ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তদন্তকারী গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য

মসজিদ মন্দির গির্জায় সব হামলাই চালিয়েছে জেএমবি

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৬ জানুয়ারি ২০১৬

মসজিদ মন্দির গির্জায় সব হামলাই চালিয়েছে জেএমবি

শংকর কুমার দে ॥ ভিন্নমতাবলম্বীদের ধর্মীয় উপাসনালয়, মন্দির, মসজিদ, গির্জায় যেসব হামলা হয়েছে, তা ঘটিয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামা‘আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আত্মঘাতী স্কোয়াডের (সুইসাইড স্কোয়াড) সদস্যরা। তারা কেবল বিদায়ী বছর ২০১৫ সালের শেষ ৩ মাসে অন্তত ১২টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে এবং দেড় শতাধিক ধর্মপ্রাণ মানুষ আহত হয়েছেন। হামলার শিকারে পরিণত হয়েছে, কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের আহমদিয়া মসজিদ, হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের গির্জাগুলোতে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে উত্থান ঘটিয়ে প্রকাশ্যে তৎপরতায় আসা এই জঙ্গী সংগঠনটি তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে। তদন্তকারী গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে এই ধরনের তথ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ২০১৫ সালে বিশেষ করে শেষের তিন মাসে যে ১২টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়েছে তাতে দেড় শতাধিক ধর্মপ্রাণ মানুষজন হামলার শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদের ওপর হামলার প্রথম ঘটনা ঘটে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এবং সেই হামলা করেছে জেএমবি নামক জঙ্গী সংগঠনটি। তারপর থেকেই মূলত দেশের মসজিদ-মাজারগুলোতে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে চলেছে জেএমবি। রাজশাহী জেলার বাগমারার শুভডাঙ্গা ইউনিয়নের সৈয়দপুর চকপড়া আহমাদিয়া জামে (কাদিয়ানী) মসজিদে বোমা বিস্ফোরণে অজ্ঞাত এক যুবক নিহত এবং আহত হন ১০ জন। হামলায় নিহত যুবককে এখনও শনাক্ত করা যায়নি। ওই যুবকই যে নামাজ পড়ার নামে বিস্ফোরক নিয়ে মসজিদে ঢুকে নাশকতা করতে চেয়েছিল তা নিশ্চিত হতে পেরেছে তদন্তকারীরা। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, ওই যুবক আগে কখনও আহমাদিয়া জামে মসজিদে এর আগে কোন দিন আসেননি বা তাকে দেখেছে এমন কোন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। আহমাদিয়া মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হওয়ায় তারা নিজেদের সবাই একে অন্যের পরিচিত। দিনটি ছিল শুক্রবার ও পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) দিন। এ কারণে ঘটনার দিন (২৫ ডিসেম্বর) মসজিদে মুসল্লিদের অনেক ভিড় ছিল। নামাজে ভিড়ে ঠেলাঠেলি হওয়ায় বোমাটি ওই যুবকের শরীরেই বিস্ফোরিত হয়। তদন্তকারীদের ধারণা, এই যুবক সম্ভবত জেএমবির সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে দেখা গেছে, গত ১৯৯৯ সালে খুলনায় বোমা মেরে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের সাতজনকে হত্যা করা হয়। ২০০৩ সালে যশোরে হত্যা করা হয় একজনকে। ২০১৫ সালের গত ২৪ অক্টোবর মধ্যরাতে পুরান ঢাকার হোসেনী দালানে তাজিয়া প্রস্তুতির সময় হামলায় একজন ও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন নিহত হন। আহত হন ১৫০ জন। গত ২৬ নবেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর গ্রামে শিয়া মুসলিমদের আল মোস্তফা মসজিদে দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত ও তিনজন আহত হন। এ ছাড়াও কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মুসলিমরা বিচ্ছিন্নভাবে অনেক হামলার শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের দিনাজপুরের কাহারোলে কান্তজিউ মন্দিরে হামলা হয়েছে গত ৪ ডিসেম্বর এবং ১০ ডিসেম্বর দিনাজপুরে ইসকন মন্দিরে হামলা হয়। গত ১৮ ডিসেম্বর শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময় চট্টগ্রামে নৌবাহিনী ঘাঁটি ঈশা খাঁ মসজিদে পর পর দু’টি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। এতে ৬ জন মুসল্লি আহত হন এবং ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয় দু’জনকে। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দোর্দ- প্রতাপের সঙ্গে তৎপরতায় ছিল জেএমবি নামক জঙ্গী সংগঠনটি। জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, ছিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাইসহ ছয়জনের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল জেএমবি নামক জঙ্গী সংগঠনটির অস্তিত্ব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সম্প্রতি যেসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে তদন্তে দেখা যাচ্ছে, এসব হামলায় জেএমবির সদস্যরা জড়িত থাকার বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে। দিনাজপুরে মন্দিরে হামলার ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে জেএমবি সদস্য শরিফুল ইসলাম এবং সে ইতালীয় পাদ্রি হত্যা চেষ্টায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে। তবে অত্যন্ত নিখুঁত পরিকল্পনায় হামলা হওয়ার কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে মূল পরিকল্পনাকারীরা। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা এখন ছোট ছোট সেল বা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নাশকতা বা হামলার ঘটনা ঘটায়। এ কারণে মূল পরিকল্পনাকারীরা বার বার পার পেয়ে যাচ্ছে এবং জেএমবি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে হামলার টার্গেটে পরিণত হওয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে।
×