ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নোনাজলের হাতছানি

ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও... আদর দিয়ে চোখে মাখাও

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৩ জানুয়ারি ২০১৬

ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও... আদর দিয়ে চোখে মাখাও

মোরসালিন মিজান, কক্সবাজার থেকে ফিরে জায়গার নামের সঙ্গে ‘বাজার’ শব্দটি আছে। তাই বলে কক্সবাজার তো আর হাট বাজার হতে পারে না। আপাতদৃষ্টিতে অবস্থা তা-ই। এখন যেদিকে চোখ যায়, মানুষ আর মানুষ। হৈ হুল্লোড়। চিৎকার চেচামেচি। এর পরও সমুদ্রের পানে ছুটছে মানুষ। এভাবে সমুদ্রের অধিক জনসমুদ্র! আর দুই সমুদ্রের অভূতপূর্ব এই মিলন ঘটিয়েছে শীতের কাল। প্রতিবারের মতোই প্রিয় ঋতুর শুরুতে আয়োজন করা হয়েছে মিলনোৎসবের। কত রঙের, রকমের উৎসব! অনুষ্ঠান! সবই সমুদ্রকে ঘিরে। আর যারা বুকের ভেতরে এক সমুদ্র জল নিয়ে বাঁচেন, তাঁদের তো সমুদ্রই একমাত্র সখা। কান্নার জল সমুদ্রের জলে ধুয়ে দিতে আসেন তাঁরা। ভালবাসার মানুষ সঞ্জীব চৌধুরী তাঁদের উদ্দেশেই হয়ত গেয়েছিলেন- চোখটা এত পোড়ায় কেন/ ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও/ সমুদ্র কী তোমার ছেলে/ আদর দিয়ে চোখে মাখাও...। হ্যাঁ, পোড়া চোখে দেখা সমুদ্র আরও সুন্দর। আরও বিশাল। আরও আরও পবিত্র। সেই বিশুদ্ধ দেখার শৈল্পিক মানুষ, প্রেমিক পুরুষ, প্রিয়তমারা নীরবে উপভোগ করছেন সমুদ্রসঙ্গ। কারও আর আজানা নয়, বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। মূল শহর থেকে বদরমোকাম পর্যন্ত ১২০ কি.মি. এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। বার বার দেখা সমুদ্রকে আরও একবার দেখা হলো। বৃহস্পতি ও শুক্রবার- দুই দিনের দেখা। প্রথম দিন খুব ভোরে কলাতলীতে গাড়ি থামতেই কানে আসে সমুদ্রের গর্জন। গর্জন? নাকি স্বাগত সঙ্গীত! মন কেমন আকুলি বিকুলি করে ওঠে। ভেতরটা বেজে ওঠে। নিজের অজান্তেই চোখ ছুটে যায়। উঁকি দিয়ে ঠিকই দেখে নেয় ‘সমুদ্রসফেন’। তার পর হোটেল কক্ষ। ভ্রমণ ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা। কিন্তু সমুদ্রের হাতছানি যে টের পায়, তাঁর আর ঘর বলে কিছু থাকে না। বের হয়ে আসতে হয়। পথিমধ্যে এত মানুষ যে, হাঁটার পথটি খুঁজে নিতে হয়। গায়ে গা লেগে যায়। তবু চোখ পথের দিকে তাকায় না। সমুদ্রের পানে তাঁকিয়ে হাঁটতে হয়। কিছু সময় হাঁটার পর বালির পথ। পা ডুবিয়ে হাঁটা যায়। দৌড়ানো খুব কঠিন কাজ। তবু দৌড়। মনের আনন্দে। তারও আগে অসংখ্য মানুষ এসে তীরে দাঁড়িয়েছেন। না, তাঁদের দেখা যায় না। সমুদ্রের বিশালতার কাছে মানুষের দীর্ঘ সারিকে যারপর নাই সরু দেখায়। মনে হয় সাদা ক্যানভাসের ঠিক মাঝখানটায় একটা তুলির টান দিয়ে গেছেন বিখ্যাত কোন শিল্পী! রেখাটুকুন পেছনে ফেলে সামনে এগোলে সমুদ্র। সেখানেও অগুনতি মানুষ। ভিড় ঠেলে সমুদ্রে নামতেই অদ্ভুত শিহরণ! আবারও বোঝা হয়, এই শিহরণ কেবল সমুদ্র দিতে জানে। একই রকম শিহরণ খেলা করছিল আর সব মানুষের মনে। অপেক্ষাকৃত তরুণরা ধনুক থেকে ছোড়া তীরের মতো সমুদ্রবক্ষে ছুটে আসছিলেন। মুহূর্তেই পৌঁছে যাচ্ছিলেন দূরে, আরও দূরে। অনেকেই দলবেঁধে সাঁতার শুরু করছিলেন বটে। ঢেউ তাদের এক থাকতে দিচ্ছিল না। আবার যারা যথেষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়েছিলেন বড় ঢেউ এসে তাদের এক করে দিচ্ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরিফ, সোহান, সাইদুলরা এই প্রাকৃতিক খেলায় খুব মজা পাচ্ছিলেন। আরিফ বললেন, এই খেলাটার অংশ কিন্তু সমুদ্রও। আমাদের সঙ্গে দেখছেন না কী দারুণ খেলছে। সোহান একজনকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ওই দেখুন একটু যারা নীরব প্রকৃতির, তাদের ভেতরের ঘুমও ভাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তুমুল ঢেউ। ভাসিয়ে নিচ্ছে অনেকটা। আবার পাড়ে ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তরুণীরা টিনেজ মেয়েরাও এখানে বিপুল সাহসী। শত ঢেউ নিজের একলা চেষ্টায় ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছিল। না, তাঁদের কারও সঙ্গে কথা হলো না। তবে, জয় করার সে কী আনন্দ তাদের চোখে মুখে! পরিষ্কার দেখা গেল! প্রচলিত দৃশ্যগুলোর বাইরে নিজেদের মতো করে দৃশ্যকল্প তৈরি করে নেন কিছু মানুষ। এঁরা ভিড় এড়িয়ে চলেন। যে অংশে মানুষ খুব কম, সেখানে নিজেদের মতো করে কাটান। এক জুটি সমুদ্রে নামার আগে হাত দিয়ে একে ছুঁয়ে দেখছিলেন। মুঠো ভর্তি করে জল তুলছিলেন। যেটুকু বালি চিকচিক করছিল, বিস্ময় নিয়ে একে অন্যকে দেখাচ্ছিলেন। দেখা শেষ হলে ছোট্ট করে ডুব দেয়া। বাকি সময় মেয়েটা ছেলেটার হাত আঁকড়ে ধরে ছিল। তীর ধরে হাঁটছিল তাঁরা। কথা বলে জানা গেল, দুজন সদ্য বিয়ে করেছেন। স্বামী আরেফিন। আর কনের নাম মাইশা। ঢাকায় থাকেন। বিয়ের পর সমুদ্র দেখতে এসেছেন। ভেজা শরীরে গভীর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতেই নাকি ভাল লাগে তাদের! তাঁরা চান সমুদ্র কাছে আসুক তাদের। পায়ে আছড়ে পড়ুক ঢেউ। অভিবাদন জানাক। কবির কবিতার সঙ্গে মিলে যায় কথাগুলো। যেখানে কবি বলছেন- যে-টুকু কাছে এলে,/তোমাকে দেখে সমুদ্র উত্তাল হল,/ সৈকতের বাঁধা পরিধি যত তুচ্ছ করে,/ আমি বুঝে নিই-/সমুদ্রেরও আমার মত তৃষ্ণা আছে...। অনেকে মনে করেন, সমুদ্রের কাছে সব সুখী মানুষ আসেন। আদতে তা নয়। কেউ কেউ বুকে জমানো কান্নার জল ঢেলে দিয়ে যান সমুদ্র বক্ষে। মহাদেব সাহা তো মায়ের চোখের জলের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন সমুদ্রকে। লিখেছিলেন- সমুদ্রের নীল জলরাশির দিকে তাকিয়ে কখন মনে পড়েছে/ আমার মায়ের অশ্রুভেজা দুটি চোখ...। প্রেমিক পুরুষও সমুদ্রের জলে কান্না ধুয়ে দিতে আসেন। তাঁদের একজন ইকবাল হোসেন। মানুষটি একলাটি বসে ছিলেন। অনেক্ষণ ধরে খেয়াল করে নিশ্চিত হওয়া গেল, তিনি একলাটি। কাছে গিয়ে কথা বলে জানা গেল, ভালবাসার মানুষটিকে তিনি নিজে বিসর্জন দিয়েছেন। বিসর্জন দিয়েছেন বটে। বুকে ব্যথাটা এখনও অটুট। সেই ব্যথা কাউ তিনি বলতে চান না। তাই সমুদ্রের কাছে আসা। জানালেন, অনেক রাত পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতে কাটান তিনি। অন্ধকারে নাকি নিজের মতো করে কাঁদা যায়! এই কান্নার শব্দ কেউ শুনে না! সব মিলিয়ে ভারি অদ্ভুত সমুদ্র! তবে সমুদ্রকে বুঝতে হয়। বুঝলে পরেই সমুদ্র সমুদ্র হয়ে ধরা দেয়। কবিগুরু তাই লিখেছিলেন- শঙ্খকে সমুদ্র হইতে তুলিয়া আনিলেও সে সমুদ্রের গান ভুলিতে পারে না। উহা কানের কাছে ধর, উহা হইতে অবিশ্রাম সমুদ্রের ধ্বনি শুনিতে পাইবে।
×