ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কামাল লোহানী

‘মুক্তিযোদ্ধা’ খালেদা জিয়ার স্পর্ধিত উচ্চারণ

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ৩ জানুয়ারি ২০১৬

‘মুক্তিযোদ্ধা’ খালেদা জিয়ার স্পর্ধিত উচ্চারণ

হায়রে দুর্ভাগা দেশ! তোমাকে শাসন করার জন্য যে নারী কয়েকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী সেজেছিলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী হয়েছেন, তিন দশকেরও বেশি সময় রাজনীতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন, তিনি এমন ‘নির্বোধ’-এর মতন কথা বললেন কেন বুঝলাম না। নাকি দেশবাসী সকলকে নির্বোধ বানাবার জন্যই কি এমন কথা বলেছেন? নিহত পতিকে পুঁজি করে ভদ্র মহিলা একজন বিচারপতিকে অপমানিত করতেও দ্বিধা করেননি; সেই ‘রাজনৈতিক নেত্রী’ এতদিন পরে কোথা থেকে জানলেন যে ‘শেখ মুজিব স্বাধীনতা চাননি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন।’ অসাধারণ ধীশক্তির অধিকারী (?) এই ‘নারী’ এতদিন পরে দারুণ এক আবিষ্কারের আনন্দে কথাটা বলে সমর্থক-সমাবেশে বাজিমাত করতে গিয়ে অজ্ঞানতার যে পরিচয় দিয়েছেন, তাকি আদৌ বুঝতে পেরেছেন? নাকি নাচের পুতুলের মতন সুতোর টানে আওয়াজ করে যাচ্ছেন? নাচছেন? ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দলীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে ২১ ডিসেম্বর উপরোক্ত অজ্ঞানতার পরিচয় দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য তো করেছেনই, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক আছে বলে আরেকটি নতুন উদ্যত উচ্চারণ করেছেন। খালেদা জিয়া তো জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, তিনি তার মৃত্যুর পর রাজনীতিতে এসে প্রধানমন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। তাতে তিনি ভুলে গেছেন, কার মর্যাদা কতখানি এবং দেশপ্রেমিক মানুষগুলোই যে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেশমাতৃকাকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে পুনরুদ্ধার করেছেন। অবশ্য খালেদা জিয়া সে কথা বুঝবেন কি করে? তিনি তো জানেন না, দেশে কি ধরনের গণহত্যা হয়েছিল, কত মানুষ তাতে নিহত হয়েছে পাকিস্তানীদের হাতে এবং জামায়াতে ইসলামীর মতন সন্ত্রাসী দলের নরখাদক-পিশাচদের নিপীড়নে! কারণ তখন তো তিনি পাকিস্তানী সেনা অফিসার ব্রিগেডিয়ার জানজুয়ার তত্ত্বাবধানে পাকিস্তানী সেনানিবাসে বাস করতেন স্বাচ্ছন্দ্যে। তাঁর কি শহীদের সংখ্যা কত এই বক্তব্য দেয়া, ৪৪ বছর পর শোভা পায়। না তাঁর অজ্ঞতার প্রমাণ মেলে? নাকি তিনি কারও ডিকটেশনে পাখির বুলি আউড়ে যাচ্ছেন? তাও বা কি করে- তিনি তো ৩৫ বছর ধরে রাজনীতি করছেন, দল প্রধান সেজে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন বার বার। সেই ‘দেশনেত্রী!’ কি করে এতসব কথা পাগলের প্রলাপ বকে গেলেন? তিনি তো শুধু বঙ্গবন্ধুকে ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী’ বানাতে চাননি, শহীদের সংখ্যা নিয়ে যে বিতর্কের কথা বলেছেন ঐ সমাবেশে সেটা এতদিন পরে মনে পড়ল কেন? এতদিন ‘কোথায় ছিলেন ...? বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। বলা হয়, এত লাখ লোক শহীদ হয়েছেন, এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে। আসলে কত লোক শহীদ হয়েছে?’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ না করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন! জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে দেশ স্বাধীন হতো না। খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধকালে যারা মানুষ মেরেছে, অত্যাচার করেছে, তাদের সম্পর্কে বলেছেন, আমরাও সেসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই। কিন্তু সেই বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিকমানের, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক। তাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।... তিনি পুরনো গান বার বারই গাইছেন। ঠিক আছে বুঝলাম, শুনলাম আপনার কথা। কিন্তু আপনি তো দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিন তিনবার। তখন যুদ্ধাপরাধীদের স্বচ্ছ ও মিতালী করে যাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকাই তুলে দিয়েছিলেন মন্ত্রী বানিয়ে সেই নিজামী-মুজাহিদেরও তো বিচার করেননি। তাহলে পরোক্ষে কি বলতে চান ওরা যুদ্ধাপরাধী ছিল না। ওদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়ার কথা বলেছেন। আপনিও তো ওদের বিচার করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে পারতেন, তাদের দেননি কেন? আর এখন যে বিচার হচ্ছে, তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে এত যে আইনজ্ঞ তাদের হয়ে কথা বলছেন, তারা তাহলে কি করছেন? তারা কি নিজেদের গল্প শোনাচ্ছে বিচারালয়কে? আবদুর রাজ্জাক তাজুল ইসলামসহ অগণিত আইনজীবী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাঁড়িয়ে তাদের পক্ষে রীতিমতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছেন। সাক্ষী সাবুদ হাজির করছেন। সাক্ষীরা কার পক্ষে কথা বলছে তাহলে? আচ্ছা খালেদা জিয়া আত্মপক্ষ সমর্থনের বড় কৌশলী আব্দুর রাজ্জাক ছুটি নিয়ে বিদেশ গেলেন, তারপর ফিরলেন না কেন?... আত্মপক্ষ সমর্থন কাকে বলে? পক্ষের উকিল আছেন, সাক্ষীরা দাঁড়াচ্ছে। ট্রাইব্যুনালের রায় চ্যালেঞ্জ করে আপীল করার সুযোগ পাচ্ছে। আপীলে রায় বহাল থাকলে আবার রিভিউ করার সুযোগ পাচ্ছে। তারপরও যদি রায় বহাল থাকে, তাহলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করতে পারছেন। যদিও আইনে সেই বিধান নেই। বিশ্বের নানা দেশে যে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে তাতে কোন আপীল-রিভিউ বা ক্ষমার কোন বিধান নেই। অথচ এরা সবকিছুই পাচ্ছেন, তাহলে আর কার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ চান খালেদা জিয়া? তিনবারের প্রধানমন্ত্রী কি এ সব প্রশ্নের জবাব দেবেন? তাকে যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নোংরা ভাষায় গালমন্দ করেছিল, তাকেই তো খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক পরামর্শদাতা এবং ওআইসির সেক্রেটারি জেনারেলের পদে প্রার্থী করেছিলেন বাংলাদেশের। সেই সাকা চৌধুরীর তাদের দলের কি প্রতিক্রিয়া? কেন দলের লোকজন উৎফুল্ল হয়েছেন সাকার ফাঁসি হওয়ায়। আহারে যুদ্ধাপরাধী! তোমাদের জন্যই তো খালেদা জিয়া ক্যান্সার আক্রান্ত শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে রাজপথে ফেলে দিয়েছিলেন। তখন কোন্ যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে এই ন্যক্কারজনক কাজটি করেছিলেন? শহীদ জননীকে শারীরিক নির্যাতন করেছিলেন কোন্ যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচাবার জন্য? খালেদা জিয়া ড. আহমদ শরীফ, প্রফেসর কবীর চৌধুরী, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, গাজীউল হকসহ কতজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দিয়েছিলেন, মনে আছে কি খালেদা জিয়া আপনার? তাহলে আজ যেসব কথা বলেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে কি আপনার বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা উচিত নয়? খালেদা জিয়া যে প্রশ্ন তুলেছেন, এগুলো ৪০ বছর আগেই মীমাংসা হয়ে গেছে। এগুলো এতদিন পরে কেন নতুন করে উস্কানি দিচ্ছেন? সত্যিই আপনি ‘পাকিস্তান প্রেম’ আজও ভুলতে পারেননি! ভুলতে পারেননি বলেই ব্রিগেডিয়ার জানজুয়া যখন মারা যায়, তার মৃত্যুতে শোক বিহ্বল হয়ে আপনি তো প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল ভেঙ্গে ‘বন্ধুর জন্য’ শোক বার্তা পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ হেসেছেন আর পাকিস্তানীরা বিব্রতবোধ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কী অবমাননা! দেশবাসী ও রাষ্ট্র নিমজ্জিত হয়েছিল লজ্জায়। যাক, সেই সব পুরনো কাহিনী। তবে আপনার মানে খালেদা জিয়ার এই দলীয় মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে যে ‘মুক্তিযোদ্ধা’দের নাম দেখলাম বক্তা হিসেবে তাদের তো খুব ভালো করেই চিনি, আজ থেকে বহু বছর আগে থেকেই। কী ‘অসাধারণ’ অবিশ্বাস্য আদর্শিক পরিবর্তন! ভাবতে অবাক লাগে। একজন তো খোদ অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি করতেন এবং সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আরেকজনকে দেখলাম তিনি তো মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবা দেয়ার ব্যাপারে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন। সভাপতিত্ব যিনি করছিলেন তিনিও আওয়ামীবিরোধী ব্যক্তি, কিন্তু এঁরা কি করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধের একটি যুদ্ধাপরাধীদের মিত্র দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে পারলেন। কোন পক্ষ অবলম্বন না করে অথবা কোন দলে যোগ না দিয়েও তো সরকারের বা বিরোধী দলের সমালোচনা করা যায়। কিন্তু এঁরা তা করতে ব্যর্থ হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের দলের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন। আরেকজনকে দেখলাম, আজও ভারপ্রাপ্তই রয়ে গেছেন। কত পরীক্ষা পার হয়ে গেলেন, জেল খাটছেন বার বার, আজ পর্যন্ত বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্বকে উৎরে মহাসচিব হতে পারলেন না। এখনও খালেদা জিয়ার করুণা প্রার্থী হয়ে মেননপন্থী বামের সংগঠক এবং সাংস্কৃতিককর্মী হওয়া সত্ত্বেও মান্নান ভুইয়ার পরিণতির দিকে এগুচ্ছেন।... যাদের দলের মধ্যে আজও খালেদা জিয়ার ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ হওয়া সম্ভব হয়নি, তারাই ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছেন। তবু করুণা প্রার্থনার শেষ নেই। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বলেছিলেন, এবারে সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবে মুজিবর। তারপর সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়েছিল তাঁকেই প্রধান করে। সিপিবি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন সম্মিলিত গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। চীনাপন্থীদের মধ্যে একাত্তর নিয়ে মতান্তর থাকায় কাজী জাফর-মেনন, রণো এবং বাশার ও দেবেন শিকদারদের কমিউনিস্ট সমন্বয় কেন্দ্র গঠিত হয়েছিল। তারাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এসব ইতিহাস খালেদা জিয়া জানেন কিনা জানি না। জানবেন কি করে, কোনদিন তো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ছিলেন গৃহবধূ। হঠাৎ করেই এদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে স্বামীর পথ অনুসরণ করে নেমে পড়লেন মাঠে। কোন পারিবারিক বারণের তোয়াক্কা করলেন না। পরামর্শদাতা যাঁরা ছিলেন, তাঁরা তাঁকে উসকে দিয়ে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার পুতুলে পরিণত করলেন। কিন্তু এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কিছুটা পরিচিতি পেয়ে গেলেন। তারপর ক্ষমতা পেয়ে গেলেন হাতে, আর কে পায় তাকে। রাজনীতির সবক নেয়ার আগেই খালেদা ক্ষমতায় বসে পড়লেন ব্যস। তিনি রানী হলেন বাংলাদেশের। চাটুকার জুটে গেল। গড়ে উঠল দল। সেই থেকে যে স্বামীর নির্দেশ অমান্য করে পাকিস্তানীদের সঙ্গে খালেদা থেকে গিয়েছিলেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাকেই পাল্টে দেয়ার মতলব আঁটলেন। দাবি করে বসলেন জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। প্রবল প্রতিবাদ উঠল। যে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বাঙালী সৈন্যরাও এ লড়াইয়ে দেশবাসীর সঙ্গে আছে, সেটা ঘোষণা দেয়ার জন্য একজন সিনিয়র অফিসারকে খুঁজছিলেন বেতার কর্মীরা, তখন বেলাল মোহাম্মদ ও মাহমুদ হাসান পটিয়ায় মেজর জিয়া আছেন জানতে পেরে তার কাছে যান নিয়ে আসার জন্য। তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। বেলাল তাঁকে বুঝিয়ে নিয়ে এলেন। কিন্তু তিনি উল্টো বুঝে এই সুযোগটা ব্যবহার করতে ‘বিপ্লবী’ শব্দটা বাদ দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিজেকে ‘অস্থায়ী সরকারপ্রধান’ ঘোষণা করে ঘোষণা দেন। মেজর জিয়া ভেবেছিলেন এই সুযোগ আর্মি ক্যু করে ফেলবেন এবং নিজেই সরকারপ্রধান হবেন। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া খুবই খারাপ হলো। ১৯৫৮ সালের আর্র্মি ক্যু’র প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানের শিল্পমন্ত্রী আবুল কাশেম খান শুনে বলেছিলেন, ওকে গিয়ে বল, এটা আর্মি ক্যু নয় রাজনৈতিক যুদ্ধ। তখন মেজর জিয়া ২৭ মার্চ ১৯৭১ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বাংলার স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। তিনি ইংরেজীতে লিখেছিলেন অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ অনুবাদ করে বলছিলেন আর আবুল কাশেম সন্দ্বীপ তা লিখে মেজর জিয়াকে দিয়েছিলেন পড়তে। মেজর জিয়া সেটাই পড়েছিলেন ‘মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। বাংলার সংবিধানের ও সেই স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুরই নামে মুুদ্রিত রয়েছে। একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী নেতার কেন্দ্রের ৬ জন ইতোমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন কিন্তু আমিনুর রহমান, আব্দুল্লাহ আল ফারুক, আবম শারফুজ্জামান ও রেজাউল করিম চৌধুরী এখনও বেঁচে আছেন। তাছাড়া অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদ অসুস্থ, এখনও বেঁচে আছেন। ইতিহাসকে বিকৃত করে জিয়াকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বানিয়ে ‘রাজনীতির পুঁজি’ হিসেবে ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। কারণ মেজর জিয়া যখন জেনারেল জিয়াউর রহমান তখন তিনি ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ পত্রিকায় যে লেখাটি লিখেছিলেন, সেটি তো এখনও পাওয়া যায়। জিয়া কি লিখেছিলেন, তা পড়লেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা কি তা বোঝা যাবে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের মিলনায়তনের সমাবেশে জিয়ার স্ত্রী খালেদা বলেছেন, মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। কী অকাট্য ‘সত্য’ উচ্চারণ? খালেদা জিয়া আসল টেপটা থেকে ‘অন বিহাব অব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দি গ্রেট লিডার অব...’ মুছে ফেলে দিলেই কি ইতিহাস মুছে যাবে? বিবিসি, ভোয়া, আকাশবাণী, মস্কো রেডিও, রেডিও অস্ট্রেলিয়ার আর্কাইভে তো ঐ ঘোষণা পাঠের ধ্বনি সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলোকে কি করবেন? এসব তো আর মুছে ফেলতে পারবেন না। খালেদা জিয়া আর তার ভারপ্রাপ্ত চেলাচামু-ারা চিৎকার করলেই ইতিহাস পাল্টে যাবে না। আরেকটি কথা, মুক্তিযুদ্ধ কোন হঠাৎ করে হয় না। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়ই একটি জাতির জীবনে চূড়ান্ত লড়াই হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ আসে। মেজর জিয়া কোন্ রাজনৈতিক লড়াইয়ে ছিলেন? কোন দিনও তো এমন সংগ্রামের কথা ভাবতেও পারেননি। বরঞ্চ এসব সংগ্রামকে দমন করাই ছিল তাঁদের সৈন্য স্বভাব। উল্টো জিয়া তো চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়েছিলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্দেশে সোয়াত জাহাজ পাকিস্তান থেকে বি-ইনফোর্সমেন্ট ও গোলাবারুদ খালাস করতে। বন্দরে যেতে গিয়ে তো বন্দর শ্রমিকদের ব্যারিকেডে বাধা পেয়ে ওদের সামরিক বাহিনীর খিস্তি খেউর করছিলেন এবং সঙ্গে বাঙালীর সেনাদের ঐ বাধা অপসারণের হুকুম দিয়েছিলেন। এরই মধ্যে বন্ধু সেনা অফিসারের কাছে খবর পেলেন ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে তুলে নিয়ে গেছে ঢাকায় আর বাঙালী জোয়ানদের ডিসআর্স করা হচ্ছিল। শুনে জিয়া তো তাঁর লোকজন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। গ্রামবাসী তাঁকে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন বলে পটিয়ায় থেকে গেলেন। তারপর খোঁজ পেয়ে বেলাল মোহাম্মদ অনেক বলে-কয়ে তাঁকে কালুরঘাট ট্রান্সমিশন ভবনে নিয়ে গেছিলেন। তাও প্রথমে বিপ্লবী বেতারের কর্মীদের তাঁর সৈন্যদের দ্বারা ঘিরে ফেললেন। শোনা কথায় কান দিয়ে ভেবেছিলেন এরা বেতার চালু করতে চায় না। পাকিস্তানী বোমাবর্ষণে ট্রান্সমিশন ভবনটি ধ্বংস হলে বুঝতে পারলেন বেলালরাই আজ মুক্তিকামী বেতার যোদ্ধা। তখন অবশ্য তাদের সাহায্য করেছিলেন তিনি একটি ৪ ব্যান্ডের সিঙ্গার ট্রান্সমিটার দিয়ে, মনিটরিংয়ের জন্য। তাঁরই ছেলে তারেক রহমান ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ লন্ডনের এক হোটেলে বলেই বসল, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেন আমাদের নেতা শহীদ জিয়াউর রহমান। লন্ডনে ১/১১-এর বস্তাবন্দী পেটাইয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে পলাতক আসামি এখন ঐ তারেক। ওখানে পলিটিক্সের যে কোচিং নিচ্ছে তাতে এমন উচ্চারণ অসম্ভব নয়। চলবে... লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×