ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এম নজরুল ইসলাম

খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্য কী?

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৬ জানুয়ারি ২০১৬

খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্য কী?

বাংলায় ‘শাঠে-শাঠ্যাং সমাচরেৎ’ বলে একটা কথা চালু আছে। ‘কয়লা ধুলে ময়লা যায় না’- এমন কথাও বলা হয়ে থাকে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক রচনামৃত যেন এসব কথা নতুন করে মনে করিয়ে দিল। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, প্রায় ২৫ বছর আগে বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি তার রানিং মেট হিসেবে বেছে নিয়েছিল যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতকে। বড় দল হিসেবে বিএনপির ছায়া জামায়াতের ওপর পড়ার কথা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ঘটনা উল্টো। জামায়াতের ছায়া পড়েছে বিএনপির ওপর। স্বয়ং বিএনপি চেয়ারপারসন যখন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও ধর্ষিতার সংখ্যা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। খাঁটি কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রশ্নটা উঠল কখন, তুলল কে? বাংলাদেশ সম্পর্কে কয়েকটি সত্য ভুলে গেলে চলবে না। ১৯৭১ সালে আমরা একটি সশস্ত্র যুদ্ধের ভেতর দিয়ে এই দেশটি অর্জন করেছি, এটা অমোঘ সত্য। মানতে হবে, সংখ্যায় অল্প হলেও, এই দেশেরই একদল মানুষ আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়লাভের পর এদের অনেকে গা-ঢাকা দিয়েছিল। অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অনেকের সাজাও হয়েছিল। পঁচাত্তরের পর এদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হয়। এই কাজটি করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধেরই এক ফোর্স কমান্ডার। ঘটনাক্রমে যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণাপত্রের পাঠকদের একজন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞের সরাসরি সুবিধাভোগী জিয়াউর রহমান সেনা সহায়তায় একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। দলটিই এখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নামে পরিচিত। দলের প্রতিষ্ঠাকালীন অনেক নেতা দল ছেড়েছেন। কিন্তু দলটি টিকে আছে। ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর দলটি দেশের শাসন ক্ষমতায়ও বসেছে। কিন্তু দলটির রাজাকার তোষণ আগের মতোই রয়ে গেছে। জিয়াউর রহমান রাজাকারদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছিলেন। তার স্ত্রী খালেদা জিয়া এই রাজাকারদের মন্ত্রী বানিয়েছেন। তাদের গাড়ি ও বাড়িতে জাতীয় পতাকার ব্যবস্থা করেছেন। এটা দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি চরম অসম্মান। মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ নিয়ে এই রাজাকারদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। জামায়াতী অর্থনীতি শক্ত ভিত্তি পেয়েছে। ১৯৭৫ পরবর্তী রাজনীতিহীন দেশে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী শক্তি। একসময় দেশের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার সাহসও দেখিয়েছে তারা। এ দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই, এমন কথাও উচ্চারিত হয়েছে এই ঘৃণ্য নরপশুদের মুখে। এই জামায়াতীদের যুদ্ধাপরাধে বিচার হচ্ছে। এরই মধ্যে চার জামায়াতী যুদ্ধাপরাধীর চূড়ান্ত রায় কার্যকর হয়েছে। আরও কয়েকজনের চূড়ান্ত রায় অপেক্ষমাণ। আদালতের নির্দেশে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ মাঠের রাজনীতিতে জামায়াত এখন অনুপস্থিত। না, একেবারে অনুপস্থিত বলাটাও সমীচীন হবে না। সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকা-ে জামায়াত না থাকলেও, সন্ত্রাসী জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত জামায়াত। তাদের অর্থের যোগান দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ২০১৩-১৪ সালে যে সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালিত হয়, তার নেপথ্যে জামায়াতী অর্থায়ন ও মদদ যে ছিল তা স্পষ্ট হয়েছে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তদন্তে। বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির সময় থেকেই জামায়াত দেশে জঙ্গীগাষ্ঠী গড়ে তুলতে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছে। ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পরও তাদের সে অপতৎপরতা থেমে নেই। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক আত্মিক। আত্মার-আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ বিএনপি ও জামায়াত। তার প্রমাণ আমরা অতীতেও পেয়েছি। খুব বেশি দিনের কথা নয়, জামায়াতের একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে জিয়া তনয় তারেক রহমান বলেছিলেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক পারিবারিক। এই বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়। অনৈতিক হলেও বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের যে একটি অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে, এটাও রাজনৈতিক মহলে ওপেন সিক্রেট। অর্থাৎ জামায়াতী অর্থায়নে পরিচালিত হয় বিএনপির রাজনীতি। স্বাভাবিকভাবেই বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকা-ে জামায়াতী স্বার্থের প্রতিফলন দেখতে পাই আমরা। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, এক জামায়াতী নেতা আস্ফালন করে বলেছিলেন, দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বরাবরই কটাক্ষ করে এসেছে জামায়াত। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যেন জামায়াতী বচন পুনরাবৃত্তি করলেন সোমবার ২১ ডিসেম্বরের এক অনুষ্ঠানে। সেখানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। তিনি বলেন, ‘আজকে বলা হয় এত লাখ লোক শহীদ হয়েছে। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে।’ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মহত্তর অর্জন এই স্বাধীন ভূখ- ও লালসবুজের জাতীয় পতাকা। এই মাটিতে মিশে আছে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত। দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জন আমাদের এই স্বাধীনতা। এই মহান শহীদদের সরাসরি অবমাননা করে বসলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। শহীদের সংখ্যার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তিনি। কেন? কার স্বার্থ দেখছেন বিএনপি চেয়ারপারসন? বাংলাদেশের নাকি পাকিস্তানের। আজ যখন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উঠেছে তখন তিনি কেন এই বিতর্কের জন্ম দিলেন? তার কাছে কি সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য আছে? তিনিই তবে বলে দিন শহীদের সংখ্যা? আর এই সংশয় যদি থাকবে, তাহলে তিনি কেন ব্যবস্থা নিলেন না? বিতর্কিত একবারসহ তিনবারের প্রধানমন্ত্রী তিনি। কেন তিনি এই সংখ্যা তখন সংশোধন করলেন না? ডেভিড বার্গম্যান নামের এক বিদেশী সাংবাদিক একটি লেখায় দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশে ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ নারী ধর্ষিত হওয়ার কোন ভিত্তি নেই। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে ব্লগ লিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অবমাননার দায়ে শাস্তি পেয়েছিলেন তিনি। শহীদের সংখ্যা নিয়ে খালেদা জিয়ার এই সংশয় প্রকাশ কি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না? ওই সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ না করে খালেদা জিয়া দাবি করেছেন, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে নাকি মুক্তিযুদ্ধ হতো না। কী হাস্যকর কথা! যে কোন মূঢ় ব্যক্তির কাছেও তার এই কথা হাস্যকর মনে হবে। শুধু তিনি কেন, যে কেউ জানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই বাঙালীর মনে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বোনা হয়ে গিয়েছিল। জিয়াউর রহমানের অপেক্ষায় স্বাধীনতার সংগ্রাম বসেছিল না। জিয়াউর রহমান একটি সময়ের সুযোগ নিয়েছেন। এমন সুযোগ তিনি পরেও একাধিকবার নিয়েছেন। ২৫ মার্চ রাতেই বাংলার মানুষ শত্রুকে রুখে দাঁড়িয়েছিল। জিয়াউর রহমানের অপেক্ষা করেনি। বরং জিয়াউর রহমান সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করার কাজকেই নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সবাইকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তো তাদের সবাইকে দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক যে কোন যুদ্ধাপরাধের বিচারের দিকে তাকিয়ে দেখুন, সবচেয়ে বেশি সুযোগ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের। আর কী সুযোগ চান তিনি। তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধকালে সত্যিকারে যারা সাধারণ মানুষকে অত্যাচার করেছিল, বিএনপি তাদের বিচার চায়। তাদের বিচার তো করা হচ্ছে। গোলাম আযম থেকে শুরু করে নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা হয়ে খালেদা জিয়ার একসময়ের রাজনৈতিক উপদেষ্টা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচার হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন এই বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানসম্মত, স্বচ্ছ। আমরা নাদান মানুষ। অনেক কিছুই ঠিক বুঝতে পারি না। ম্যাডাম চেয়ারপারসন, আপনি কি অনুগ্রহ করে বুঝিয়ে বলবেন, কোথায় বিচারটি আন্তর্জাতিকমানের হচ্ছে না। বিচারের অস্বচ্ছতা কোথায়? আপনি এক-দুই করে পয়েন্ট আউট করে দিন। খালেদা জিয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক সম্মান দেয়নি। তার অভিযোগ, আওয়ামী লীগ নিজের ঘরে যুদ্ধাপরাধী পালছে, মন্ত্রী বানাচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে আমাদের বিনীত নিবেদন, আপনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, কাদের লালন-পালন করেছেন? কাদের ক্ষমতার সঙ্গী করেছিলেন? কাদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন? এই নিজামী-মুজাহিদদেরই তো? আপনি খালেদা জিয়া বুকে হাত দিয়ে বলুন আপনার দলে কোন রাজাকার, আলবদর নেই। পারবেন বলতে? খালেদা জিয়ার আসল উদ্দেশ্য কী? তিনি কি পাকিস্তানের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চান? নাকি দেশের প্রতিক্রিয়াশীল যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমেছেন? প্রায় এক দশক হতে চলল ক্ষমতা নেই। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে হাওয়া ভবন। দল চালাতে শুধু নয়, বিলেতে পুত্রের সংসার চালাতেও তো অর্থের প্রয়োজন হয়। জাতীয়তাবাদী মজমায় জামায়াতী বচন উচ্চারণই বোধহয় এখন খালেদা জিয়ার অর্থ উপার্জনের একমাত্র উৎস। আর সে কারণেই তার এই জামায়াতী বচন উচ্চারণ। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক [email protected]
×