ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

২০১৬ সালকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বছর ঘোষণা ;###;মাঠ পর্যায় থেকে বড় প্রকল্প- সর্বত্রই দুর্নীতি চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে

এবার যুদ্ধ ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৩ জানুয়ারি ২০১৬

এবার যুদ্ধ ঘোষণা

রশিদ মামুন ॥ মাঠ পর্যায় থেকে বড় প্রকল্প সবখানে দুর্নীতির ক্ষেত্র চিহ্নিত করে বন্ধের ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে বিদ্যুত-জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। চলতি বছরকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘লড়াইয়ের বছর’ হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। নিজস্ব কর্মকা-ে দুর্নীতি প্রতিরোধের এই উদ্যোগ দেশের মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে প্রথম বলে দাবি করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান সারাদেশে বিদ্যুত বিতরণের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এক্ষেত্রে উৎপাদন ও বিতরণ পর্যায়ে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেয়া হচ্ছে। উন্নয়ন ধারাবাহিকতায় দুর্নীতির প্রবেশ ঘটলে সরকারের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে বলেই এই নতুন ব্যবস্থা। এ প্রসঙ্গে জ্বালানি সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমাদের সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা। সকল ক্ষেত্রে যদি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় তাহলে দুর্নীতি এমনিতেই কমে যাবে। এ কারণেই বিদ্যুত এবং জ্বালানি বিভাগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। বিদ্যুত বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আশুগঞ্জে একটি বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ পাইয়ে দিতে অন্তত ৬৪ কোটি টাকা লেনদেনের ঘটনা নিয়ে বিদ্যুত বিভাগ তদন্ত নেমেছে। সরকারকে অন্ধকারে রেখেই মন্ত্রণালয়ের মধ্যমসারির এক কর্মকর্তা এবং আশুগঞ্জ বিদ্যুত কেন্দ্রের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিলে বিদেশী ওই কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন বলে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি মনে করছে। যদিও এখন নানামুখী চাপে তদন্ত হিমাগারে রক্ষণাবেক্ষণের জোর চেষ্টা চলানোর অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে ৩০ কার্যদিবস সময় দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তিন মাস পার হওয়ার পরও তদন্তে কোন অগ্রগতি নেই। তদন্ত কমিটির প্রধান অবসরে যাওয়ায় থমকে আছে নতুন প্রধান নিয়োগের কাজ। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা হবে ২৪ হাজার মেগাওয়াট, আর ২০৩০ সালের মধ্যে ওই ক্ষমতা বাড়িয়ে ৪০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে। উৎপাদন বিতরণ মিলে অন্তত ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ঘটবে বিদ্যুত খাতে। অন্যদিকে সরকার জ্বালানি খাতে বড় প্রকল্প গ্রহণ করছে। এখনও পর্যন্ত চারটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গ্যাস আমদানির এই প্রকল্প নির্মাণে অন্তত আরও ছয় বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। বিপুল বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব থেকে বড় সমস্যা দুর্নীতি। বেশি বিনিয়োগ হলে বেশি দুর্নীতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। এখন যার অভাব বোধ করছে বিদ্যুত জ্বালানি খাত। সরকার বলছে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের প্রতি প্রান্তে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়া হবে। এজন্য ২০২১ সালের মধ্যে ছয় হাজার কিলোমিটার নতুন বিদ্যুত সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া এক লাখ কিলোমিটার বিতরণ লাইন এবং প্রয়োজনীয় সাবস্টেশন নির্মাণ করতে হবে। সারাদেশে আলো ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রতিমাসে বিতরণ কোম্পানিগুলো গড়ে সাড়ে তিন লাখ গ্রাহককে বিদ্যুত সংযোগ দিচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে বেশিরভাগ সংযোগে উৎকোচ দিতে হয়। আর এই উৎকোচের পরিমাণ পাঁচ থেকে কুড়ি হাজার টাকার মধ্যে। তবে শিল্প সংযোগে এই পরিমাণ আরও বেশি। বিশেষ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীন সমিতিগুলোতে ঘুষ ছাড়া নাকি সংযোগ পাওয়া যায় না। আরইবির শীর্ষ পর্যায় বিষয়টি জানলেও ঘুষ বন্ধের পর্যাপ্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো গ্রাহককে সংযোগের জন্য ঘুষ না দিয়ে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানানো হচ্ছে। ঘুষ লেনদেন বিষয়ে আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি গ্রাহককে ঘুষ না দিয়ে ধৈর্য ধারনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, গ্রাহক তো এত দিন বিদ্যুত পাননি। সেখানে আরও এক থেকে দু বছর না পেলে সমস্যা কি। ধৈর্য ধরুন প্রত্যেকে সংযোগ পাবেন। তিনি ওই সময় স্বীকার করেন, আরইবির কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং স্থানীয় দালাল মিলে একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। তারা সংযোগ বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তা জানান, উৎপাদন এবং বিতরণ সবখানেই দুর্নীতি রয়েছে। আরইবির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রকাশ্যে ঘুষ নিচ্ছেন বলে চোখে পড়ছে। কিন্তু যারা এখানে বড় বড় প্রকল্পে কাজ করেন তাদের দুর্নীতি চোখে পড়ছে না। তারা হয়তো প্রকল্প অনুমোদনে সহায়তা করে অথবা অন্য কোন পন্থায় ঘুষ গ্রহণ করছেন। আশুগঞ্জের বিষয়টি সামনে আসায় বিদ্যুত বিভাগ আরও নড়েচড়ে বসেছে বলেও জানান তিনি। সরকারের অগ্রাধিকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অন্যতম বিদ্যুত ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়। বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দেও সরকার অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। বিদ্যুত ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দফতর ও সংস্থায় প্রতিনিয়ত দুর্র্নীতির খবর পাচ্ছে মন্ত্রণালয়। নামে-বেনামে অসংখ্য অভিযোগ জমা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে সব অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা হচ্ছে তদন্ত করলে এগুলোর সত্যতা মিলছে। ফলে দুর্নীতি কমাতে মন্ত্রণালয় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে চায়। অন্যদিকে গ্যাসের সংযোগ নিতেও বিপুল পরিমাণ লেনদেন করতে হয়। বিশেষ করে শিল্প সংযোগের ক্ষেত্রে এই লেনদের পরিমাণ আকাশ ছোঁয়া। দেশের বিভিন্ন স্থানে একইভাবে অবৈধ গ্যাস পাইপ লাইন বসিয়ে সরকারী সম্পত্তির বাণিজ্য করছে এক শ্রেণীর মানুষ। এসব কিছুর বিরুদ্ধেও সরকারের কোন কঠোর ব্যবস্থা নেই। জানতে চাইলে বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমরা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এজন্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে। একটি প্রকল্প ধরে বিশ্লেষণ করা হবে কোথায় কোথায় দুর্নীতি হতে পারে। ওইসব জায়গাকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তিনি এক্ষেত্রে নিয়মিত পর্যালোচনা এবং নিরীক্ষার ওপর জোর দেন। একই সঙ্গে প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানোর বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ধরুন একটি নির্দিষ্ট সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিদ্যুত সংযোগের আবেদন করার পদ্ধতি তৈরি করা হলো। এখানে আবেদন করলে একটি সিরিয়াল নাম্বার দেয়া হবে। এই সিরিয়াল অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংযোগ দিতে হবে। কেউ যদি অবৈধ সুযোগ নিয়ে সিরিয়াল নাম্বার ভেঙ্গে পেছনের কাউকে সংযোগ দেয় সেটা আমরা বুঝতে পারব। এতে গ্রাহক হয়রানি এবং ঘুষ গ্রহণ কমতে পারে। তিনি জানান, আমরা প্রকল্প থেকে গ্রাহক সেবা সবখানে কীভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে পারি তার একটি পন্থা বের করার চেষ্টা করছি। চলতি বছরের মধ্যেই তা প্রয়োগ শুরু হবে। যে কোন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিকে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হবে।
×