ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

অনিশ্চয়তা ও সম্ভাবনার বছর ২০১৬

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ১ জানুয়ারি ২০১৬

অনিশ্চয়তা ও সম্ভাবনার বছর ২০১৬

কে হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আগামী নবেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস নির্বাচন বেশ জমজমাট হবে। দলীয় প্রার্থিতার জন্য রিপাবলিকানদের মধ্যে এখন যাদেরই দাপট দেখা যাক শেষ পর্যন্ত বড় বড় ডোনার ও দলের পাওয়ার ব্রোকারদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকেই বেছে নেয়া হবেÑ যেমন মার্কো রুবিও। ওদিকে ডেমোক্রেটদের মধ্যে হিলারি ক্লিনটনের প্রার্থিতা লাভের সম্ভাবনা প্রবল। তবে আসল নির্বাচনে চূড়ান্ত ফলটা নির্ভর করবে এমন বিষয়ের ওপর যার ওপর কোন প্রার্থীরই নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। একটা কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পরপর দু’বার হোয়াইট হাউসে কাটানোর পর তৃতীয়বার জয়ী হওয়া কোন দলের জন্য চাট্টিখানি কথা নয়। আর ডেমোক্রেটদের এখনকার অবস্থা রিপাবলিকানদের চাইতে কোন অংশে ভাল নয়। বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে ২০১৬ সালে মার্কিন অর্থনীতির পুনরুদ্ধার মার খেলে ডেমোক্রেটরা হারবে। আর অর্থনীতি ধীরগতিতেও যদি চলতে থাকে তাহলে হিলারি অল্প ব্যবধানে জিততে পারেন। তবে আপাতত যেসব পূর্বাভাস মিলছে তাতে মার্কিন জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ২.৫ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতির হার হবে ১.৭ শতাংশ। সুদের হার বাড়বে। এ অবস্থায় হিলারি সম্ভবত পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন। তবে কংগ্রেসে সম্ভবত: রিপাবলিকান প্রাধান্য বজায় থাকবে। চীন প্রভাব বাড়াতে চাইবে চীনে ডাবল ডিজিটের প্রবৃদ্ধির দিন শেষ হলেও বেশিরভাগ নাগরিক জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান মান ভোগ করতে থাকবে। ২০১৬ সাল হবে চীনের অর্থনীতির সংস্কার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বছর। এ সময় চীন রফতানি আয় বৃদ্ধির ও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়বে। প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাবেন। তাইওয়ান ও হংকংয়ের সঙ্গে চীনের মনকষাকষি হতে পারে। এ বছর চীনে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। বিজ্ঞানচর্চায় চীনের অগ্রগতি হবে। এবছর চীন তার দ্বিতীয় মহাকাশ স্টেশন তিয়াংগং-২ মহাকাশে পাঠাবে। বহির্বিশ্বের কাছে বহুলাংশে অপরিচিত কিছু কিছু নগরী যেমন গুইইয়াং, জিয়াংইয়াং ও হেংইয়াংয়ের ব্যাপক উন্নতি হবে। চীনের সার্বিক প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে থাকলেও এসব নগরীর প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। রাশিয়ায় স্থবিরতা থাকবে তেলের স্বল্পমূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, পশ্চিমা অবরোধ ইত্যাদির কারণে এ বছরও রাশিয়ার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে চলবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়াবে। মুদ্রাস্ফীতির হার এখন চলছে ১৫ শতাংশ। জনসেবা ব্যবস্থা ও জীবনযাত্রার মান হ্রাস পাবে। ইউক্রেন ও সিরিয়া ইস্যুতে পুতিন বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাওয়ার-ব্রোকার হয়ে দাঁড়ালেও রুশ অর্থনীতি দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতায় আটকে থাকবে। বিদেশে রুশ শক্তির পুনরুত্থানে জনগণ এতদিন জাতীয়তাবাদের জোয়ারে ভাসলেও এখন তাদের দৃষ্টি পণ্যমূল্যের ওপর স্থানান্তরিত হচ্ছে। এতে করে তাদের অসন্তোষ দেখা দেবে। প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে উত্তেজনা বাড়বে। এ অবস্থায়ও পুতিন তার সামরিক পেশীশক্তি দেখিয়ে চলবেন। দেশে তিনি শুদ্ধি অভিযান চালাবেন। সিরিয়ায় রাশিয়া আটকা পড়ে যেতে পারে। বাল্টিক অঞ্চলে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। ভারত এবারও চীনকে ছাড়াবে নরেন্দ্র মোদির সরকার লোকসভায় স্বস্তিদায়ক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভোগ করলেও রাজ্য সভায় তার বিরুদ্ধে শক্তির প্রাধান্য থাকবে। এই অবস্থায় ব্যবসামুখী সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি ব্যহত হবে। তথাপি জিডিপির প্রবৃদ্ধির দিক দিয়ে ভারত টানা দ্বিতীয় বছরের মতো চীনকে ছাড়িয়ে যাবে। প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭.১ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতি হবে ৫.৯ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক থাকবে উষ্ণ তবে সেটা রাশিয়ার সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী আতাঁতের বিনিময়ে নয়। আগের সরকারের সময় স্থবির হয়ে থাকা বড় ধরনের বেশ কিছু অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে অর্থনীতিতে তেজীভাব আসবে। প্রায় বিলুপ্তির মুখে দাঁড়াবে কংগ্রেস ভারতের কংগ্রেস দল ২০১৬ সালে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রায় বিলুপ্তির মুখে দাঁড়াতে পারে। এ বছরের মাঝামাঝি বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, তামিলনাড়ু ও কেরালার মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হবে যার কোনটিতেই কংগ্রেস জয়ী হতে পারবে না। অন্যান্য রাজ্যসভা নির্বাচনেও দলটি সম্ভবত পরাজিত হবে। তাতে দলে ভাঙ্গন না ধরলেও এ বছর জাতীয় রাজনীতিতে দলটি কার্যত: অস্তিত্বহীন সত্তায় পরিণত হবে। পাকিস্তান ॥ বিপন্ন নিরাপত্তা পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা থাকবে নামে মাত্র। বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী, উপজাতীয় এলাকায় তালেবানী তৎপরতা, বড় বড় শহরে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম, দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির মধ্যে টানাপোড়েন ইত্যাদির কারণে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। পাক-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা চলবে। তবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কিছু উন্নতিও হতে পারে। অর্থনীতির প্রসার ঘটলেও জ্বালানি সঙ্কট ও দুর্বল ব্যবসায় পরিবেশে প্রবৃদ্ধি হোঁচট খাবে। জিডিপি বাড়বে ৪.৮ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতির হার হবে সাড়ে ৫শতাংশ। সৌদি-ইরান সম্পর্ক আঞ্চলিক নেতৃত্ব নিয়ে ইসলামী বিশ্বের দুই প্রধান শক্তি সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা এ বছর আরও কদর্য আকার ধারণ করতে পারে। কিন্তু এমন সম্ভাবনাও আছে যে এই বৈরী দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্কের কিছু উন্নতি হবে। একটা জটিল ধরনের সমঝোতায়ও পৌঁছতে পারে দেশ দুটি। ফিলিস্তিন প্রশ্ন চাপা পড়বে একদা মধ্যপ্রাচ্যের জ্বলন্ত সমস্যা ফিলিস্তিন প্রশ্নটি নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে। ২০১৬ সালেও তা গৌণ সমস্যাই হয়ে থাকবে, যদিও মাঝে মাঝে সহিংস রূপ নিয়ে জ্বলে উঠতে পারে। আবার সরকারগুলোর পতন, আইএস-এর উত্থান, সিরিয়া ও ইয়েমেন পরিস্থিতির মতো আরও জটিল সমস্যার কারণেই ফিলিস্তিন সমস্যাটা ধামাচাপা পড়ে গেছে। ইসরাইলী জেনারেলরা এটাকে কিছু সময় তাদের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি হিসেবে দেখবে। উদ্বাস্তুর জোয়ার চলবে যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানিতে গত এক বছর সারা বিশ্বে বাস্তচ্যুত হয়েছে ৬ কোটি লোক। প্রধানত: মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ এ জন্য দায়ী। চলতি বছরও এদের সংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশ থেকে আশপাশের দেশে এমনকি ইউরোপে শরণার্থীর জোয়ার অব্যাহত থাকবে। জোয়ার প্রবলতর রূপ নেবে আসছে বসন্তে। সিরিয়ার ভবিষ্যত অন্ধকার বিশ্বের দুই শক্তি আমেরিকা ও রাশিয়া সরাসরি প্রক্সি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে সিরিয়া এখন বিশ্বের সবচেয়ে বিশৃঙ্খল, অরাজক ও বিপজ্জনক রাষ্ট্র। ২০১৬ সালেও এই যুদ্ধ শেষ হবে না। এ যুদ্ধে কেউ জয়ীও হবে না। সেখানে প্রেসিডেন্ট বাশার সরকারের পাশাপাশি আইএস ও জাব্বাত আল নুসরার নিষ্ঠুরতা সমানে চলবে। ২০১৬ সালে সিরিয়ার সামনে সমস্ত পথই অন্ধকার। বাড়বে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব এবছর পূর্ব এশিয়ায় চীন-মার্কিন উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করতে পারে যা অন্যান্য দেশকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ঠেলে দেবে। দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন যুদ্ধ জাহাজের আনাগোনা বাড়বে। পাশাপাশি চীনও এই জলরাশিতে সামরিক তৎপরতা বাড়িয়ে তুলবে। আমেরিকা এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সামরিক জোটের এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে। চীন একে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বিবেচনা করে প্রবল বিরোধিতা করবে। ফলে অস্তিরতা দেখা দেবে এই অঞ্চলে। আফ্রিকায় মধ্যবিত্তের প্রসার ঘটবে আফ্রিকার অর্থনীতি গড়পরতা হিসেবে বিশ্বের বাকি দেশগুলোর অধিকাংশকে ছাড়িযে যাবে। গড় প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৫ শতাংশ। আফ্রিকার কোথায় বিনিয়োগ করা যায় সেই সন্ধানে থাকবে পাশ্চাত্যের বিনিয়োগকারীরা। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্যের দাম পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও আফ্রিকার অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছে। মহাদেশটিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্মেষ ঘটেছে এবং চলতি বছর তা আরও প্রসারিত হবে। দক্ষিণ আমেরিকার মন্দা কাটবে না মন্দার হাত থেকে পরিত্রাণ এ বছরও দক্ষিণ আফ্রিকার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে। প্রবৃদ্ধি সামান্য বাড়বে। এ অবস্থাটা হবে ব্রাজিল ও ভেনিজুয়েলার টানা মন্দার কারণে। তবে চিলি, কলম্বিয়া, মেক্সিকো ও পেরুর প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ থেকে ৩ শতাংশ। মজুরি হ্রাস ও বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণে এ অঞ্চলের দেশগুলোতে বিশেষ করে ব্রাজিল ও ভেনিজুয়েলায় গণঅসন্তোষ দেখা দেবে। পণ্যের দাম বাড়বে এ বছর পণ্য উৎপাদনকারীরা কিছুটা স্বস্তি ফিরে পাবে। কারণ জ্বালানি, ধাতব ও খামারজাত পণ্যের দাম বাড়বে। তেলের দর এক বছর আগে যা ছিল তার তুলনায় ১০ শতাংশ বাড়বে। মাদকের ব্যবহারও বাড়বে। সিনথেটিক ড্রাগ নতুন নতুন ও বিপজ্জনক পথে প্রবেশ করবে। ফলে মাদকমুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। ধনী বিশ্ব কিছুটা উজ্জ্ব¡ল হবে ২০১৬তে ধনী দেশগুলো এক দশকের মধ্যে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে সর্বাধিক ভূমিকা রাখবে। তাদের অর্থনীতি কিছুটা চাঙ্গা হবে। মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতির হুমকি অনেকটা কমবে। মার্কিন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে ২.৫ শতাংশ। জাপান ও ইউরো জোনের প্রবৃদ্ধি ১.৬ শতাংশের মতো দাঁড়াবে। ব্রিটেনের প্রবৃদ্ধি হার দাঁড়াবে ২ শতাংশ। জার্মানির ১.৮ শতাংশ। তথাপি ধনী বিশ্বে জীবন এ বছর আরও জটিল রূপ নেবে।
×