ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ছাত্রদের অভিযোগ-জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সিলেবাস শেষ না করে পরীক্ষা নিতে যাচ্ছে

সেশনজট কমানো ক্রাশ প্রোগ্রামে বিপাকে অনার্সের ছাত্ররা

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৬ জানুয়ারি ২০১৬

সেশনজট কমানো ক্রাশ প্রোগ্রামে বিপাকে অনার্সের ছাত্ররা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ সেশনজট কমাতে গিয়ে সিলেবাস অর্ধেকেরও বেশি না পড়িয়েই তাড়াহুড়া করে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্তে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে। ‘ছয় মাসের মাথায় পরীক্ষা নেয়া চলবে না’ ‘ক্লাস নিয়ে সিলেবাস শেষ করে পরীক্ষা নিতে হবে’ এমন সব দাবি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানের বিরুদ্ধে কলেজ ছেড়ে রাজপথে নেমেছেন অনার্সের শিক্ষার্থীরা। গত তিন দিন ধরে রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ বড় বড় কলেজেই প্রতিবাদ বিক্ষোভ, মানববন্ধন করেছেন তারা। বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছে, দাবি পূরণ না হলে আজ তারা গাজীপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে অবস্থান কর্মসূচী পালন করবে। এদিকে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনও ইতিবাচক কোন সাড়া না দিলেও পুরো পরিস্থিতি পর্যক্ষেণ করছেন উপাচার্য, উপ-উপাচর্য, কোষাধ্যক্ষ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। একটি সূত্র জানিয়েছে, এখনও পরীক্ষার তারিখ ২০ জানয়ারিই নির্ধারিত আছে। তবে কলেজগুলোতে আন্দোলন পরিস্থিতি নেতিবাচক হলে পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হবে। ইতোমধ্যেই পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনাও করেছেন কর্মকর্তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বদরুজ্জামান মঙ্গলবার রাতে জানিয়েছেন, সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে ফল প্রকাশের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে কর্মসূচী নেয়ায় একাডেমিক কার্যক্রমে গতি এসেছে। তবে তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি। বিষয়টি উপাচার্য মহোদয়ের সক্রিয় বিবেচনায় আছে। শিক্ষার্থীরা সেশনজট কমানোর বিষয়ে কর্তৃপক্ষের চিন্তার সঙ্গে একমত হলেও বলছেন, ‘ক্রাশ প্রোগ্রামে’র নামে আমাদের শিক্ষা জীবন নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা চলবে না। এর কিছুদিন আগে ২০১৮ সালের মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলো সেশনজট মুক্ত করতে আগামী ২২ জানুয়ারি থেকে সকালে ক্লাস ও বিকেলে পরীক্ষা গ্রহণের কর্মসূচী নিয়ে ক্রাশ প্রোগ্রামের ঘোষণা দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ঘোষণা অনুসারে অবশ্য বেশ কিছু কাজও হাতে নেয় কর্তৃপক্ষ। দ্রুত সময়ে ফল প্রকাশ, নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস শুরু যার একটি বড় অংশ। তবে অন্য কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে সমস্যা না হলেও সিলেবাস অর্ধেকও শেষ না করে ফাইনাল পরীক্ষা গ্রহণ করতে গিয়েই বাঁধে বিপত্তি। কোর্স শেষ না করে পরীক্ষার গ্রহণের ঘোষণায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা নেমে গেছে রাস্তায়। তবে আগেই পরীক্ষার তারিখ যেনে ফরম পূরণ করলেও কেন শিক্ষার্থীরা তখন প্রতিবাদ জানায়নি সে প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। গত দিন দিন ধরে চলা আন্দোলনকে একেবারে উড়িয়েও দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। সোম ও মঙ্গলবার রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাব ও বিভিন্ন কলেজের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ, মানববন্ধন করেছে তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা দুই মাস পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মিছিল করে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে তারা। এ সময় শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দিয়েছেন, একই দাবিতে বুধবার গাজীপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে অবস্থান কর্মসূচী পালন করা হবে। তাঁদের অভিযোগ, সিলেবাস শেষ না করেই পরীক্ষার সময় ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে তাঁরা পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে পারেননি। তাঁরা আরও বলেন, সিলেবাস শেষ না করে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। কলেজ শিক্ষকদের আন্দোলন, পূজা ও ঈদের ছুটির কারণে সব মিলিয়ে মাত্র দুই থেকে তিন মাস ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছেন তারা। এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে যদি তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়া হলে অনেক শিক্ষার্থীই ফেল করবেন বলেও আশঙ্কা শিক্ষার্থীদের। ফেল করলে আগামীতে তারা বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতাও হারাবে। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, অনেক কলেজে এখনও ইনকোর্স ও টেস্ট পরীক্ষা নেয়া হয়নি। পাশাপাশি কিছু কিছু বিষয়ের ক্লাসও ভালভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। এ কারণে অনেক শিক্ষার্থীরাই তাদের বিষয়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারেনি। রীতি অনুযায়ী ফরম পূরণের ৪৫ দিন পর সাধারণত পরীক্ষা হয়ে থাকে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ তা না করে সেশনজট নিরসনে তাড়াহুড়ো করে এ পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত কর্মসূচীতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রনি, সাদ্দাম, রাসেল, আদমজী কলেজের মামুন, তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী আলাউদ্দিন, তেজগাঁও কলেজের রাবিদ ইসলাম, বদরুন্নেসা কলেজের সাকেয়া সুলতানা বক্তব্য রাখেন। পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে মানববন্ধন করেছেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধনে কবি নজরুল সরকারী কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও মহানগর মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। কবি নজরুল সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী মাসুদ রানা বলেন, সেশনজট কমানোর নামে সিলেবাস অসমাপ্ত রেখে তাড়াহুড়া করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সম্মান তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্রী ফেরদৌস আরা এমিলি বলছিলেন, গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে দ্বিতীয় বর্ষের ফল ঘোষণার মাত্র চার মাস পরে তৃতীয় বর্ষ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নেযা সম্ভব নয়। এটা অন্যায়। এ পরীক্ষা কমপক্ষে দুই মাস পেছাতে হবে। প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করেছেন নরসিংদী সরকারী কলেজের শিক্ষার্থীরা। ‘পরীক্ষা নয়, শিক্ষা চাই’ সেøাগানে প্রেসক্লাবের সামনে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেন। এ সময় তারা বলেন, সিলেবাস শেষ না করে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। মুন্সিগঞ্জে ‘দাবি বাস্তবায়ন কমিটি’র ব্যানারে সরকারী হরগঙ্গা কলেজ থেকে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি প্রেসক্লাব-সংলগ্ন জুবলি রোডে এসে মানববন্ধন করে। এতে কয়েকশ শিক্ষার্থী অংশ নেন। কমিটির আহ্বায়ক সোহেল ভূঁইয়া বলেন, তারাও চান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজটমুক্ত হোক। কিন্তু প্রস্তুতি গ্রহণের আগেই পরীক্ষা হলে ফল বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। গেল সোমবার পরীক্ষার সময়সূচী পেছানোর দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেছেন বরগুনা সরকারী কলেজের সম্মান তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। বরগুনা প্রেসক্লাব চত্বরে এ মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করা হয়। কর্মসূচীতে বরগুনা সরকারী কলেজের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী মানববন্ধনে অংশ নেয়। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রথম বর্ষে ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা ২২ মাসে অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বর্ষে ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা ১৮ মাসে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তৃতীয় বর্ষে আটটি বিষয়ের পরীক্ষা কি করে ৭ মাসের মাথায় দেয়া সম্ভব? শিক্ষার্থীরা বিষয়টিতে শিক্ষামন্ত্রী ইসলাম নাহিদের সহায়তা কামনা করেছেন। পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন যশোরের বিভিন্ন অনার্স কলেজের শিক্ষার্থীরা। এরসময় তারা বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে অনার্স তৃতীয় বর্ষে ঠিকমতো ক্লাস হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিতে পারিনি। তাই পরীক্ষা পিছিয়ে পুনরায় রুটিন প্রকাশের দাবি জানান তারা। পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে মানববন্ধন করেছেন মানিকগঞ্জ সরকারী দেবেন্দ্র কলেজের শিক্ষার্থীরা। মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাব চত্বরে এ কর্মসূচী করে শিক্ষার্থীরা বলেন, তাদের সিলেবাসের কোন বিষয়েই অর্ধেকও পড়ানো হয়নি। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগামী ২০ জানুয়ারি থেকে পরীক্ষার শুরুর সময়সূচী ঘোষণা করেছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। মানববন্ধনে অংশ নেয়া বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আইরিন সুলতানা স্মিতা বলেন, সেশন জট নিরসনের বিষয়টি আমাদের আশা জাগায়। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের আগে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নষ্ট করে সেশন জট নিরসন কোনভাবেই কাম্য নয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারী কলেজের সামনে মানববন্ধন করেছেন পরীক্ষার্থীরা। এ সময় এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন আব্দুল বারি, সায়েমা আক্তার ঊর্মি, মোতাহার হাসান, জিয়াউল হক। বক্তারা বলেন, মাত্র চার মাস আগে সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এর ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আগামী ২০ জানুয়ারি তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার সময়সূচী ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ এ সময়ের মধ্যে ঠিকমতো ক্লাস হয়নি, সিলেবাসও সম্পন্ন হয়নি। তাই পরীক্ষার ঘোষিত সময়সূচী পরিবর্তনের দাবি জানান তারা। সরকারী মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজ, সরকারী সিটি কলেজ, যশোর সরকারী মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন বেসরকারী কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই কর্মসূচী পালন করছেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার ঘোষিত সময়সূচী বাতিল করে আমাদের ২১০ দিনের ক্লাস নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের শুধু পরীক্ষার্থী হিসেবে বিবেচনা না করে শিক্ষার্থী হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আর ক্লাস বাদে পরীক্ষা দেয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে। আর বর্তমানে আমরা ক্লাসের দাবিতে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছি।
×