ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জীবনের শেষ প্রান্তে স্বীকৃতি চান সুরবালা

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২ জানুয়ারি ২০১৬

জীবনের শেষ প্রান্তে স্বীকৃতি চান সুরবালা

সেদিন ছিল একাত্তরের শ্রাবণ মাসের কোন এক রমজানের দিন, বুধবার। দুপুর গড়িয়েছে কেবল। ফুলপুর উপজেলার বাঘাই গ্রামের গৃহবধূ সুরবালা সিং। এখন বয়স তাঁর ৭৪। প্রতিবেশী বিমলের ঢেঁকিতে ধান ভানছিলেন। ক’দিন ধরে খবর আসছিল-পাকি সেনারা ফুলপুর ঢুকে পড়েছে। এমন খবরে পুরো গ্রাম ছিল পুরুষশূন্য। বউ-ঝিরা ছাড়া বিমলের বাড়িতেও ছিল না কেউ। বিমলের বাড়ির দিকে আসছে পাকি সেনারা খবর রটে গেলে বাড়ির বউ- ঝিরা যে যেভাবে পারল দৌড়ে পালায় ঝোপ-জঙ্গলে। ঢেঁকির শব্দে সেদিন কিছুই টের পাননি সুরবালা আর বিমলের বৃদ্ধ মা। এরই মধ্যে পাকি সেনারা বিমলের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। সঙ্গে ছিল স্থানীয় রাজাকার। ১০/১২ পাকি সেনা দলের দু’জন বন্দুক উঁচিয়ে এগিয়ে যায় সুরবালার দিকে। চিৎকার করার সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে মুখ চেপে ধরে পাকি সেনা। পাঁজাকোলা করে সুরবালাকে নিয়ে যায় বিমলের ঘরে। সেখানে পালাক্রমে নির্যাতনের এক পর্যায়ে সুরবালা জ্ঞান হারিয়ে ফেললে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পাকি সেনারা বিমলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বিমলের বৃদ্ধ মা আর ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা বউ- ঝিরা সন্ধ্যার দিকে সুরবালাকে উদ্ধার করে। সুরবালা জানান, ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বাঘাই গ্রামের শহীদ মৃগেন্দ্র সিংয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। মৃগেন্দ্র দিনমজুরি করতেন, আর সুরবালা করতেন পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ। এভাবেই চলছিল তাদের সুখের সংসার। তাদের ঘরে আসে তিন মেয়ে আর দুই ছেলে। ছোট ছেলে মুক্তির বয়স তখন মাত্র দুই বছর। এ সময়েই ঘটে যায় সুরবালার জীবনের এই করুণ ট্র্যাজেডি। সামাজিক লজ্জা আর ঘৃণায় যখন সুরবালা কাতর, কারও সামনে মুখ দেখাতে পারছিলেন না- আরেক রাতে ঘটে যায় আরও এক ট্র্যাজেডি। সুরবালার নির্যাতনের ঠিক পনেরো দিন পর এক মধ্যরাতে পাকি সেনারা সুরবালার স্বামী মৃগেন্দ্রসহ একই বাড়ির নরেন্দ্র, বিমল, পৃথ্বীশ ও যোগেশকে তুলে তাদের হাত-পা ও মুখ বেঁধে স্থানীয় সরচাপুর ঘাটে নিয়ে যায় পাকি সেনারা। এর কিছুক্ষণ পরই শোনা যায় গুলির শব্দ। পাকি সেনারা সেদিন গুলি করে হত্যা করে সুরবালার স্বামী মৃগেন্দ্র, যোগেশ ও নরেন্দ্রকে। অপর দুজন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বাঁচায়। এই হত্যাকা-ের পরদিন সকালে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে হালুয়াঘাট সীমান্ত পার হয়ে সুরবালা ভারতে চলে যান। কাহিনীর এখানেই শেষ নয়। ভারতের শরণার্থী শিবিরে এক রাতে কলেরায় মারা যায় সুরবালার দুই ছেলে মলিন (৫) ও মুক্তি (২)। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে তিন মেয়েসহ শহীদ স্বামীর বসতভিটায় ফিরে আসেন সুরবালা। ৪৪ বছরেও গণমাধ্যম কর্মী ছাড়া খোঁজ নেয়নি কেউ-অভিযোগ সুরবালার। নির্যাতিতা নারী হিসেবেও পাননি কোন স্বীকৃতি বা সরকারী সহায়তা। এমনকি শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবেও পাননি কোন সাহায্য- সহযোগিতা। তিনি বীরাঙ্গনা-এটাই তার অহঙ্কার। জীবনের শেষ সময়ে সুরবালা কেবল চান বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি। Ñবাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ থেকে
×