ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর এটি ছিল বেদনাদায়ক অধ্যায়

যুদ্ধনারী ও শিশু ॥ বিস্মৃতির পথে

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২ জানুয়ারি ২০১৬

যুদ্ধনারী ও শিশু ॥ বিস্মৃতির পথে

মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের কত নারী হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিতা হয়েছে কত নারী ধর্ষিতা হয়েছে তার একটা হিসাব আছে। কৃতজ্ঞ জাতি এইসব নারীকে দিয়েছে বীরাঙ্গনার মর্যাদা। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশী দোসর রাজাকারদের ক্যাম্পে যেমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে তেমনই অনেক নারীকে ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়েছে। কোন নারী নির্যাতন সইতে না পেরে মারাও গেছে। যারা বেঁচে গেছে তাদের বেশিরভাগের গর্ভে জন্ম নিয়েছে শিশু। এরা যুদ্ধশিশু নামে পরিচিত। কত যুদ্ধ শিশু এই দেশে আছে আর কত যুদ্ধ শিশুকে বিভিন্ন দেশ দত্তক নিয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এর পাশাপাশি অনেক নারী স্বেচ্ছায় গর্ভপাত করে নিয়েছে। তাদের সংখ্যাও কম নয়। এইসব নারী ও তাদের ওপর নির্যাতনের ফসল যে যুদ্ধ শিশু তার ওপর গবেষণা করেন প্রবাসী বাংলাদেশী লেখক-গবেষক ড. বীনা ডি কস্টা। এই সময় তার পরিচয় ঘটে অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিসের সঙ্গে। ড. জিওফ্রে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে আসেন ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে। যুদ্ধনারীদের অবস্থা জেনে তিনি নির্যাতিতা নারীদের সহায়তায় মাঠে নামেন। বেশ কিছুদিন তিনি এই দেশে ছিলেন। যুদ্ধনারী ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনের জন্য ওই সময়ে বিশ্বের অনেক দেশ, জাতিসংঘসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা কাজ শুরু করে। অন্তঃসত্ত্বা নারী ও তাদের গর্ভে জন্মানো শিশুদের নিয়ে কাজ করতে তারা প্রথমে হোঁচট খায়। এই বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল প্লানড ফাদারহুড, ইউএনএফপিএ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এই কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করে ঠিকই, তবে প্রথম দিকে তারা কেউই এই দায়িত্ব নেয়নি। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত এইসব নারীর পুনর্বাসন খুব সহজ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর দেশগঠন কাজের সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায় ছিল এই বিষয়টি। একই সঙ্গে ছিল মানবতার সবচেয়ে স্পর্শকাতর অধ্যায়। যুদ্ধনারী বীরাঙ্গনাদের বড় দুটি অধ্যায় ছিল ১. যারা গর্ভস্থ শিশু রাখতে রাজি নয় তাদের গর্ভপাত ২. গর্ভের যে সব শিশু জন্মেছিল তাদের বাঁচানো ও পরিচর্যা। ওই সময়ে দেখা যায়, যে শিশুরা জন্মেছে তাদের বেশিরভাগই রুগ্ন ও অপুষ্টির শিকার। এর সঙ্গে আরও একটি কঠিন কাজ ছিল, যুদ্ধ শিশুদের পারিবারিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা। যুদ্ধের বিভীষিকাময় অধ্যায়ের পর হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর রেপ ক্যাম্পগুলো তুলে দিয়ে নারীদের পাঠানো হয় যার যার গ্রামে। এমনও দেখা গেছে স্বামীসহ পরিবারের সদস্যদের হাতে এইসব নারী তুলে দেয়ার পরও স্বামীরা গ্রহণ করেনি। কোন ক্ষেত্রে গ্রহণ করলেও এক সময়ে সেই নারীর লাশ নদীতে ভেসে যেতে দেখা গেছে। খোঁজ করে যে সব বিষয় জানা যায় তা হলো; স্বামী প্রথমে ফিরে নেয়ার পরও স্ত্রীর ওপর অমানসিক নির্যাতন চলেছে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এইসব নারীর কেউ শেষ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আবার অনেককে কৌশলে মেরে ফেলা হয়। এর উল্টো চিত্র আছে। এইসব বীরাঙ্গনাদের উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে ঘরে তোলা হয়েছে। পরিবার থেকে বলা হয়, এই নারীদের তো কোন দোষ ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা যেমন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা এনেছে এইসব নারীকে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নির্যাতন করে কাউকে হত্যা করেছে কারও পেটে পাকিস্তানীদের বীজ ঢুকিয়ে গেছে। যাতে এইসব শিশু তাদের পিতার পাকিস্তানী পরিচয় বহন করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ধর্ষিতা নারীদের কেউ এমন শিশু চায়নি। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে যাদের গর্ভপাতের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যায় এবং গর্ভপাত জীবনের জন্য ঝুঁকি হয়ে পড়ে তাদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। এদেরই পরিচয় যুদ্ধশিশু। ড. ডেভিস তার গ্রন্থে লিখেছেন, তিনি ৩০ সপ্তাহ বয়সের ভ্রƒণের গর্ভপাতের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত থাকায় যুদ্ধনারীদের গর্ভপাতে কোন অসুবিধাই হয় নি। ড. ডেভিস তার অভিজ্ঞতার বর্ণনায় বলেন, যুদ্ধনারীরা নিজেদের উদ্যোগেই গর্ভপাত করাতে আসে। তারা ছিল খুবই শান্ত। গর্ভপাতের সময় কাউকে কাঁদতে দেখেননি। কেউ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভে এমনও বলেছেন ‘ওই হারামজাদা পাকিস্তানী শুয়ারের বাচ্চাকে পায়ের নিচে পিষে মেরে ফেলবো।’ গর্ভপাতের পর তারা জানিয়েছে এই ভ্রƒণকে যেন আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে বাতাসে উড়িয়ে দেয়া হয়। তাদের কথা থেকেই বোঝা যায় কতটা ঘৃণা পাকিস্তানী হানাদার সেনাবাহিনীর ওপর। ড. ডেভিস বলেন, গর্ভপাত করতে আসা এসব নারীর সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, তিনি একা ও তার টিম সামলাতে পারতেন না। গর্ভপাত করানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন কর্মী তৈরির জন্য এক শহর থেকে আরেক শহরে গেছেন। ঢাকা মহানগরীতেই তিনি প্রতিদিন গড়ে একশ’ করে যুদ্ধনারীর গর্ভপাত করিয়েছেন। পরবর্তী সময় দেখা গেছে ঢাকার বাইরেও প্রতিদিন প্রায় একই সংখ্যক নারী গর্ভপাত করিয়ে নিয়েছে। তবে যারা সামর্থ্যবান ছিলেন তাদের কেউ গোপনে কলকাতা গিয়ে গর্ভপাত করিয়ে নিয়েছেন। এই ক্ষেত্রে যে বাধা ছিল তা হলো; গর্ভপাতের অনুমতিপত্র। তবে তা সহজ করে দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব রব চৌধুরী। তিনি একটি ক্ষমতাপত্র দিয়েছিলেন যাতে বলা হয় যুদ্ধনারী সম্মতি দিলে তার গর্ভপাত করানো যাবে। কখনও অনুমতি নেয়া হতো স্থানীয় পুনর্বাসন সংস্থার কাছ থেকে। গর্ভপাতের পর যে সমস্যাটি আসে তা হলো যুদ্ধশিশু। যাদের শিশু জন্মেছিল তারা নবজাতক তুলে দিত পুনর্বাসন সংস্থার কাছে। তারা এইসব শিশু তুলে দিত দত্তক বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সোস্যাল সার্ভিসসহ (আইএসএস) অন্যান্য সংস্থার কাছে। আইএসএস এইসব শিশুদের পাঠাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডা জার্মানি ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে। আবার কোন মা সন্তান নিজের কাছে রাখত। এই সংখ্যা ছিল কম। পরবর্তী সময়ে এইসব শিশুর কি হাল হয়েছে তা আর জানা যায়নি। প্রকাশও পায়নি। তবে একবিংশ শতকে এসে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ঘটনা বিশ্ব ও দেশের কোন কোন মিডিয়াতে আসছে। বাংলাাদেশে বীরাঙ্গনা নারীদের যে সংখ্যা দেয়া হয়েছে তা সঠিক বলেই মনে করেন ড. ডেভিস। এমনও বলেন, হয়ত এই সংখ্যাটি আরও বেশি হবে। মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকেই তা বলেছেন। গর্ভপাত ও প্রসবের পর এই নারীরা বেশ কিছুদিন ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংস্থার অধীনে ছিল। পরে তারা দেশের রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, নোয়াখালী, দিনাজপুর, সিলেটসহ বড় শহরের দিকে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো এই বীরাঙ্গনাদের অনেকে আজও বেঁচে আছেন। যুদ্ধশিশুরাও দেশে দেশে অবস্থান নিয়ে আছে। কালের আবর্তে মক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই দিক হারিয়ে যাচ্ছে। দেশের বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত বীরাঙ্গনা নারীদের ওপর ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ নামে ছবি নির্মাণ করেন। এই বিষয়টি নিয়ে আর কোন ছবি নির্মিত হয়নি। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×