ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে বঞ্চিত উপ-সচিব, যুগ্ম সচিব অতিরিক্ত সচিবদের

মধ্য জানুয়ারিতেই তিন স্তরে ৫ শতাধিক কর্মকর্তার পদোন্নতি

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৫ জানুয়ারি ২০১৬

মধ্য জানুয়ারিতেই তিন স্তরে ৫ শতাধিক কর্মকর্তার পদোন্নতি

তপন বিশ্বাস ॥ বছরের শুরুতে মধ্য জানুয়ারিতে তিন স্তরে পদোন্নতি দিতে যাচ্ছে সরকার। উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব- এই তিন স্তরের পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তার পদোন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন হতে চলেছে। এবারের পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় ইতোপূর্বে বঞ্চিতদেরই প্রধান্য দেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, এবার পদোন্নতিতে যোগ্য কোন কর্মকর্তা যেন বঞ্চিত না হন সে বিষয়েও গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। অপর একটি সূত্র মতে, পদোন্নতি প্রদানের সংশ্লিষ্ট উইংয়ের স্বজনপ্রীতি বা কোন গাফিলতির কারণে যোগ্য কোন কর্মকর্তারা বাদ পড়লে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে তার জবাব দিতে হবে। সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হলে সে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মন্ত্রী নিজেই বিষয়টি দেখবেন। অভিযোগ রয়েছে অতীতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রভাবশালী কর্মকর্তার কারণে অনেকে পদোন্নতি বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে আর্থিক সংশ্লেষেরও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি প্রভাবশালী ওই কর্মকর্তার কোন এক আত্মীয়কে খুশি না করার জন্যও এক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে এমনও অভিযোগ অতীতে শোনা গেছে। এবার এজাতীয় কোন অভিযোগ এলে মন্ত্রী নিজে বিষয়টি দেখবেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় ইতিপূর্বে বঞ্চিতরাই প্রাধান্য পাবেন। ১৯৮২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যেসব ব্যক্তি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন সেসব ব্যাচের অন্তত হাজার খানেক কর্মকর্তা রয়েছেন যারা বিভিন্ন ধাপে (উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব) পদোন্নতি পাননি। এবার তাদেরই বিশেষ সুযোগ দিতে পদোন্নতির প্রক্রিয়াটি শুরু করা হয়েছে। পাশাপাশি ১১তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নতুন করে উপ-সচিব পদে পদোন্নতির তালিকায় নেয়া হচ্ছে। যদিও প্রশাসনে কোন শূন্য পদ নেই। বরং প্রতিটি পদের বিপরীতে অসংখ্য কর্মকর্তার উপস্থিতি প্রশাসনকে ভারি করে তুলেছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ৬ এপ্রিল তিন স্তরে বড় আকারের পদোন্নতি দেয়া হয়। এ সময় অতিরিক্ত সচিব পদে ২৩১, যুগ্ম-সচিব পদে ২৯৯ এবং উপ-সচিব পদে ৩৪৩ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। ফলে বর্তমানে মঞ্জুরিকৃত পদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সচিবের ১০৭ পদে ৩৭৩ কর্মকর্তা, যুগ্ম-সচিবের ৪৩০ পদে ৮৬৯ এবং উপ-সচিবের ৮৩০ পদে এক হাজার ৮১৮ কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন। অবশ্য পরিস্থিতি সামাল দিতে পদোন্নতিপ্রাপ্তদের অধিকাংশকে পদোন্নতি-পূর্ব পদে থেকেই কাজ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ অতিরিক্ত সচিব করছেন যুগ্ম-সচিবের কাজ, যুগ্ম-সচিব করছেন উপ-সচিবের কাজ, উপ-সচিব করছেন সিনিয়র সহকারী সচিবের কাজ। অনেকের আবার মঞ্জুরিকৃত পদ জোটেনি। সুপারনিউম্যারারি (সংখ্যাতিরিক্ত) পদে থেকে বিড়ম্বনার মধ্যেই আছেন তারা। তবুু পদোন্নতি পাওয়াটাকে গৌরবের বলেই মনে করেন তারা। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ২৪ দফা পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। আর এ প্রক্রিয়ায় বঞ্চনার ঘটনাও ঘটেছে। তদ্বিরের জোরে সিনিয়রকে টপকে জুনিয়রকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে অতীতে বিভিন্ন সময়ে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী ও মহাক্ষমতাধর ওই কর্মকর্তা ভুল তথ্য উপস্থাপন করে অনেককে বঞ্চিত করেছেন। আর এতেই তাদের কপালও পুড়েছে। এমন কি জনতার মঞ্চে থাকা কর্মকর্তা যারা বিএনপি আমলে কোন পদোন্নতি তো পাননি, বরং কোন রকমে চাকরিটাকে টিকিয়ে রেখেছেন সে সকল কর্মকর্তাকেও ওই কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত করেছেন বলে অভিযোগ উঠে এসেছে বার বার। পাশাপাশি জামায়াত-বিএনপিপন্থী হয়েও অযোগ্য কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে এমন কথাও শোনা গেছে। সুশাসনের কথা বলে ‘দলীয় আর নীতিনির্ধারকদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের’ নিরিখে দেয়া পদোন্নতিতে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী অবশ্য অতীতে একাধিকবার বলেছেন, পদোন্নতি না হওয়ার পেছনে কোন রাজনৈতিক কারণ নেই। প্রযোজ্য নম্বর না থাকা, বিভাগীয় বা দুর্নীতির মামলা, শাস্তিপ্রাপ্ত হওয়া, বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে বিরূপ মন্তব্য ইত্যাদি কারণে পদোন্নতি দেয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু যারা পদোন্নতি পান না তারা কেবলই বলেন বঞ্চনার কথা। কারণ নিজেরা জানলেও তারা তা বলেন না। আর সরকারও সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদার কথা ভেবে সব তথ্য প্রকাশ করে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র অবশ্য জানিয়েছে, বেশিরভাগ কর্মকর্তার পদোন্নতি সুনির্দিষ্ট কারণে আটকানো হলেও কিছু কর্মকর্তার পদোন্নতি দলীয় বিবেচনায় দেয়া হয়েছে-এটা ঠিক। তবে তার সংখ্যা বেশি হবে না। আবার ব্যাচভিত্তিক ঠেলাঠেলির প্রতিযোগিতায়ও অনেকে আটকা পড়েছেন। নতুন করে পদোন্নতি দেয়া হলে প্রশাসনের চেহারাটা কেমন হবে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এখন তো অতিরিক্ত সচিব যুগ্ম-সচিবের পদে কাজ করছেন, এবার পদোন্নতি হলে উপ-সচিবের পদেও তাদের কাজ করতে হবে। আর শাখা কর্মকর্তা বলতে পদের চিহ্নও থাকবে না। মাঠ প্রশাসনে এডিসিরা উপ-সচিব হয়েও সেখানেই থাকবেন। ডিসিরাও যুগ্ম-সচিব হয়ে থাকবেন। নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। তবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মত ভিন্ন। তাদের কথাÑ বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে যেসব কর্মকর্তা ন্যায্য পদোন্নতির যোগ্য, তাদেরকে পদোন্নতি না দেয়াটা হবে অন্যায়। প্রশাসন থেকে এ ধরনের অন্যায় দূর হওয়া প্রয়োজন। তাতে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে পদোন্নতির নিশ্চয়তা যেমন ফিরবে আবার কাজেও গতিশীলতা আসবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি অনুযায়ী প্রশাসন ক্যাডারের ২১তম ব্যাচের উপ-সচিব পদে পদোন্নতিযোগ্য অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের তালিকা চাওয়া হয়। অন্যদিকে যুগ্ম সচিব ১১তম ব্যাচের পদোন্নতির চিন্তাভাবনা রয়েছে। তবে যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে বঞ্চিতরাই অগ্রাধিকার পাবেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, যে সকল কর্মকর্তা পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেছেন, তাদের বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। যে সব কর্মকর্তা খুব কাছাকাছি সময়ে অবসরে যাবেন, পদোন্নতিতে তাদের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। এদিকে অন্যান্য ক্যাডারের তালিকা চাওয়া সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, সিনিয়র স্কেল পদে পাঁচ বছর চাকরিসহ সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের সদস্য হিসেবে ১০ বছর চাকরি পূর্ণ হয়েছে এমন কর্মকর্তাদের নাম পাঠাতে বলা হলো। প্রতিটি ক্যাডার থেকে দশ কর্মকর্তার নাম পাঠাতে হবে। চার কারণ সংবলিত কর্মকর্তাদের নামের তালিকা অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য অনুরোধ করা হলো। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে অনাগ্রহী কর্মকর্তা, জ্যেষ্ঠতা সম্পর্কে কোন আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকলে এবং যে সব কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হলে আদালত অবমাননা হতে পারে। ২১তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের যোগদানের জন্য নির্ধারিত তারিখের পরে যারা ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করেছেন এবং সিনিয়র স্কেলে যাদের চাকরির মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, কোন কর্মকর্তা অপশন দিয়ে উপ-সচিব পদে পদোন্নতি পেলে তাকে আবশ্যিকভাবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত পদে যোগদান করতে হবে। কর্মকর্তাদের তালিকা জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী সঠিক এবং নির্ভুলভাবে পাঠাতে হবে। কোন ধরনের ব্যত্যয়ের কারণে যদি কোন কর্মকর্তা ভুলক্রমে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন বা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হন তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ এর দায়িত্ব বহন করবে। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে তালিকা না পাওয়া গেলে পরবর্তীতে পাওয়া তালিকা বা নাম পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হবে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের তালিকা কমিয়ে আনতে জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজে উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে গ্রীন সিগন্যাল পান। এরপরই মন্ত্রণালয়ের উর্ধতনদের ওইভাবে নির্দেশ দেন।
×