ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিটির পর পৌর নির্বাচনেও ভরাডুবি

লাঙ্গল কি হারিয়ে যাচ্ছে! জাপা হারাচ্ছে জনসমর্থন

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৫ জানুয়ারি ২০১৬

লাঙ্গল কি হারিয়ে যাচ্ছে! জাপা হারাচ্ছে জনসমর্থন

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ডুবতে বসেছে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থা। তাই দিন দিন জনমত হারাচ্ছে দলটি। ৭৬টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ২৬ জেলায় কোন রকম কার্যক্রম রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর এবার পৌরসভা নির্বাচনেও ভরাডুবি হয়েছে দেশের প্রধান বিরোধী দলের প্রার্থীদের। ২৩৪টি পৌরসভার মধ্যে মাত্র একটিতে মেয়র পদে পাস করেছেন দলীয় প্রার্থী। অর্থাৎ যাকে বলে অন্ধের যষ্ঠী অথচ দল মনোনীত ৭৩ মেয়র প্রার্থীই শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বৃহত্তর রংপুরের একটি পৌরসভাতেও জিততে পারেননি দলের প্রার্থীরা। জামানত বাজেয়াফত হয়েছে অনেকের। গড়ে প্রায় ৭৪ ভাগ ভোট পড়লেও জাপা প্রার্থীরা বেশিরভাগ পৌরসভায় ৩/৫ ভাগ ভোট পেয়েছেন। ফল খারাপ হওয়ায় মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের। এ রকম শোচনীয় পরাজয়ে চিন্তিত দলের প্রধান এরশাদসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। প্রশ্ন উঠতেই পারে বিপর্যয়ের কারণ নিয়ে। দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, যোগ্য প্রার্থীর অভাবই ভরাডুবির মূল কারণ। পাশাপাশি সাংগঠনিক দুর্বলতা, দ্বৈত নীতি, নির্বাচনী প্রচারে দলের অংশগ্রহণ না থাকা, দলের মহাসচিবের একক আধিপত্য বিস্তার, নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করাসহ প্রভৃতি। যদিও ফল বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় নেতাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য একটু ভিন্ন। তারা বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ায় জাপার প্রার্থীরা বিজয়ী হতে পারেননি। তবে এ নির্বাচন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন প্রভাব ফেলবে না বলেও মনে করেন তারা। এদিকে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও প্রার্থী সঙ্কটে আছে দলটি। প্রায় দুই মাসেও তৃণমূল থেকে একজন প্রার্থীর তালিকাও কেন্দ্রীয় দফতরে আসেনি। শনিবার এক অনুষ্ঠানে দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, আমাদের ভেবে দেখতে হবে পৌর নির্বাচনে কেন ভাল করতে পারিনি। তিনি বলেন, যে কোন মূল্যে জাতীয় পার্টির ইমেজ সঙ্কট দূর করতে হবে। কেউ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল মনে করে না। আওয়ামী লীগের পর বিএনপির কথাই সবাই বলে। তিনি রওশনের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, শীর্ষ নেতাদের মধ্যে দূরত্ব থাকলে নেতাকর্মীদের মধ্যেও দূরত্ব বাড়ে। তাছাড়া তিন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীসহ বিরোধী নেতার পদ ও আমার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ ছাড়লেই জাতীয় পার্টি পূর্ণাঙ্গ বিরোধী দলে পরিণত হতে পারে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমাদের ৭৬ মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে তিনজনকে জোর করে বসিয়ে দেয়া হয়। অনেক প্রার্থীকে হুমকি দেয়া হয়েছে। সর্বোপরি আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। তিনি বলেন, সারাদেশে মাত্র ২৭ জেলায় সংগঠন আছে। বাকি জেলাগুলোতে কোন কাজ নেই। এটাকে শক্তিশালী বিরোধী দল বলে না। একের পর এক বিপর্যয় ॥ সর্বশেষ ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে মাত্র ১৩ হাজার ৬০০ ভোট পেয়েছেন দলটির মেয়র প্রার্থীরা। এর আগে মাত্র একটি উপজেলাতে জয় পায় জাপার প্রার্থী। তখনও বৃহত্তর রংপুরের কোন উপজেলায় দলের প্রার্থীদের কেউ পাস করতে পারেননি। এবারও ঘটেছে তাই। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, পৌর নির্বাচনে এক সময়ের দুর্গ নামে খ্যাত রংপুরে শোচনীয় পরাজয় হয়েছে জাতীয় পার্টির। জেলার বদরগঞ্জ পৌসরভা নির্বাচনে উপজেলা ছাত্র সমাজের সভাপতি লাতিফুল খাবীর লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত হারিয়েছেন। ফল অনুযায়ী জাপার এ প্রার্থী পেয়েছেন ১৭১ ভোট। জাতীয় পার্টির এমন ধরাশায়ীতে হতবাক স্থানীয় নেতারাও। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম পৌরসভায় জাতীয় পার্টির আব্দুল হামিদ পেয়েছেন মাত্র ১৩৭ ভোট। রাজশাহীর দুর্গাপুরে জাপার প্রার্থী হয়েছেন আজহার আলী। যিনি এর আগে বিএনপির সমর্থনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। পৌরসভায় তার সার-কীটনাশকের ব্যবসা থাকায় তিনি বেশ পরিচিত। কিন্তু বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টিতে চলে আসায় এলাকায় তাকে নিয়ে নানা সমালোচনা হয়। তাই ফল ভাল হয়নি। পাবনা সদরে জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া দলের কোন্ পর্যায়ে আছেন, তা সঠিকভাবে কেউ জানেন না। তাই ফলও সন্তোষজনক হয়নি। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর পৌরসভায় লাঙ্গল প্রতীকে প্রার্থী হন আবদুল ওয়াদুদ মৃধা। এর আগে কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি তিনি। ২৭ বছর বয়সী এই প্রার্থী স্থানীয় জাতীয় পার্টির কোন পদে নেই। বাগেরহাটের মংলা পৌরসভায় লাঙ্গল প্রতীকে প্রার্থী হন তালুকদার আক্তার ফারুক। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে ভাইস-চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কোনমতে জামানত রক্ষা করেছেন। তিনি মংলা উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি বলে জানা গেছে। জানা গেছে, ২৩৪ পৌরসভার মধ্যে শুধু কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে আবদুর রহমান মিয়া একমাত্র লাঙ্গল প্রতীকে মেয়র পদে বিজয়ী হয়েছেন। রহমান মিয়া বলেন, জাপা থেকে নির্বাচন করলেও পাস করেছি ব্যক্তিগত ইমেজের কারণে। বিজয়ের জন্য দলের কোন ভূমিকা নেই। এ প্রসঙ্গে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরেই বলেছি, জাতীয় পার্টির ভাল করার সুযোগ নেই। যারা সরকারী দল করেন তারা নৌকায় ভোট দেবেন। যারা সরকারী দল পছন্দ করে না তারা ধানের শীষে ভোট দেবেন। জাতীয় পার্টির রাজনীতি সুস্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত দলের উন্নতি হবে না। তিনি বলেন, এটাও প্রমাণ হয়েছে বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোট সম্পন্ন সম্ভব নয়। মাঠপর্যায়ে প্রার্থী সঙ্কট ॥ যোগ্য প্রার্থী সঙ্কটে জাতীয় পার্টি পৌর নির্বাচনে অংশ নিতে অনেকটা আগেভাগেই কাজ শুরু করেছিল দলটি। এরই ধারাবাহিকতায় দলের পক্ষ থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ২০ নবেম্বরের মধ্যে মেয়র প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করে পাঠানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এতে খুব একটা সাড়া মেলেনি। খুব কম জেলা থেকেই তালিকা কেন্দ্রীয় দফতরে আসে। এরপর দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন বিক্রি শুরু হয়। ১৫১ প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। তাদের মধ্যে মাত্র ৯৩ জন জমা দেন। দলের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য তাদের প্রত্যেককেই মনোনয়ন দেয়া হয়। সর্বশেষ ৭৩ প্রার্থী নির্বাচনের মাঠে ছিলেন। পরাজয়ের কারণ জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও প্রেসিডিয়াম সদস্য শুনীল শুভ রায় জনকণ্ঠ’কে বলেন, জালভোট, কেন্দ্র দখলসহ সর্বোপরি অনেক পৌরসভায় সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ায় আমাদের প্রার্থীরা ভাল ফল করতে পারেননি। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে দলের ৭৩ প্রার্থীর মধ্যে অন্তত ২৩ জন বিজয়ী হতো। এর মধ্যে আমরা একটি পৌরসভায় জিতেছি। ফলাফল স্থগিত হওয়া পৌরসভাগুলোর মধ্যে দুটিতে আমাদের প্রার্থীরা এগিয়ে আছেন। তিনি বলেন, নানা কারণে শুরু থেকেই শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলেন দলের চেয়ারম্যান। শেষ পর্যন্ত তাই সত্যি হয়েছে। নানাভাবে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীদের হয়রানি করা হয়েছে। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হুমকিও দেয়া হয়েছিল। ফল বিপর্যয়ের কারণ জানতে চাইলে পার্টির কেন্দ্রীয় তথ্য গবেষণা ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক মনিরুল ইসলাম মিলন জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়ায় জাপার প্রার্থীরা বিজয়ী হতে পারেননি। তিনি বলেন, পৌর নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় নির্বাচনে কোন প্রভাব ফেলবে না। আমরা জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। নির্বাচনের আগে সংবিধান সংরক্ষণ দিবসের আলোচনায় এরশাদ দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা স্বীকার করে বলেন, দলের অবস্থা এতই করুণ যে সব পৌরসভায় নিজেদের প্রার্থী পেলাম না। বিষয়টি আমাকে খুবই কষ্ট দেয়। এটা খুবই হতাশার কথা। তিনি আরও বলেন, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমাদের কোন প্রার্থী নেই। এভাবে তো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। ২৫ পৌরসভায় অনিয়মের অভিযোগ ॥ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পর জাতীয় পার্টিও (জাপা) পক্ষ থেকে ২৫টি পৌরসভার ১৭৪টি ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ করা হয়েছে। জাপার সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া একটি লিখিত অভিযোগ ইসির সচিব সিরাজুল ইসলামের দফতরে জমা দেন। এরপর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সারাদেশে ২৩৪ নির্বাচনী পৌরসভার মধ্যে ৭৪টিতে মেয়র প্রার্থী দিয়েছে জাপা। এর মধ্যে ২৫টি পৌরসভার ১৭৪টি কেন্দ্রে তাদের প্রার্থীকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়াসহ ব্যালটে সিল মারা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভোটডাকাতিসহ কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ বলেছেন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় আমরা সন্তুষ্ট নই এবং এই কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
×