ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

নববর্ষে বাংলার জয় হোক দিগন্ত বিস্তৃত

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ২ জানুয়ারি ২০১৬

নববর্ষে বাংলার জয় হোক  দিগন্ত বিস্তৃত

ইংরেজী নববর্ষে আমাদের দেশে উৎসব হয়। এখন এটা এক ধরনের ক্রেজে পরিণত হয়েছে। বাঙালী হিসেবে আমাদের অবেগের কথা না বলাই ভাল। আমরা এমন এক জাতি আবেগ ছাড়া চলতে পারি না। আবেগ একদিকে যেমন মঙ্গলের, আরেকদিকে ভয়েরও বটে। অপরিমিত আবেগ বা অনিয়ন্ত্রিত আবেগের ফল তো সবসময়ই দেখতে পাচ্ছি। আবেগের মূল জায়গাটাকে নষ্ট করার জন্য মরিয়া আতিশয্যে মজা রাজনীতি ক’দিন আগেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে মাতম করল। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ আক্রমণ। কয়েকদফার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বললেন, এ নিয়ে বিতর্ক আছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চ্যালা-চামু-ারাও লাফ দিয়ে বলল : আছে আছে। ক’দিন এ নিয়ে লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি, তারপর আবার অন্য কোন প্রসঙ্গ। এই আমাদের স্বভাব। বলছিলাম দেশে ইংরেজী নববর্ষ উদযাপনের কথা। যেহারে বা যেভাবে আমরা এই দিনটিকে বরণ করার জন্য প্রস্তুত হতে থাকি সেখানে এখন আশঙ্কা অমূলক নয়। আশঙ্কা যতটা তার চেয়ে পরিবেশ ভারি করার কাজ দ্বিগুণ। সুদূর আমেরিকা থেকেও সতর্ক করা হচ্ছে। গ্লোবালাইজেশনের নামে সঙ্কুচিত দুনিয়ায় যার যেভাবে ইচ্ছে খবরদারি করার কাজটা এখন প্রকাশ্য। দূর দেশের সরকার বা কর্তারা তাদের দেশের মানুষের ভাল-মন্দ বা নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হতেই পারেন। তাছাড়া এ জাতীয় সতর্কতায় আমরাও সাবধান হতে পারি। কিন্তু কথা থাকে, নিজেদের বেলায় কি করছেন তারা? দূরের দুরবিনে আমাদের বিপদ দেখে অস্থির হয়ে ওঠা আমেরিকার নিজের ঘরের খবর কি? তাদের মতো উন্নত দুনিয়ার এক নম্বর নামে পরিচিত দেশে স্কুল শূটিং আর সন্ত্রাসী হামলার সময় তারা কি অন্ধ থাকেন? এটা মানতেই হবে আমরা এখনও মুরব্বিদের কথা না মেনে বা এড়িয়ে চলার জায়গায় পৌঁছুতে পারিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে যে সে জায়গাটায় যাচ্ছি সেটাও স্পষ্ট। আজকের বাংলাদেশ নবীন রাষ্ট্র নয়। ইতোমধ্যে আমরা আমাদের অবস্থান করে নিয়েছি। আমাদের শরীরে এখন সুস্থতা আর উন্নয়নের ঢেউ এসে লাগছে। আজকের বাংলাদেশ অমর্ত্য সেনের ভাষায় ভারতকে নানাভাবে টপকে যাওয়া এক অগ্রসরমান দেশ। এই স্থিতি এই উন্নয়ন একদিনে হয়নি। অতীতের সব সরকারের আমলেই কিছু না কিছু ভাল কাজ হয়েছিল। রাজনীতির কারণে একে অপরের ভালটা স্বীকার করেনি। তবে গত দু’বারের সরকার সময় ও স্থিতি পাওয়ায় উন্নয়ন আলোর মুখ দেখেছে। মাঝখানে আমাদের অতি আবেগ এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেছিল আমরা ধরে নিয়েছিলাম সরকার আসে সরকার পতনের জন্য। মানে সরকার গঠিত হওয়ার কিছুদিন পর নানা অজুহাতে তাকে হটানোর জন্য রাজনীতি মাঠে নামবে আর জ্বালাও-পোড়াও যানবাহন ও মানুষের জীবননাশের ভেতর দিয়ে আবার নির্বাচন হবে। এটা কোন স্বাভাবিক পন্থা নয়। যেসব দেশ আমাদের সতর্ক করে তারা নিজেদের সমাজে এমন কোন অনাচার সহ্য করে না। তাদের দেশে গণতন্ত্র বিষয়টা হেফাজতের। সেটার দেখভাল করে তারপর তারা দল বদলায় বা সরকার পরিবর্তন করে। আমাদের বেলায় উল্টো। নানাভাবে মদদ দিয়ে অভিভাবক সেজে গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক বিরোধ উস্কে দিয়ে তারপর অভিভাবক হিসেবে হাজির হতো তারা। কত কিছু দেখলাম, এদেশ সেদেশ কত দেশের রাজদূতের কত ধরনের দৌড়ঝাঁপ। ব্যাপারটা যেন এমন আমরা এখনও লর্ড ক্লাইভের অধীনে। আমরা নিজেরা নিজেরা ঝগড়া করব আর তারা নিনিয়ান বা মজিনা বা পঙ্কজ হয়ে আমাদের উদ্ধার করবেন। এক দেশের রাজদূতরা তো মুক্তিযুদ্ধের সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের আশ্রয় নিতেও কসুর করেন না। এসব এখন সবাই জানেন, জাতিও বুঝে গেছে। মজিনা সাহেব যাবার পর দেশের সমস্যার পঞ্চাশ শতাংশ যেন অটোমেটিক কমে গেছে। ভদ্রলোক রিকশা চালিয়ে চাষীদের বাগানে গিয়ে হাতে আলু মুলো ঝুলিয়ে এমন ভাব করতেন যেন তিনি না থাকলে এদেশ চলবে না। চতুর সাহেব বুঝেছিলেন তেলে-ঝোলে থাকতে হলে মাঝে মাঝে সরকারবিরোধী হতে হবে। আজ যখন তিনি নেই আমাদের দেশ কি ভালা চলছে না? বাংলাদেশ এখন তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে ব্যস্ত। ঘোর আওয়ামীবিরোধী হাসিনার শত্রুও স্বীকার করেন অভাব নেই। সমস্যা কমছে। মানুষ খেয়ে-পরে আনন্দে আছে। কিন্তু তাদের একটাই অভিযোগ গণতন্ত্র নেই। আসলে যদি গণতন্ত্রের জন্য মায়া থাকত তারা উদার ও আদর্শে বাংলাদেশকে ধারণ করতেন। গণতন্ত্র মানে কি ইচ্ছেমতো ইতিহাস বিকৃতি? গণতন্ত্রের মানে আমাদের জাতীয় বীর ও শহীদদের নিয়ে মিথ্যাচার? ইচ্ছে হলে পাকিস্তানী ভাবধারায় প্রত্যাবর্তন? একটা বিষয় মাথায় ঢোকে না পাকিস্তানের মতো সবদিক দিয়ে ভঙ্গুর একটি দেশের বাস্তবতায় ফেরার জন্য আমাদের এই আকুলতা কেন? ধর্ম যদি ফ্যাক্টর হয়তো আমরা আরব আমিরাত, কুয়েত বা তেমন দেশগুলোকেও অনুসরণ করতে পারি। তারা সব ঝুটঝামেলা ফেলে তরতর করে এগিয়ে চলেছে। আসলে সেটা নয়, মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় আর ভারত বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িকতাই এদের পাগল করে রাখে। কিন্তু লাভ নেই। এখন মানুষ আর বোকা নয়। শেখ হাসিনার ইমেজের ওপর কালিমালেপনের সব চেষ্টাই বৃথা গেছে। তার বলিষ্ঠতা আর শক্তিতে যুদ্বাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত হওয়ার পর তার ইমেজে যোগ হয়েছে নতুন পালক। যারা তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন তারাও এখন বলছেন তিনি না থাকলে এ জঞ্জাল আজীবন টানতে হতো। নববর্ষে আমাদের দেশের সামনে এখন অনাগত সুন্দর ভবিষ্যতের হাতছানি। বিশ্বাস করুন যারা দেশের ভেতরে আছেন তারা দেখলেও হয়ত বুঝতে পারছেন না। আমরা দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি পরিবর্তনের মহতী ঢেউ এসে দোলা দিচ্ছে। আজকের বাংলাদেশের মানুষ আমার মতো এক হাজার ইউএস ডলার সঙ্গী করে দেশ ছাড়ে না। আজ তারা আমাদের মতো জামা কাপড় পরে বিদেশে আসে না। আমাদের মতো তাদের ইংরেজী শেখার ক্লাসও করতে হয় না। আমি যেখানে কাজ করি সেখানে পরীক্ষা দিতে আসা বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরা পোশাকে আচরণে ভাষায় উপমহাদেশের কোন দেশের সন্তানদের পিছনে নয়। বরং ভারত পাকিস্তানের চাইতে এগিয়ে। আজ দুনিয়ার দেশে দেশে বাংলাদেশী পণ্যের সমারোহ। এদেশের বড় বড় স্টোরে কাপড় জামার ভাগে মেড ইন বাংলাদেশ জ্বলজ্বল করছে। আনাজ মসলা মাছ এমনকি ওষুধের বেলায়ও বাংলাদেশের বিস্তার চোখে পড়ার মতো। কলকাতার টিভি অনুষ্ঠানের স্পন্সর আমাদের দেশের কোম্পানি। আমাদের প্রতিযোগীরা সমানে পাল্লা দিয়ে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে। এ এক আরেক বাংলাদেশ। খাম্বা বাবা আর হাওয়া ভবনের অন্ধকার গলি থেকে মুক্তি দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি চিরদিন থাকবেন না। তার দলও চিরকাল গদিতে থাকবে না। কিন্তু আজ যারা নিন্দা ও বিরোধিতায় মুখর একদিন তারাই এ সময়কালের প্রশংসায় মাতবেন অথবা নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হবেন। কারণ দুর্নীতি সন্ত্রাস আর দলবাজির পরও দেশের উন্নয়ন টিকেছে ধারাবাহিক সরকার কাঠামো ও শাসনে স্থিরতা আছে বলে। গণতন্ত্রের নামে তাকে ধ্বংস করা বা দেশকে অস্থিতিশীল করা কি আসলেই জায়েজ? নতুন বছরে বাংলাদেশ কতদূর এগোবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। সামনে যে গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ তা মোকাবেলার মতো শক্তি ও তারুণ্যের মেধা দিয়ে গড়ে উঠুক নতুন নির্মাণ। জয় বাংলার জয়যাত্রা হোক দিগন্ত বিস্তৃত।
×