনেক অজানা তথ্য। আছে অগণিত স্যুভেনির ও স্পোর্টস ম্যাগাজিন। কোন স্যুভেনির ছাপার পর দেখা যায় সেই ফেডারেশনে বা সংগঠনেই তার কোন কপি নেই। শুধু যে বাংলাদেশ আমলের স্যুভেনির আছে তা নয়। আছে পাকিস্তানী আমলের অনেক দুর্লভ স্যুভেনির। এই সব স্যুভেনিরগুলো কালের সাক্ষী হয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অনেক উপকারে আসবে। যখন কোথাও পাওয়া যাবে না তখন এখান থেকে ফটোকপি করে হলেও তথ্যটি নেয়া যাবে। এটি একটি অনেক বড় বিষয়। এখানেই শেষ নয়, আছে ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট আরও অনেক কিছু। যা কিনা সহজেই যে কোন ক্রীড়াপ্রেমীর মন কাড়বে। এ সবের সঙ্গে রয়েছে একটি আইসিটি রুম। যেখানে আছে ইন্টারনেট কানেকশনসহ কম্পিউটার, স্ক্যানার, প্রিন্টারর থেকে শুরু করে বিনোদনের জন্য টেলিভিশন দেখার ও বিশ্রামের আয়োজন। আছে তার নিজস্ব ওয়েবসাইট। তার ওয়েবসাইট ব্যবহার করে পাঠকরা আরও বেশি খেলার খবর জানতে পারে। পুরো পাঠাগারটির দেয়ালে শোভিত হচ্ছে ক্রীড়াবিষয়ক অনেক দুর্লভ বাঁধানো ছবি। সব মিলিয়ে এক কথায় বলা যায়, একটি দারুণ ব্যাপার। প্রতিদিন অসংখ্য খেলাপাগল মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এ স্পোর্টস পাঠাগারটিকে দেখতে আসে। যারা আসে তারা মুগ্ধতার রেশ নিয়ে ফেরে। এবারে আসি খেলার বইয়ের প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের যত খেলার বই প্রকাশিত হয়েছে বলতে গেলে তার প্রায় সব বই-ই এ পাঠাগারে আছে। বাংলাদেশের প্রথম খেলার বইয়ের লেখক খবির উদ্দিন থেকে শুরু করে আজকের নবীন লেখক। কার বই না আছে! খেলার বইয়ের এ রকম কালেকশন একমাত্র মুহম্মদ কামরুজ্জামান ভাইয়ের কাছে ছাড়া আর কারও কাছে আছে বলে আমার জানা নেই। তবে যতেœর অভাবে মুহম্মদ কামরুজ্জামান ভাইয়ের অনেক বই নষ্ট হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে শেখ মনিরুল ইসলাম আলমগীর অনেকটাই এগিয়ে আছেন। বই তার জীবন। বই সংরক্ষণের জন্য অনেকগুলো সেলফ কিনেছেন। পোকা-মাকড়রোধক মেডিসিন দেন নিয়মিত। বইগুলো তার সন্তানের মতো। প্রতিদিন বইয়ের যতœ নেন। কোথায় কোন বই আছে সব তার মুখস্থ। একটি বই খুঁজে পাচ্ছেন না বলে তার সে কী আহাজারি। শুধু যে দেশি খেলার বইয়ের ভা-ারে সমৃদ্ধ তার ‘স্পোর্টস পাঠাগার’ তা নয়। অনেক বিদেশী বই তার এই স্পোর্টস পাঠাগারকে সমৃদ্ধ করেছে। ছেলেবেলা থেকে খেলাপাগল মানুষ, বিশেষ করে দাবা খেলোয়াড় শেখ মনিরুল ইসলাম আলমগীর ১৯৮৫ সালে রাজশাহী জেলা দাবা সমিতির সাধারণ সম্পাদক হন। এ সময় থেকে একজন ক্রীড়াসংগঠক হিসেবে তার পথচলা শুরু। খেলার সঙ্গে যুক্ত হবার পর একটি ক্রীড়া পাঠাগারের অভাব বুঝতে পারেন। আর তখন থেকেই ক্রীড়া পাঠাগারের কথা তার মাথায় আসে। যাহা ভাবনা তাহাই কাজ। তখন থেকেই একটি দুটি করে খেলার বই, স্যুভেনির, কোর্টপিন ও অন্যসব খেলার সামগ্রী সংগ্রহ করতে শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে রাজশাহীর নিউ মার্কেট এলাকায় একটি বাসাভাড়া নিয়ে ছোট্ট পরিসরে একটি ক্রীড়া পাঠাগার গড়ে তোলেন। তিল তিল করে গড়ে তোলা সে স্বপ্নযাত্রা আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ২০১৫ সালের ১৩ মে। রাজশাহীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী এ দিন আনুষ্ঠানিকভাবে তার সেই ক্রীড়া পাঠাগারের উদ্বোধন করেন। এরপর থেকে শেখ মনিরুল ইসলাম আলমগীরের স্বপ্নটা আরও পাখা মেলতে শুরু করেছে। তিনি এ পাঠাগারটিকে একটি আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়া পাঠাগারে রূপ দিতে চান। তার মতো একজন স্কুল শিক্ষকের একার পক্ষে সে কাজটি করা সত্যি সত্যি দুরূহ ব্যাপার। তার জন্য চাই সকলের সহযোগিতা। বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকার এবং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো পাশে থাকলে তার সে স্বপ্ন পূরণ অসম্ভব নয়। তাতে করে সে যতটা উপকৃত হবে তার চেয়ে বেশি উপকৃত হবে রাজশাহী তথা বাংলাদেশের ক্রীড়ানুরাগী মানুষ। লেখক : ক্রীড়ালেখক, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সংগঠক e-mail [email protected]
×