ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীসহ বড় শহরগুলো ভূমিকম্প ঝুঁকিতে

দেশে ভূগর্ভের সব ফাটল রেখাই এখন সক্রিয়

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৬ জানুয়ারি ২০১৬

দেশে ভূগর্ভের সব ফাটল রেখাই এখন সক্রিয়

শাহীন রহমান ॥ দূর থেকে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পে দেশে কোন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলো বেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঢাকার ঝুঁকি বাড়ছে পাশেই অবস্থিত মধুপুর চ্যুতি রেখার কারণে। বিশেষজ্ঞরা বলছে মধুপুর ফল্ট রাজধানীর ঢাকার জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। যার অবস্থান রাজধানী থেকে সামান্যই দূরে। এছাড়া সিলেট শহর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ডাউকি ফল্টের কারণে। চট্টগ্রাম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে উপকূল বরাবর সিতাকুণ্ড-টেকনাফ ফল্টের কারণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ মূলত দু’ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে দেশের অভ্যন্তরে ফল্ট বা চ্যুতিরেখাগুলো রয়েছে সেগুলোর কারণে ঝুঁকি বাড়ছে। দেশের বাইরে থেকে ঝুঁকি থাকলেও দূরত্বের কারণে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা নেই। এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও দেশের অন্যতম ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, এখন পর্যন্ত যেসব বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছে তাতে দেখা যায়, ঢাকা মহানগরীর সবচেয়ে কাছে ভূমিকম্প উৎপত্তিস্থল হতে পারে মধুপুর ফল্ট। এতে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা মহানগরে তার তীব্রতা দাঁড়াবে সাত মাত্রার। এতে করে যে ভূকম্পন হবে, তাতে অনেক ভবন ও অন্যান্য স্থাপনা ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট, উত্তর-পশ্চিমের রংপুর অঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা ভূমিকম্পের জন্য সবেচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ন আকতার বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় চ্যুতিগুলোর একটি হচ্ছে ডাউকি ফল্ট। ডাউকি ফল্টের বিস্তৃতি হচ্ছে পূর্ব পশ্চিমে ৩শ’ কিলোমিটার। ডাউকির নামকরণ করা হয়েছে মেঘালয়ের শহরের একটি নাম থেকে। এই ফল্টটি আমাদের দিকে চলে এসেছে। আরেকটি ফল্ট হচ্ছে মধুপুর গড়ের পশ্চিম প্রান্তে। যেখানে যমুনা ফ্লাড প্লেইনের সংযোগস্থল, সেখানে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর ১শ’ কিলোমিটার পর্যন্ত ফল্টটি বিস্তৃত। এর নাম মধুপুর ফল্ট। এ ফল্টটি জামালপুর থেকে শুরু হয়ে ঢাকা নগরীর পশ্চিম পাশ ঘেঁষে কেরানীগঞ্জে শেষ হয়েছে। আরেকটি চট্টগ্রাম অঞ্চলে সীতাকু- থেকে শুরু করে উপকূল ঘেঁষে একেবারে দক্ষিণে মিয়ানমার, আন্দামান পর্যন্ত চলে গেছে। মূলত এই তিনটি ফল্ট বা চ্যুতিরেখা দেশের বড় তিনটি শহরের ওপর অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, শিলং মালভূমির দক্ষিণ পাদদেশে ৩শ’ কি.মি. পূর্ব-পশ্চিম ডাউকি ফল্ট এবং চট্টগ্রাম কক্সবাজার উপকূল বরাবর সিতাকু- টেকনাফ ফল্টে প্রচুর পরিমাণ যে স্থিতিস্থাপক শক্তি জমা হয়ে আসছে সেটিই দেশের ভূমিকম্পের প্রধান উৎস। দীর্ঘ সময় ধরে এ শক্তি জমা থাকায় হঠাৎ করে অনেক বড় আকারের (রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার বেশি মাত্রার) ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এই দু’টি প্রধান সাইমোজনিক ফল্টে অনেকদিন ভূমিকম্প না হওয়ায় সাইসমিক গ্যাপের সৃষ্টি হয়েছে। এই সাইসমিক গ্যাপ আমাদের জন্য অশনি সংকেত। এখানে সংঘটিত ভূমিকম্পে বঙ্গোপসাগরের মহীসপানে ভূমিধস ঘটতে পারে। আর সাগরতলের ভূমিধসে সুনামীর সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি সময়ে ভূমিকম্পের প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। দেশে বাইরে থেকে উৎপত্তি হওয়ার কারণে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে। গত বছর এপ্রিলে পরপর দুবার ভূমিকম্প নেপালকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছে। এর ঢেউ বাংলাদেশে এসে পড়লেও দূরত্বের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি। তারা বলছেন, উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে হওয়ায় কম্পনের তীব্রতা কম ছিল। সে কারণে হয়ত রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প শক্তিশালী হওয়ার পরও বাংলাদেশে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এসব ভূমিকম্পে বড় ধরনের বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেলেও দেশের ভেতর থেকে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্প নিয়ে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্পে রিখটার স্কেলের পাশাপাশি কম্পনের তীব্রতার ওপর (মডিফাইড মার্কারি স্কেল) এর ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করে। এছাড়া ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের ভূ-উপরিভাগ থেকে কত গভীরে ভূ-অভ্যন্তর থেকে সংগঠিত হয়েছে সেটাও ক্ষয়ক্ষতির জন্য বিবেচ্য বিষয় হিসেবে ধরা হয়। যে স্থান থেকে ভূমিকম্পটি উৎপত্তি হয় সে স্থানের আশপাশে কম্পনের তীব্রতা থাকে অনেক বেশি। উৎপত্তি স্থান থেকে যত দূর ছড়িয়ে পড়ে কম্পনের তীব্রতাও কমতে থাকে। এ কারণেই গত বছর এপ্রিলে নেপাল থেকে উৎপত্তি হওয়া এবং গত সোমবার মনিপুর থেকে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্প প্রচ- ঝাঁকুনি দিয়ে গেলেও বাংলাদেশে কম্পনের তীব্রতা ছিল অনেক কম। ফলে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে দেশের ভেতরের কোন একটি চ্যুতি রেখা থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। তাই এখনই সচেতন হওয়া জরুরী। তারা বলছেন, বাংলাদেশ দু’ধরনের বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রথমত দেশের ভেতরে চারটি চ্যুতি বা ফাটল রেখা এখন সক্রিয় রয়েছে। এসব ফাটল রেখাই এখন ভূমিকম্পের জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশের অবস্থান তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে। এছাড়া সাবডাকশন বরাবর সমুদ্রের গভীরে ৬শ’ কিলোমিটার যে ফাটল রেখা রয়েছে তা ভয়াবহ সুনামির জন্য অশনি সংকেত। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অভ্যন্তরে যে কয়টি চ্যুতি রেখা সক্রিয় রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে সিলেটের ডাউকি ফাটল রেখাকে। এছাড়াও মধুপুর ফল্ট, সীতাকু--কক্সবাজার-মিয়ানমার ফল্ট, সিলেট-আসাম ফল্টও অধিক মাত্রায় সক্রিয়। কমপক্ষে ১শ’ বছর বা তার অধিক সময়ে শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে বড় ধরনের ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে থাকে। দেশের অভ্যন্তরে প্রতিটি চ্যুতি রেখায় সর্বশেষ সংঘটিত বড় ভূমিকম্পের ব্যবধানও এ সময়কে অতিক্রম করেছে। ডাউকি ফল্ট থেকে সর্বশেষ ভূমিকম্প হয় ১৮৯৭ সালে ৮.৬ মাত্রার। ঢাকা থেকে এ চ্যুতি রেখার দূরত্ব দেড় শ’ থেকে ২শ’ কিলোমিটারের মধ্যে। ১৮৯৭ সালে এ চ্যুতি রেখা থেকে সর্বশেষ বড় মাত্রা যে ভূমিকম্প সংগঠিত হয়েছিল তা রেকর্ড করা হয়েছিল ইতালির সাইসমিক সেন্টার থেকে। এর আগে ভূমিকম্প রেকর্ডের জন্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়নি। এছাড়া মধুপুর ফল্ট থেকে সংঘটিত ভূমিকম্পের সময়সীমা ১শ’ বছর পার হয়ে গেছে। আসাম-সিলেট ফল্টে ৪শ’ বছর পার হয়ে গেছে। এখন আরেকটা বড় ভূমিকম্পের জন্য যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হওয়া দরকার তা সঞ্চিত হয়ে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশিরভাগ মহানগর, শহর এলাকায় জলাভূমি, খাল-বিল ভরাট করে অনেক ভবন ও স্থাপনা তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে। সেসব এলাকার মাটি পুরনো এলাকাগুলোর তুলনায় নরম। অন্যান্য স্থানের তুলনায় নতুন মাটিতে স্থাপিত ভবন ও স্থাপনায় ভূকম্পন বেশি অনুভূত হবে। এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেশি। এছাড়া বেশিরভাগ ভবনের নকশা ও নির্মাণে জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করায় ঝুঁকির মাত্রা ও পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে ভূমিকম্প সম্পর্কে নাগরিকদের সতর্ক থাকতে হবে। তাদের মতে নাগরিক সচেতনতা গড়ে তোলা গেলে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হবে।
×