ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাঁধভাঙ্গা উল্লাস আকাশে বর্ণিল আলোকচ্ছটায় ঢাকাবাসীর বর্ষবরণ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২ জানুয়ারি ২০১৬

বাঁধভাঙ্গা উল্লাস আকাশে বর্ণিল আলোকচ্ছটায় ঢাকাবাসীর বর্ষবরণ

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ঘড়ির কাঁটায় বারোটা, ঠিক তখনই মুহূর্তের মধ্যে রঙিন হয়ে ওঠে ঢাকার আকাশ। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে রংবেরঙের আতশবাজি। অন্যরকমের ওই আলোকচ্ছটায় অনেকের অভিব্যক্তি ‘ঢাকার আকাশে পূর্বের কোন বর্ষবরণে এমন ফানুস ও আতশবাজির রঙ ছড়িয়ে পড়েনি! নতুন বছরের প্রথম প্রহর যেন এক বিস্ময়ের, নবোৎসব আর আনন্দের।’ চারদিকে ছড়িয়ে পড়া ওই রঙিন আলোতে তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষ মেতে ওঠেন প্রথম প্রহরকে স্মরণীয় করে রাখতে। কেউ কেউ উঠে আসে নিজ বাসার ছাদে। সবার চোখে যেন এক রঙিন আলো, নতুন স্বপ্ন-রাশি রাশি প্রত্যাশা। থেমে থেমে পটকার আওয়াজ আর আতশবাজির আলোতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে জানাতে থাকে বর্ষবরণের শুভেচ্ছা। ঢাকার আকাশ ছেয়ে যায় ঝাঁকে ঝাঁকে ফানুসে বাঁধভাঙ্গা আনন্দে ঢাকার রাস্তায় নামে মানুষের ঢল। টানা কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা আতশবাজির আলোতে নেচে-গেয়ে পুরো দেশ বরণ করে নেয় ইংরেজী নতুন বছর ২০১৬ কে। দেশের বিভিন্ন স্থানে রাতভর চলে বর্ষবরণের উৎসব। সূর্যের নতুন আলোতেও চলে নানা আয়োজন। রাত থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় দলবেঁধে বন্ধুরা মেতে ওঠে নাচ আর গানে। বছরের প্রথম দিন ঢাবি ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় সমমান প্রতিটি ক্যাম্পাস ছিল উৎসব আর আড্ডামুখর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বন্ধুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বর্ষবরণের উৎসবে মেতে ওঠে সব বয়সী মানুষ। বন্ধু, পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ফ্রেমবন্দী হয়ে জানান দেয়া হয় উৎসবের। নতুন বছরের প্রথম সেলফিও আপলোড করেন অনেক ফেসবুকার। বন্ধুরা একে অপরকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাতে থাকেন মোবাইল ফোনে, ক্ষুদে বার্তায়, ফেসবুকে। মধ্য রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আনন্দে মাতোয়ারা তরুণদের ভিড়ে থাকা হাসান মাহমুদ বলেন, নতুন বছরে প্রত্যাশা অনেক। সব কিছু নতুন করে সাজাতে চাই। পুরনো দিনের গ্লানি ভুলে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান কমানোর লক্ষ্যে নানা পরিকল্পনা রয়েছে। মাহমুদের মতো নতুন পরিকল্পনায় বিশ্বাসী অনেকেই। ভিড়ের মধ্যে থাকা ঢাকা কলেজের ছাত্র রনি বলেন, ‘সারাটা বছর যেন ভালভাবে কাটাতে পারি সেটাই মূল লক্ষ্য। কী পেলাম, কী হারালামÑ তা না ভেবে নতুন করে স্বপ্ন দেখছি। এ বছর যেন উৎসব আর অনন্দে মেতে থাকতে পারি, একই সঙ্গে মাস্টার্স শেষ করেই যেন ভাল একটা জব পেয়ে যাই।’ তবে তানিম নামে একজন বলেন, নতুন বছরে জঙ্গীবাদ মুক্ত বাংলাদেশ চাই। পুরনো বছরের উগ্রবাদের আগ্রাসন যেন বন্ধ হয়। রাজধানীর আকাশে উড়তে থাকা ফানুস, পটকার শব্দ আর আতশবাজির রঙে রুম থেকে বেরিয়ে বাসার ছাদে বর্ষবরণের উৎসবে মেতে ওঠে ঢাকাবাসী। প্রতিটি বাসার ছাদে চলে ছবি তোলার উৎসব। শাহীনবাগের বাসিন্দা হিমেল হিমু নামে এক তরুণ জানান, ‘দুই ঘণ্টাব্যাপী তাকিয়ে ছিলাম ঢাকার আকাশে। আমার জীবনে এর পূর্বে এমন আতশবাজি আর দেখিনি। ওই রঙিন আলোতেই আমরা একে অপরকে বর্ষবরণের শুভেচ্ছা জানাই। পাশের বাসার ছাদে ছাদে শিশু থেকে শুরু করে নানা বয়সী মানুষ মেতে ওঠে উৎসবে। থেমে থেমে মোবাইল ক্যামেরার ফ্লাশ জ্বলতে দেখা যায়। এতেই বোঝা যায় তারাও মেতে উঠেছে সময় বন্দীর নেশায়।’ মহাখালীতে কথা হয় সুমন নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের সঙ্গে। বর্ষবরণের উৎসবে যোগ দিতে টিএসসিতে যাচ্ছিলেন বাসে চড়ে। তিনি বলেন, পরিকল্পনা অনেক। তবে এবার উৎসব আয়োজনে বেশ কড়াকড়ি। দেখা যাক কতটা আনন্দ করা যায়। বর্ষবরণের উৎসবে নিরাপত্তা বজায় রাখতে সজাগ ছিল নিরাপত্তা বাহিনী। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকেই গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বসানো হয় একাধিক চেকপোস্ট। পথচারীদের থামিয়ে চলে তল্লাশি। নিরাপত্তা জোরদার করা হলেও উৎসবের রঙে তার কোন প্রভাব পড়েনি। ফার্মগেট মোড়ে কথা হয় তেজগাঁওয়ের বাসিন্দা সোহেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, নিরাপত্তার খাতিরে নানা স্থানে চেকপোস্ট বসলেও তা উৎসবের রঙে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। নতুন বছরে নানা প্রত্যাশা নিয়ে নতুন করে জীবনের ছক কষছি। ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেল অভিজাত ক্লাবসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ভবন, বাসা বাড়ি ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। বৃহস্পতিবার রাতের রঙিন আলোকসজ্জা সবার নজর কাড়ে। এমন উন্মাদনার মধ্যে অনেকেই ভি চিহ্ন দেখিয়ে নতুন বছরকেও স্বাগত জানিয়েছেন। এছাড়া পুরনো দিনের গ্লানি ভুলে প্রথম প্রহরে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, ডিওএইচএসসহ সারাদেশে আতশবাজি চলে। হাজারো রকমের আলোকসজ্জা আর রঙিন আতশবাজিতে ঢাকার আকাশ সাজে অপরূপ সাজে। চারদিকে শুরু হওয়া বিচ্ছিন্ন পটকাবাজির আওয়াজে কোনরূপ আতঙ্কের সৃষ্টি না হয়ে তা হয়ে ওঠে উৎসবের অংশ। রঙিন আলোর ঝলকানিতে খানিক সময়ের জন্য হলেও বিভোর হয়ে যায় সবাই। ভুলে যায় পেছনের কথা। মন থেকে মুছে ফেলে পুরনো বছরের দুঃখ-গ্লানি। নতুন করে কর্মপরিকল্পনায় মেতে ওঠে তারা। প্রথম প্রহরেই শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে এসে উল্লাস প্রকাশ করে, চলে নাচ আর গান। যে কোন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে বর্ষবরণের পুরো আয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে ছিল বিশেষ উদ্যোগ। ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও যে কোন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে নেয়া হয় নিরাপত্তামূলক কৌশলী ব্যবস্থা। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেন। এছাড়া কূটনীতিকপাড়ায় ছিল নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রাস্তায় রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। উঁচু ভবনগুলোর ছাদে ওয়াচ টাওয়ার বসিয়ে চারদিকে তীক্ষè নজর রাখা হয়। যানবাহন চলাচলেও ছিল নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা। বর্ষবরণের প্রথম প্রহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বাদ্যের তালে তালে নেচে-গেয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়।
×