ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

পাললিক অনুভবে কালিদাস কর্মকারের চিত্রপ্রদর্শনী

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৪ জানুয়ারি ২০১৬

পাললিক অনুভবে কালিদাস কর্মকারের চিত্রপ্রদর্শনী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রঙের বৈভবে চিত্রপট সাজান কালিদাস কর্মকার। সেই বর্ণবহুল ছবিতে দৃশ্যমান হয় বাংলার পলিমাটি আশ্রিত পাললিক অনুভব। রং ও রেখার অনবদ্য বিন্যাসে উপস্থাপিত হয় মানবীয় সম্পর্কের আখ্যান কিংবা চলমান সময়ের বয়ান। অবয়বহীন ক্যানভাসও যেন বলে যায় গভীরতাশ্রয়ী বহু কথা। বর্ণের মিছিলে চিত্রিত চিত্রপটে উঠে আসে যাপিতজীবন থেকে শুরু করে উচ্ছ্বাস-অভিব্যক্তি, একাকিত্ব, স্মৃতির খসড়া, ধর্মীয় সম্প্রীতি, লোকশিল্পের গৌরবগাথাসহ বহুমাত্রিক বিষয়। তাই বিমূর্ত হলেও চিত্রকর্মগুলো শিল্পরসিকের হৃদয়ে ছড়ায় ভাললাগার অনুভব। এমন বিষয় বৈচিত্র্যের সুবাদে ভাললাগার সেই অনুরণন নিয়ে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে শুরু হলো শিল্পীর ৭২তম একক প্রদর্শনী। শিরোনাম ‘পাললিক প্রাণ-মাটি-প্রতীক’। রবিবার পৌষের বিকেলে জাদুঘর আয়োজিত ২২ দিনব্যাপী এ প্রদর্শনীর সূচনা হয়। দিলীপ দাসের বাঁশির সুরে শুরু হওয়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি ফারুক সোবহান। অনুভূতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন কালিদাস কর্মকার। সভাপতিত্ব করেন জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী শমী কায়সার। কালিদাস কর্মকারের চিত্রকর্ম প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জাজান বলেন, ৫০ বছর ধরে ছবি আঁকছেন এই শিল্পী। এর মধ্যে গত ১৫ বছরে তার যতগুলো প্রদর্শনী হয়েছে সবটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাললিক শব্দটি। এ থেকে বোঝা যায়, পলিমাটির দেশে জন্ম নেয়া শিল্পী বিষয়টিকে সরবভাবে উপস্থাপনে বিশেষ আগ্রহী। যদিও বিমূর্ত হওয়ায় তার চিত্রকর্মের বিষয় নিয়ে কথা বলা বেশ কঠিন। তবে আমার মনে হয়, শিল্পী যুগের যন্ত্রণাকে মেলে ধরেছেন ক্যানভাসে। ছবির আবহ বুঝিয়ে দেয়, তার সৃষ্টির মূলে কাজ করেছে এক ধরনের যন্ত্রণাবোধ। আমাদের জীবন, ভাষা, সংস্কৃতি ও বর্ণমালা যে ক্রান্তিকালের মধ্যে আছে সেটিকে মেলে ধরার দায়িত্বটি কাঁধে তুলে নিয়েছেন এই শিল্পী। তাই সৌন্দর্যের অন্বেষা নয়, যন্ত্রণাবোধই তার ছবির মূল বিষয়। অনুভূতি প্রকাশ করে কালিদাস কর্মকার বলেন, আমি সব সময়ই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে চিত্রকর্ম সৃজন করতে পছন্দ করি। চারুকলার ছাত্রজীবন থেকেই এ প্রচেষ্টাটি অব্যাহত রেখেছি। ছবির মাধ্যমে কিছু বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করি। কখনও সফল হই, আবার কখনও বা ব্যর্থ হই। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, চিত্রকর্ম আমি খুব ভাল না বুঝলেও ভাল লাগে রং-তুলির আঁচড়। আর কালিদাস কর্মকারের মতো পরিশ্রমী শিল্পী আমি খুব কমই দেখেছি। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চিত্রকর্মের মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি উল্লেখ করে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, ছবির মূল্য সুলভ হওয়া উচিত। ইদানীং শিল্পকর্মের মূল্য খুব চড়া হওয়ায় চাইলেও সাধারণ মানুষ সেগুলো সংগ্রহ করতে পারে না। ফলে উচ্চবিত্তরাই কেবল চিত্রকর্ম সংগ্রহের সুযোগ পায়। তাই মধ্যবিত্তের ঘরের দেয়ালে কখনও শোভা পায় না চিত্রকর্ম। ক্যালেন্ডার কিংবা পোস্টার লাগিয়েই সেই সাধ মেটাতে হয়। এক্ষেত্রে শিল্পীরা যদি ছোট ছোট ছবি এঁকে দামটা নাগালের মধ্যে রাখতেন তাহলে মধ্যবিত্তরাও এ শিল্প সংগ্রহের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো না। ফারুক সোবহান বলেন, কালিদাস একজন সরল মনের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় বিকশিত হয়েছে তার শিল্পসত্তা। স্বদেশের প্রতি ভালবাসা তার শিল্পযাত্রার প্রধান অবলম্বন। ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, কালিদাস কর্মকারের চিত্রে আবহমান বাংলার রূপবৈচিত্র্য ধরা পড়েছে। উচ্ছ্বাস, বেদনা, স্মৃতি, একাকিত্ব নিয়ে শিল্পীর এ পাললিক যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। আগামী ১০ জানুয়ারি শিল্পীর ৭১তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে তিন পর্বের প্রদর্শনীর দ্বিতীয়টি হচ্ছে জাদুঘরে। তৃতীয় পর্বের প্রদর্শনী হবে রাজধানীর গ্যালারি টোয়েন্টি ওয়ানে। প্রদর্শনীটি সাজানো হবে তার ছাপচিত্র দিয়ে। জাদুঘরের প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে ৫২টি চিত্রকর্ম ও বাস্তব সময়ের নিরিখে দুটি স্থাপনাশিল্প। এ্যাক্রিলিক, মিশ্রমাধ্যম, গোয়াশ, কোলাজ, মেটাল কোলাজ, ড্রইং, ডিজিটাল লিথোগ্রাফে চিত্রকর্ম ও মিশ্রমাধ্যমের নানা উপকরণ সংযুক্ত হয়েছে শিল্পীর ক্যানভাসে। রং-তুলি আশ্রিত চিত্রকর্মগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে নানা ধরনের পাথর, কড়ি, প্রবাল, লাভা খ-, পোড়া কাগজ, মুক্তা, বিভিন্ন ধরনের কোরাল, কাচ, তাবিজ, কবজ ইত্যাদি। বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে শিল্পীর সমকালীন ভাবনায় নির্মিত দুটি স্থাপনাশিল্পও দারুণভাবে নজর কাড়ে শিল্পানুরাগীদের। বিশেষ করে রামু বৌদ্ধ মন্দিরের ঘটে যাওয়া ঘটনাকে তুলে ধরেছেন বৃহৎ আকারে। নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে এ স্থাপনা শিল্পে। শিল্পের কিছু রসদ সংযুক্ত হয়েছে পুড়ে যাওয়া মন্দির থেকে। বিভিন্ন ধর্মের প্রতীক তুলে ধরেছেন মুখায়ব স্থাপনার মধ্য দিয়ে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবতা ও সৌহার্দের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে স্থাপনা শিল্পটি। বৃহৎ আকারে এ স্থাপনাটি প্রদর্শিত হচ্ছে গ্যালারির মধ্যখানে। প্রদর্শনীর আরও একটি দিক হচ্ছে ডিজিটাল তথ্যচিত্র। শিল্পীর বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো কোথা থেকে উৎপত্তি হলোÑ কার প্রেরণায় একেকটি শিল্পকর্ম নান্দনিকতায় রূপ নিয়েছেÑ সেগুলোই ডিজিটাল ফটোগ্রাফিক সøøটের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হচ্ছে। প্রদর্শনী চলবে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা এবং শুক্রবার দুপুর আড়াইটা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। শিল্পী কালিদাস কর্মকারের জন্ম ১৯৪৬ সালে ফরিদপুর শহরের নিলটুলীতে। তিনি ১৯৬২-৬৪ সালে ঢাকা ইনস্টিটিউট অব আর্ট থেকে দুই বছরের কোর্স শেষ করে ১৯৬৯ সালে কলকাতায় গবর্নমেন্ট কলেজ অব ফাইন আর্টস এবং ক্রাফট থেকে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান নিয়ে চারুকলায় ¯œাতক ডিগ্রী লাভ করেন। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব ॥ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে চলছে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত অবধি সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির নন্দন মঞ্চে পরিবেশিত হচ্ছেÑ গান, কবিতা, নৃত্যসহ বহুমাত্রিক পরিবেশনা। ৬৪ জেলার শিল্পকলা একাডেমির চার হাজার শিল্পীর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত উৎসবের তৃতীয় দিন ছিল রবিবার। এদিনের পরিবেশনায় অংশ নেয়Ñ বগুড়া, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও টাঙ্গাইল জেলা শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা। আজ সোমবার বিভিন্ন পরিবেশনা উপস্থাপন করবে যশোর, পঞ্চগড়, সিরাজগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা।
×