ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বছরের শুরুতেই এ জন্য জেআরসির বৈঠক ও বিষয়টির দ্রুত নিষ্পত্তি চায় ঢাকা

পাংশায় গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প ॥ বাস্তবায়নে ভারতের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৩ জানুয়ারি ২০১৬

পাংশায় গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প ॥ বাস্তবায়নে ভারতের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ

তৌহিদুর রহমান ॥ গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারতের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই প্রতিবেশী দেশটিকে বিস্তারিত অবহিত করা হয়েছে। ভারতকে জানানো হয়েছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উভয় দেশই লাভবান হবে। আগামী যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি সুরাহা করতে চায় বাংলাদেশ। আগামী দুই বছরের মধ্যেই গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের মূল কাজ শুরু করতে চায় সরকার। প্রকল্প সমীক্ষার কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের পরে পাঁচ বছরের মধ্যেই এই অর্থব্যয় উঠে আসবে। এদিকে জাপান, চীন ও মালয়েশিয়া এই প্রকল্পে সহায়তা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সূত্র জানায়, গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য ভারত জানতে চেয়েছে। সে জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পের যাবতীয় তথ্য তাদের সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া যৌথ নদী কমিশনের ৩২, ৩৩ ও ৩৪তম বৈঠকেও দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। তবে ভারতের পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভারতীয় অংশে পানির প্রবাহ কমতে পারে। তবে ভারতকে জানানো হয়েছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উভয় দেশেরই লাভ হবে। দুই দেশের অভিন্ন নদী বেঁচে থাকলে সবারই লাভ হবে। এছাড়া এই ব্যারাজ বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর সুন্দরবন উভয় দেশেরই সম্পদ। নতুন বছরের শুরুতেই যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক করতে আগ্রহী বাংলাদেশ। ইতোমধ্যেই যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের প্রস্তাব করা হয়েছে। দুই দেশ আলোচনার মাধ্যমে বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করবে। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশ গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে চায়। এদিকে গত ২৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণের বৈঠকেও গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়টি আলোচনা হয়। পদ্মা নদীর উপর গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের বিষয়েও উভয়েই একমত পোষণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই ব্যারাজ নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সূত্র মতে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনমান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নদীর পলিমাটি অপসারণ, নাব্য ও পানি প্রবাহ বৃদ্ধি, লবণাক্ততা হ্রাস, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ কৃষির উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০৫ সালে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পের প্রাথমিক অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পটি অনুমোদনের চার বছর পর ২০০৯ সালের মার্চে সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এ প্রকল্পের সমীক্ষার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়। সমীক্ষা প্রতিবেদনটি সরকারের কাছে ইতিমধ্যেই পেশ করা হয়েছে। রাজবাড়ী জেলার পাংশায় এই ব্যারাজ নির্মাণ করা হবে। ব্যারাজটি হবে নীলফামারীর ডালিয়ায় নির্মিত তিস্তা ব্যারাজের আদলে। ব্যারাজ থেকে উজানে ১৬৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকবে বিশাল পানি রিজার্ভয়্যার। যার পানি ধারণক্ষমতা থাকবে দুই হাজার ৯০০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। এই পরিমাণ পানি থেকে ব্যারাজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে দুই হাজার মিলিয়ন কিউসেক পানি সরবরাহ করা হবে। গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ হলে গঙ্গানদী-নির্ভর এলাকার মানুষের জীবিকার প্রসার জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন তথা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধন হবে। প্রকল্পের অধীনে ১১৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পানিবিদ্যুতকেন্দ্র গড়ে উঠবে। সেই সঙ্গে উপকূলীয় অঞ্চলে পোল্ডারসমূহে ব্যাপক জলাবদ্ধতারও নিরসন হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩৭ শতাংশ এলাকার কৃষি ও মৎস্য উৎপাদনসহ নৌ যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। দুই হাজার ২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে গঙ্গা নদীর বাংলাদেশ অংশে পড়েছে ২৪০ কিলোমিটার। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে গঙ্গা নদীতে পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তর সাতটি জেলার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তির প্রাপ্ত পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে গঙ্গা নির্ভর নদীগুলোর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা অনুযায়ী নদীসমূহের মধ্যে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। যার ফলে ওই এলাকার বিশাল অঞ্চলে সেচের ব্যবহার নিশ্চিত হবে। এছাড়া মূল ব্যারাজ ও গড়াই অফটেক স্ট্রাকচারে ১১৩ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব হবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে সেচ সমস্যার সমাধান ছাড়াও ওই এলাকায় অতিরিক্ত ২৫ লাখ মেট্রিক টন ধান এবং প্রতিবছর দুই দশমিক চার লাখ মেট্রিক টন মাছ চাষ করা যাবে। সম্ভাব্যতা যাচাই অনুযায়ী প্রকল্পটির কাজ পাঁচ বছরের মধ্যে শেষ করা হবে। এই ব্যারাজ নির্মাণ হলে আয় হবে প্রতিবছর ৭ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা। দীর্ঘ মেয়াদে এই আয় আরও বৃদ্ধি পাবে। সূত্র জানায়, গঙ্গা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশে ৫১ দশমিক ৪৭ লাখ হেক্টর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ১৯ লাখ হেক্টর জমি এই প্রকল্পের মাধ্যমে সেচের আওতায় চলে আসবে। প্রকল্পটির প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে দুই হাজার ১০০ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট মূল ব্যারাজ, ৭৮ স্পেলওয়ে, একটি নেভিগেশন লক, দুটি ফিশপাস ও অন্যান্য স্থাপনা। অপরদিকে এ প্রকল্পের আওতায় গড়াই অফটেক স্ট্রাকচার তৈরি করা হবে, যার দৈর্ঘ্য হবে ৩৯০ মিটার। এখানেও ১৫ স্পেলওয়ে, একটি নেভিগেশন লক ও একটি হাইড্রোপাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করা হবে। গঙ্গা ব্যারাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মাধ্যমে ১২ মাস পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। যা দেশের আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে বড় ধরনের বিপ্লব নিয়ে আসবে। পরিবেশে ফিরে আসবে ভারসাম্য। ব্যারাজটি নির্মিত হলে দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবে। সম্পূর্ণ দেশী অর্থায়নে এটি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি এ্যান্ড ডিটেইল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফর গ্যাঞ্জেস ব্যারাজ প্রজেক্ট’-এর আওতায় সমীক্ষা চালানো হয়। ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড ডিজাইন কনসালট্যান্ট নামক একটি দেশী প্রতিষ্ঠান এই ব্যারাজ নির্মাণে সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া ও চীনের বিশেষজ্ঞরাও জড়িত ছিলেন। সমীক্ষা শেষে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবেদন পেশ করে। জানা গেছে, গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়নে জাপান, চীন ও মালয়েশিয়া সরকার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীনের ‘থ্রি গর্জিয়াস’ নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই এ প্রকল্প নির্মাণে প্রস্তাব দিয়েছে। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশী অর্থ সহায়তা নেয়া হবে কি না এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। গঙ্গা ব্যারাজের মাধ্যমে বছরজুড়েই পানি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। দেশে এই প্রথম এরকম একটি ব্যারাজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ৩ থেকে ৪ মাস পানি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর কৃষকরাও সুবিধা পেয়ে থাকেন নির্দিষ্ট ওই সময়েই। তবে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ হলে বছরজুড়েই পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
×