ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মাইক্রোসফট

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ৫ জানুয়ারি ২০১৬

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মাইক্রোসফট

এনামুল হক মাইক্রোসফটের দৃষ্টিকোণ থেকে ১৯৯৪ সালের সবচেয়ে বড় ঘটনা ইন্টারএ্যাকটিভ টিভি। তারপর থেকে বেশ কিছুদিন মাইক্রোসফটের দিক থেকে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু পায়নি এর গ্রাহকরা। মাইক্রোসফটের অবস্থা দাঁড়িয়েছিল বুড়ো ঘোড়ার মতো। বাহ্যত মনে হচ্ছিল প্রতিষ্ঠানটি ‘উইন্ডোজ’ ও ‘অফিস’ থেকে প্রাপ্ত মুনাফার ওপর টিকে আছে। বড় ধরনের কোন উদ্ভাবনী পণ্য দেখার ক্ষমতা এর আর নেই। এই কোম্পানি ইন্টারনেট বিপ্লব, সার্চ বিপ্লব, মোবাইল বিপ্লব ও ক্লাউড বিপ্লব হাতছাড়া করেছে। কিন্তু গত এক বছরে নতুন সিইও সত্য নাদেলার নেতৃত্বে মাইক্রোসফট এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছে, যা টেক মিডিয়ার প্রশংসা না হলেও অন্তত সম্ভ্রম আদায় করেছে। স্কাইপ ট্রানসেøটর ও হলোলেন্স তার অন্যতম। এর ট্যাবলেট ও ল্যাপটপ প্রকৌশলগত চমৎকাররিত্বের দিক দিয়ে দারুণ আকর্ষণীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে। হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার উভয় জিনিসের নির্মাতা মাইক্রোসফট এ্যাপল ও এ্যান্ড্রয়েডের ট্যাবলেটের বাজারের একটা অংশ ধীরে ধীরে তবে নিশ্চিতভাবে কেড়ে নিচ্ছে। মাইক্রোসফটের ক্লাউড ব্যবসা নাদেলার নিজস্ব সৃষ্টি। বাজারের অংশের দিক দিয়ে এই ব্যবসায় এ্যামাজনের পরই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মাইক্রোসফট। গত জুলাই মাসে বাজারে এসেছে উইন্ডোজ ১০। এটি ভাল সাড়া পেয়েছে। বর্তমানে এটি বিশ্বের ডেস্কটপের প্রায় ৯ শতাংশে ব্যবহৃত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে উইন্ডোজ চলে প্রায় ৯০ শতাংশ কম্পিউটারে। গত বছর মাইক্রোসফটের শেয়ার ১৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সে তুলনায় এ্যাপলের শেয়ার বাড়েনি। গত ২৩ অক্টোবর মাইক্রোসফটের শেয়ারের দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ অংকে পৌঁছায়। ২০১৫ সালে তিনটি ক্ষেত্রে মাইক্রোসফট বিশেষ সাফল্যের স্বাক্ষর রাখে। যেমন উইন্ডোজ ১০, ক্লাউড ব্যবসা ও সম্প্রসারিত কৃত্রিম বুদ্ধির ক্ষমতা। এর হলোলেন্স হলো পরিধানযোগ্য হেডসেট যা চারপাশের বাস্তব জগতের ওপর ডিজিটাল উপায়ে সৃষ্ট এমন ত্রিমাত্রিক ছবি বিছিয়ে দেয় যা দেখতে বাস্তব জগতের অংশ বলে মনে হয়। একে বলে প্রসারিত বাস্তবতা যাকে নাদেলা সংক্ষেপে ব্যক্ত করেছেন ‘এআর’ হিসেবের। নাদেলা বলেন, ‘আমাদের গোটা কম্পিউটিং ইতিহাসে এতদিন পর্যন্ত আমরা এনালগ জগতে যা অস্তিত্বমান মূলত সেটাই গ্রহণ করে একটা ডিজিটাল রূপক তৈরি করেছি। এর একটা মস্তবড় দৃষ্টান্ত হলো ডেস্কটপ। তবে হলোলেন্সের মাধ্যমে এবারই প্রথম আমরা এনালগ জগত থেকে নিয়ে সেটার ওপর ডিজিটাল বস্তু সুপারইমপোজ করছি। আমরা সর্বদাই দর্পণের জগত তৈরি করেছি। আর এখন খোদ জগতটাই একটা দর্পণে পরিণত হয়েছে।’ হলোলেন্সের প্রয়োগের ব্যাপারটা দারুণ চমকপ্রদ। এ দিয়ে মাইনক্র্যাফট কাঠামো তৈরি করা যায় যা দেখতে মনে হয় আপনার বৈঠকখানাতেই রয়েছে। প্রজেক্ট এক্স-রে নামে এক কমব্যাট গেম আছে যেখানে আপনি আপনার রেফ্রিজারেটরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ড্রাগনদের সঙ্গে লড়াই করছেন। এমনি সব অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার হলোলেন্স দিয়ে সৃষ্টি করা যায়। এ অনেকটা থ্রি-ডি মুভির মতো। তবে সেটা আপনার বাড়িতেই আছে। কোম্পানিগুলো ভার্চুয়াল সাজ-সরঞ্জাম সম্পর্কে কর্মীদের ট্রেনিং দেয়ার কাজে হলোলেন্সকে ব্যবহার করতে পারে। নিজের ডেস্কে বসে আপনি আপনার চারপাশে শূন্যে ঝুলন্ত অসংখ্য ভার্চুয়াল ডেস্কটপ স্থাপন করতে পারেন। হলোলেন্স একক কোন বিস্ময়কর প্রযুক্তি নয়। এটি আসলে নুতন কতিপয় প্রযুক্তির সমাবেশ। এতে আছে আই ট্র্যাকিং, মোশন সেন্সিং, থ্রিডি ইমেজিং, শেপ রিকগনিশন। এগুলো সবই একসঙ্গে একীভূত করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে নাসা হলোলেন্স হেডসেট আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়েছে, যাতে নভোচারীরা পৃথিবীতে স্কাইপে কথা বলার কাজে সেগুলোকে ব্যবহার করতে পারেন। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, মাইক্রোসফট কোম্পানি চার বছর আগে ৮৫০ কোটি ডলারে স্কাইপ কিনে নিয়েছিল। মাইক্রোসফট এখন এই নতুন প্ল্যাটফর্মের জন্য নতুন ধনের স্কাইপ উদ্ভাবনের কথা ভাবছে এবং সেটা করার মতো ক্ষমতা ও সামর্থ্যও তার আছে। মাইক্রোসফট উদ্ভাবিত এক্সবক্স উইন্ডোজ চালাতে পারেনি। হলোলেন্স উইন্ডোজ চালিয়ে থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধি উদ্ভাবন ও বিকাশে মাইক্রোসফট ২০১৫ সালে বড় ধরনের অগ্রগতি অর্জন করেছে। চলতি ২০১৬ সালে সে অগ্রগতি আরও বিশাল আকার ধারণ করবে। কৃত্রিম বুদ্ধির (এআই) পেছনে মাইক্রোসফট কয়েক দশক ধরে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলেছে। এই বিনিয়োগের পরিণতি বা প্রভাব কতটা, তার পরিমাণ নির্ণয় করা যথেষ্ট কঠিন। তবে কৃত্রিম বুদ্ধির কার্যকারিতা যে বেড়েছে তা চোখে দেখা যায়। এমন সব সাজ-সরঞ্জাম বেরিয়েছে সেগুলো শিখছে, সিদ্ধান্ত দিচ্ছে এবং মোটামুটিভাবে এমন আচরণ করছে যার মিল সফটওয়্যারের সঙ্গে কিছুটা কম এবং মানুষের সঙ্গে কিছুটা বেশি। এর এক উত্তম দৃষ্টান্ত হলো স্কাইপ ট্রানসেøটর। এটি গত অক্টোবরে ব্যাপক সংখ্যায় বাজারে ছাড়া হয়। এটি কণ্ঠগত কথোপকথন ইংরেজী, জার্মান, ইতালীয়, ম্যান্ডারিন ও স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করতে পারে। এক্ষেত্রে সাফল্যের মাত্রাগত তারতম্য রয়েছে। গত নবেম্বরে মাইক্রোসফট তার উদ্ভাবিত এমন এক সফটওয়্যার দেখিয়েছে, যা চেহারার অভিব্যক্তি থেকে মানুষের মনোগত আবেগ-অনুভূতি চিনতে বা বুঝতে পারে। অবশ্য কৃত্রিম বুদ্ধি যে মাইক্রোসফটের একচেটিয়া বিষয় তা নয়। গত শরতে ফেসবুক, গুগল, এ্যামাজন, আইবিএম সবাই কৃত্রিম বুদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনের কথা ঘোষণা করেছে। শুধু ঘোষণা করাই নয়, কৃত্রিম বুদ্ধি প্রয়োগের উপায়ও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধি প্রয়োগ করার পুক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়েছে রানটাইম। রানটাইম হলো এমন এক মুহূর্ত যখন কোন এ্যাপের বাস্তবায়ন শুরু হয়। এর প্রথম প্লাটফর্ম ছিল পিসির অপারেটিং সিস্টেম। দ্বিতীয়টি ওয়েব এবং তৃতীয়টি হলো ইন্টেলিজেন্ট এজেন্ট বা পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট। আমরা এই তৃতীয় পর্যায়ের একদম প্রারম্ভিক স্তরে আছি বলে মনে করেন নাদেলা। স্মার্টফোনের বাজারে মাইক্রোসফটকে রীতিমতো লড়াই চালাতে হচ্ছে। পার্সোনাল কম্পিউইটং ডেস্কটপ থেকে মোবাইল ডিভাইসে দ্রুত স্থানান্তরিত হচ্ছে। স্মার্টফোনের বাজারে এ্যাপলের ভাগ হচ্ছে ১৬ শতাংশ। এ্যান্ড্রয়েডের ৮১ শতাংশ। মাইক্রোসফটের মাত্র ২.২ শতাংশ এবং এই সংখ্যাটা বাড়ছে না। মাইক্রোসফটের এখন মধ্য বয়স চলছে এবং সে কারণে কোম্পানিটি আগের মতো অত উচ্চাভিলাষী হতে পারছে না। তারপরও বলা যায়, কম্পিউটার জগতের ক্রমবর্ধমান জটিল পরিবেশে বুড়ো ঘোড়া মাইক্রোসফট আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এই ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে যিনি সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন তিনি মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী সত্য নাদেলা। ৪৮ বছর বয়স্ক নাদেলা ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এই প্রতিষ্ঠানের সিইও। গত একটি বছরে কোম্পানির যত রকমের সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে তাতে এই মানুষটির নাম ঘুরেফিরে আসে। তাই বলে অন্যদের ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। যেমন নাথান মাইরভোল্ড, রিক রশিদ, ক্রেগ মুনডাই। নাদেলার ভাষায় একসঙ্গে এত উচ্চমার্গের মেধার সমাবেশ মাইক্রোসফটের ইতিহাসে আর হয়নি। আর এই সম্মিলিত মেধার জোরেই ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেয়েছে মাইক্রোসফট। সূত্র : টাইম
×