ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কৃতি সংবাদ

শততম জন্মদিনে কথাশিল্পী শওকত ওসমান স্মরণ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৩ জানুয়ারি ২০১৬

শততম জন্মদিনে কথাশিল্পী শওকত ওসমান স্মরণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নিছক সাহিত্যের জন্য সাহিত্যচচর্চা নয়, মানুষের জন্য সাহিত্য রচনা করেছিলেন শওকত ওসমান। স্বদেশের প্রতি দায়বোধ থেকেই কলম ধরেছিলেন সমাজমনস্ক এই সব্যসাচী লেখক। একদিকে যেমন ধর্মান্ধতাকে তুমুলভাবে আঘাত করেছেন অন্যদিকে শোষকের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর সোচ্চার উচ্চারণ। লেখনীর মাধ্যমে বলেছেন শোষিতের কথা। কলমকে হাতিয়ার করে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন দেশদ্রোহী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে। শনিবার ছিল বরেণ্য এই কথাশিল্পীর শততম জন্মদিন ও ৯৯তম জন্মবার্ষিকী। জন্মজয়ন্তীতে স্মরণসভার মাধ্যমে লেখককে নিবেদন করা হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি। বিশিষ্টজনদের আলোচনায় উঠে আসে তাঁর বর্ণাঢ্য সাহিত্যজীবন এবং রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি সংকল্পের কথা। পৌষের বিকেলে সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের সেমিনার কক্ষে স্মরণসভার আয়োজন করে কথাশিল্পী শওকত ওসমান স্মৃতি পরিষদ। গান ও কবিতায় সূচনা হওয়া স্মরণানুষ্ঠানে শওকত ওসমানের সাহিত্যকর্ম, জীবন ও সৃষ্টি সম্পর্কিত আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। পিতৃস্মৃতিচারণ করেন কথাশিল্পীর ছেলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। সভাপতিত্ব করেন ভাষাসংগ্রামী, লেখক ও রবীন্দ্র গবেষক আহমদ রফিক। স্বাগত বক্তব্য রাখেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটু। রাজনীতির প্রতি শওকত ওসমানের গভীর অনুরাগের কথা উঠে আহমদ রফিকের বক্তব্যে। বলেন, বাংলাদেশের সাহিত্য ভুবনের অন্যতম এক পুরোধা পুরুষ শওকত ওসমান। তবে তিনি যতটা সাহিত্যিক ছিলেন ততটাই ছিলেন রাজনীতিক। ১২ বছরের ছোট হয়েও বন্ধুর মতো বহু বিকেল কাটিয়েছি তাঁর সঙ্গে। সেসব আড্ডায় বারংবার তাঁর মুখে উচ্চারিত হয়েছে রাজনীতির কথা। তিনি একইসঙ্গে জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে ধারণ করেছিলেন। শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। তাই স্বভাবজাতভাবেই তাঁর এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বোধ উঠে এসেছে লেখনীতে। প্রথম জীবনে মাদ্রাসায় শিক্ষা নেয়া মানুষটি পরবর্তীতে পরিণত হয়েছিলেন সাহিত্যিকে। আর সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে ব্যক্তির পাশাপাশি প্রাধান্য দিয়েছেন সমষ্টিকে। লিখেছেন মেহনতি মানুষের জীবন সংগ্রাম নিয়ে। এছাড়া তাঁর আরেক গুণ ছিল রসবোধ। এই রসবোধের কারণে এদেশের সাহিত্য আঙিনায় তিনি ছিলেন এক অসাধারণ স্যাটায়ার লেখক। তাঁর মৃত্যু পরবর্তীতে আমরা প্রবলভাবে এই বিদ্রƒপাত্মক লেখকের অভাব অনুভব করেছি। এ ক্ষেত্রে শওকত ওসমানের কোন উত্তরসূরি পাওয়া যায়নি। এই লেখকের আরেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি ছিলেন নিরীশ্বরবাদী। আমৃত্যু লালন করেছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা। পিতৃ-স্মৃতিচারণ করে ইয়াফেস ওসমান বলেন, শওকত ওসমান ছিলেন এক ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। তাঁর ভেতরে রসবোধ ছিল প্রবল। মনে পড়ে, ৭২ বছর বয়সে পাড়ি দিয়ে মজা করে বলেছিলেন, নট আউট সেভেন্টি টু। শৈশবে সকালবেলায় আমরা যখন খেলতে যেতাম তখন দেখতাম তিনি যোগাসন করছেন। লেখালেখির পাশাপাশি শরীরচর্চাটাও ছিল তাঁর নিত্যদিনের অভ্যাস। আবার কোন সকালে হয়ত খুব সুন্দর করে এস্রাজ বাজাতেন। ছাত্রদের পড়ানোর পাশাপাশি নিজেও প্রচুর পড়াশোনা করতেন। এ কারণেই তাঁর রচনা এমন তীর্যক হতে পেরেছে। কখনোই ফরমায়েসি লেখা লিখে সময় নষ্ট করেননি। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। পারিবারিক জীবনেও কখনও সততার বাইরে যাননি। সৎ জীবনযাপন করাটাও তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি। আর সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর মূল বিষয় ছিল সাধারণ মানুষ। এর কারণ তিনি নিজেও জন্মেছিলেন দরিদ্র পরিবারে। তাই সাহিত্যের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের সেই জীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন। ইয়াফেস ওসমান আর বলেন, অনেক বড় রাজনীতিকের চেয়েও শওকত ওসমানের রাজনৈতিক বোধ ও চেতনা অনেক বেশি ছিল। সংসার জীবনের বন্ধনের কারণেই হয়ত তিনি সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হননি। স্মরণানুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা সঙ্গীত ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গেয়ে শোনান নুরিতা নুসরাত খন্দকার। নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ কবিতাটি পাঠ করেন মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী। এদিকে সকালে শওকত ওসমানের জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনাসভার আয়োজন করে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ স্মরণসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন শওকত ওসমানের ছেলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান । বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ। কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের কর্মময় জীবন ও সাহিত্য নিয়ে ‘শওকত ওসমানের সমাজনিরীক্ষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন বিশিষ্ট গবেষক ড. আবুল আজাদ। আলোচনায় অংশ নেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান। স্বাগত ভাষণ দেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি এম. আজিজুর রহমান আজিজ। ইয়াফেস ওসমান বলেন, আমার বাবা শওকত ওসমান ছিলেন মুক্তবুদ্ধির পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁকে নিয়ে বরাবর আমাদের পরিবারের উদ্যোগে নানা আয়োজন করি। আগামী বছর তাঁর শততম জš§বার্ষিকী জাতীয়ভাবে উদযাপনের যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তাতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে কয়েকটি স্বরচিত ছড়া পাঠ করে বলেন, আমার বাবা শেষ জীবনে সমাজসচেতনতামূলক শ্লেষাত্মক কিছু ছড়া লিখেছেন। আমিও বাবার ধারাবাহিকতায় এ ধরনের ছড়া লিখছি। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে শওকত ওসমানকে মূল্যায়ন করে ইকরাম আহমেদ বলেন, শওকত ওসমানের লেখনীর বিষয় সমাজের মূল থেকে উঠে আসা। তিনি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সাথে যুক্ত। নাটকে শওকত ওসমানের অবদানের কথা উল্লেখ করে রামেন্দু মজুমদার বলেন, বাংলা নাটকেও তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ‘ক্রীতদাসের হাসি’ মঞ্চস্থ করেছিলাম। উপন্যাস থেকে আমিই নাট্যরূপ দিয়েছিলাম। ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, শওকত ওসমান সাহিত্যের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির প্রণোদনা যুগিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তাঁর সাহিত্য তরুণ প্রজন্মেকে সঠিক দিক নিদের্শনা দেবে। শওকত ওসমানের সাহিত্যপাঠ কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে সংস্কারমুক্ত সমাজ নির্মাণের আলোতে ফেরাবে। কালিদাস কর্মকারের প্রদর্শনী শুরু আজ ॥ প্রখ্যাত শিল্পী কালিদাস কর্মকারের ৭২তম প্রদর্শনীর উদ্বোধন হবে আজ রবিবার। ‘পাললিক প্রাণ-মাটি-প্রতীক’ শীর্ষক এই প্রদর্শনীর অনুষ্ঠিত হবে রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনালয়ে। আজ বিকেল ৫টায় ২২ দিনের এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি থাকবেন ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান। এ উপলক্ষে শনিবার জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ড কক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় জাদুঘরে মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী ও শিল্পী কালিদাস কর্মকার। সংবাদ সম্মেলনে জানান হয়, শিল্পীর ৭২তম জš§দিন উপলক্ষে তিন পর্বের শিল্পকর্ম প্রদর্শরীর আয়োজন করা হয়েছে। কিছুদিন আগে প্রথম পর্বের প্রদর্শনী হয় রাজধানীর উত্তর বাড্ডার এ্যাথেনা গ্যালারিতে। দ্বিতীয় পর্বের প্রদর্শনী নলিনীকান্ত ভট্টাশালীর পর তৃতীয় ও সমাপনী পর্ব অনুষ্ঠিত হবে ধানম-ির গ্যালারি টোয়েন্টি ওয়ানে। শিল্পীর সাম্প্রতিক আঁকা ৪১টি চিত্রকর্মসহ ৪৫টি চিত্রকর্ম ঠাঁই পাবে প্রদর্শনীটিতে।
×