ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নির্যাতনের শিকার ১৩ বীরাঙ্গনা

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২ জানুয়ারি ২০১৬

নির্যাতনের শিকার ১৩ বীরাঙ্গনা

পাকিস্তান শাসনামলের শেষের দিকে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল রহিমা খাতুনের। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রহিমা তিন সন্তানের মা। স্বামী ইটভাঁটির শ্রমিক। স্বামী-স্ত্রী কেউ লেখাপড়া জানেন না। ’৭০-এর গণআন্দোলনের মধ্যে রহিমার স্বামী ইটভাঁটিতে কাজ করার জন্য দিনাজপুর গেছেন। কিছুদিন পরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। চারদিকে ধ্বংস স্তূপ আর আগুনের লেলিহান শিখা। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ পালিয়ে গেছে। কিন্তু রহিমা স্বামীর সংসার, বাড়ি-ঘর, সন্তান নিয়ে কোথায় যাবেন? দুই মাস বয়সী কোলের সন্তানকে রেখে বড় দু’জনকে মামারবাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে ভয়ে ভয়ে দিনযাপন করছেন। বাড়ি তাঁর সিরাজগঞ্জ শহরের কোবদাসপাড়া মহল্লায় পানি উন্নয়ন বিভাগের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কাছে। একাত্তরের এক ভর দুপুরে ফাঁকা ঘর পেয়ে পাকহানাদার তার বাড়িতে ঢুকে পড়ে। রহিমা বলেন- “হেরা আমার কোলের মাইয়াডারে কাইরা নিয়া ছুইড়া ফালাইয়া আমার চোখের সামনে মাইরা ফেলে। তারপর- বলেই বর্তমানে ৬২ বছর বয়সী রহিমা খাতুন হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। দীর্ঘক্ষণ সে বাকরুদ্ধ। কীভাবে সেদিনের পাকি হায়েনা ও দেশী রাজাকার বাহিনীর বীভৎস নির্যাতন ও পাশবিকতার কথা বলবেন, তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন- তাঁর দুই মাস বয়সী বাচ্চাকে কোল থেকে কেড়ে নিয়ে এক আছাড়ে মেরে ফেলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার ওপর। কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফেলল রহিমার সম্ভ্রম। কিছুক্ষণ পর রহিমা আর কিছুই জানেন না। চোখ খুইলা দেহি আমার ভাই আইছে আমারে নিবার লিগা। এর কিছুদিন পর দেশ স্বাধীন হয়। বুক ভরে সবাই স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসে স্বামী-সন্তান, ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু আমার স্বামী আর আমারে তুলল না। স্বাধীনতা পেয়ে আমি পরাধীন। স্বামীর কাছে, গ্রামের মানুষের কাছে ধিক্কারের পাত্রী হয়ে সেই থাইকা আমি সমাজচ্যুত, বাস্তুহারা। রহিমা বেগম ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে এখনও মেসে কাজ করে জীবন-জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঘর বলতে কিছু নেই। কোবদাসপাড়া খালের ধারে বিধবা মেয়ের বাড়িতে আশ্রয়। নানা গঞ্জনা সহ্য করেও সারা দিন মেসে মেসে কাজ করে রাতটুকু কষ্টে সেখানেই পার করেন। ছেলে থাকলেও লোকলজ্জায় মায়ের খবর নেয় না। তাঁর সোনার সংসার। স্বামী রিয়াজ আলী ছেড়ে চলে গেছেন। জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিসহ। যুদ্ধের পর আশ্রয় নেন বঙ্গবন্ধুর নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। কাজ করে চলে ছেলেমেয়ের ভরণ-পোষণ। কিন্তু সে সুখও কপালে সয় না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে খালি হাতে বের করে দেয়া হয়। তারপর ঠাঁই হয় মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজের মেয়ে হিসেবে। কাজ করতে নানা বিড়ম্বনায় পড়েন। অনেকেই দেখে বাঁকা চোখে। তবুও জীবন চালাতে নানা গঞ্জনা সহ্য করে মেসে কাজ যোগাড় করে নেন। মাসে মাসে সাফিনা লোহানীর কিছু আর্থিক সহায়তা ছাড়া আর কোন সাহায্য জোটেনি কপালে। স্বাধীনতার ৪৪ বছরের একদিনও শান্তিতে খেতে, পড়তে বা ঘুমাতে পারেননি এই বীরমাতা। রহিমা আক্ষেপ করে বলেন, আজকালের ছেলেমেয়েরা কেমন হয় তা ভালই জানেন। মাঝে মাঝে মনে হয় বাড়ি ছেড়ে কোথাও গিয়ে আশ্রয় খুঁজে নেই। কিন্তু কে দেবে আমায় আশ্রয়? বয়সের ভারে আর কাজ করতে পারি না। তাই জীবনের শেষ সময়ে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিস্বরূপ কার্ড-ভাতা যেন পাই- যা দিয়ে বাকি জীবন কাটাতে পারি। হামিদা বেগম ॥ সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কান্দাপাড়ায় বাস করছেন হামিদা বেগম। যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৫ কী ১৬। কান্দাপাড়া হাটখোলায় অন্যদের সঙ্গে হামিদা ও তার স্বামী আশ্রয় নেন। এক রাতে রাজাকারদের সঙ্গে পাকিস্তানী বাহিনী হানা দেয় তাদের বাড়িতে। হামিদা বলেন, হেরা আমার স্বামীরে টেনে-হিঁচড়ে ঘর থিকা বাহির কইড়া উডানে গাছের সঙ্গে বানল। তার সামনেই আমারে ৪/৫ জন বেইজ্জত করল। সেইডা দেখার পর আমার স্বামী একটা চিক্কুর দিল। এক টুকরো জমি নেই, নেই ঘরবাড়ি। নেই খাবার। নেই ওষুধ কেনার টাকা। তাই দু’মুঠো ভাত আর আর রাতটুকু কাটাতে ছেলেমেয়ে ও সাথী বীরাঙ্গনাদের বাড়িতে ডোগি ডোগি (এক-দু’দিন করে অন্যের বাড়িতে) করে কাটছে বীরমাতা রহিমার জীবন। রাজুবালা ॥ বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। বাড়ি সদর উপজেলার কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া গ্রামে। সংসারে দুই ছেলে এক মেয়ে। কেউ কাছে থাকে না। মন্দিরে মন্দিরে নামকীর্তন অনুষ্ঠানে ডুগি-তবলা বাজিয়ে যা আয় করেন, তা দিয়ে খেয়ে-না খেয়ে এ ঘরেই দিন পার করছেন বীরমাতা রাজুবালা। রাজুবালা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ’৭১ সালের এক দুপুরে তিন পাক-পশু তার বাড়িতে হানা দেয়। কোলের শিশুকে আছড়ে আর বুট দিয়ে পিষে মেরে ফেলে। স্বামীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে বর্বর নির্যাতন চালায়। সন্ধ্যার আগে স্বামী তাকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে আসেন। তার নির্যাতনের সেই ক্ষতচিহ্ন আজো শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে। ক্ষতগুলো চোখে পড়লে সেই ভয়াবহ দিনের কথা মনে হয়, শিউরে ওঠে গা। জীবনের শেষ সময়টুকু মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা নিয়ে পেটপুরে খেয়ে মরতে চান বঙ্গবন্ধুর এই বীরমাতা। আয়মনা বেগম ॥ বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। কানে কম শোনেন। চোখে কম দেখেন। হাতে-পায়ে পানি ধরেছে। ঠিকমতো চলতে পারেন না। বাস করছেন শহরের মতিন সাহেবের ঘাট সংলগ্ন ওয়াপদার ঢালে। চার মেয়ের কেউ কাছে থাকে না। ’৭১-এর স্মৃতিচারণ করে বলেন, যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন এক সন্তানের মা। পাক বাহিনীর ভয়ে পরিবারের সঙ্গে শহরের অদুরে ফকিরপাড়া গ্রামে আশ্রয় নেন। এক দুপুরে ওই গ্রামে পাকবাহিনী হানা দেয়। হানাদার বাহিনী লুটে নেয় তার সম্ভ্রম। বিষয়টি জানাজানির পর স্বামী তাকে গ্রহণ করতে চান না। স্বাধীনতার পর এলাকার মানুষের অনুরোধে স্বামী তাকে গ্রহণ করেন। আছিয়া বেগম ॥ পাকি বাহিনীর নরপশুরা বীরমাতা আছিয়াকে শুধু নির্যাতন করেনি, গুলি করে অঙ্গহানি করেছে। এখনও তার শরীরে ভেতরে গুলি রয়েছে। টাকার অভাবে স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও অপারেশন করে গুলি বের করতে পারেননি। সদর উপজেলার কালিয়াহরিপুর ইউনিয়নের চানপুর গ্রামে অন্যের জায়গায় টিনের ঝুপড়ি তুলে একাকী বাস করছেন আছিয়া বেগম। তিন সন্তানের জননী আছিয়া খাতুন জানান, একাত্তরে তিনি ফ্যামিলি প্লানিংয়ে চাকরি করতেন। একদিন বেতন দেয়ার কথা বলে তাঁকে ও তাঁর সহকর্মী সুখী খাতুনকে সিও অফিসে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। দিনভর দুজনের ওপর চলে নির্যাতন। বিকেলে তাদের পরিচয়পত্র দেখে বাড়িতে রেখে যায়। জয়গুন বেগম ॥ সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে বাস করেন। যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ১৫/১৬ বয়সী। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের কাছে থেকে বড় হয়েছিলেন। ভাই কৃষিকাজ করতেন। প্রতিদিনের মতো সেদিনও তিনি ভাইয়ের জন্য খাবার নিয়ে মাঠে যাচ্ছিলেন। সে সময়ই তার ওপর পড়ে হায়েনার থাবা। সেদিনের কথা জিজ্ঞাসা করতেই জয়গুন বলেন, চার মিলিটারি আমারে টাইনা পাশের বেতঝাড়ে নিয়া গেল। মিলিটারির লগে রাজাকারও ছিল। মিলিটারির একজন আমার বুকের বাঁদিকে এমন কামড় দিল যে মাংস উইঠা আসল। আমি বেহুঁশ হইয়া গেলাম। এরপর আর কিছু বলতে পারেন না। অসহায় ভাইয়ের চোখের সামনে সম্ভ্রমহানি হলো বোনের। মিলিটারিরা চলে গেলে বোনকে উদ্ধার করে ভাই বাড়ি নিয়ে আসেন। হাসিনা বেগম ॥ সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চুনিয়াহাটি বাঐতারা গ্রামের হাসিনা। যুদ্ধের সময় বয়স ছিল ২২ বছর। একদিন কয়েক পাকসেনা হানা দেয় হাসিনার বাড়িতে। তিনি বলেন, পাক বাহিনী ধরার পর আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। জ্ঞান ফিরা দেহি আমার এক দুলাভাই মাথায় পানি ঢালতাছে। হায়েনার দল আমার সব কিছু কাইড়া লইছে। বর্তমানে বীরমাতা হাসিনা বেগম সদর উপজেলার কালিয়াহরিপুর ইউনিয়নের চাঁনপুর গ্রামে অন্যের জমিতে ছাপড়া ঘরে তিন নাতি-নাতনিকে নিয়ে বসবাস করছেন। Ñবাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ থেকে
×