ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এম রায়হান

বিদায়ী বছরের কয়েক ছত্র

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ১ জানুয়ারি ২০১৬

বিদায়ী বছরের কয়েক ছত্র

অদম্য প্রতিজ্ঞা নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গের নজির রয়েছে ভূরি ভূরি। কিন্তু দেশের অগ্রগতি থামিয়ে দিতে যারা চায়, তারা কি নিজ স্বার্থের বেলায় সামান্যতম ছাড় দেয়? দেয় না। তাদের কাছে দেশ নয়, আপন বড়; মানবসেবা নয়, মানব শোষণ বড়। এত ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হলো, বিদেশী ঠাকুরের মন ভজানোর চেষ্টা হলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। বাংলার মানুষকে দাবায়ে রাখা গেল না। ২০১৫ সালের সবচেয়ে বৃহৎ অর্জন এটাই- পদ্মা সেতুর কাজের সূচনা। একটি জাতির আত্মশক্তি এবং সে জাতির নেতৃত্বের অদম্য প্রতিজ্ঞা- এই দুয়ের সম্মিলন আর কোন্ বড় অর্জনটির নেপথ্যে রয়েছে! বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মা সেতুর নদী শাসনকাজের উদ্বোধন করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, “জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘কেউ দাবায় রাখতে পারবা না’। বাঙালী জাতি কারও কাছে মাথা নত করবে না, কোনো দিন করেনি।” বিশ্বব্যাংক তথা বিশ্ববাসী দেখুক- বাঙালী পারে, কারও দয়ার দানে নয়, সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম। শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ লাল-সবুজের আরেকটি আশ্চর্য সুন্দর অহঙ্কার! পদ্মা সেতু হলে বাংলাদেশ উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। ২০১৮ সালের মধ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। নিজস্ব অর্থায়নে এটি এ পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। রূপ-রহস্য, স্বরূপের সন্ধান চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া সুন্দরীদের কাছে সিনে-সাংবাদিকদের অনিবার্য প্রশ্ন : আপনার রূপের রহস্য কী? রূপসীরা কি নিজেই জানেন, তাদের রূপের রহস্য কী? অপরূপ রূপ ছড়ানো মানবীর বিহ্বলতা আর সে রূপমুগ্ধ রূপদগ্ধ দর্শকের সম্মোহনের আড়ালে নিশ্চয়ই হাসেন অন্তর্যামী! মেধা ও প্রতিভা যদি ঈশ্বর প্রদত্ত বলে মেনেও নিই, তারপরও থাকে তার চর্চা, অনুশীলন ও সাধনার বিষয়টি। বাঙালীর ক্রিকেটমেধা চাপা পড়ে ছিল পাকিস্তান নামক অভব্য, বাঙালীবিদ্বেষী রাষ্ট্রের কাছে। স্বাধীনতার সুন্দরতম ফসলের একটি আমাদের ক্রিকেট। আমাদের ছেলেরা বিশ্বক্রিকেটে নিজেদের জাদু দেখানোর সুযোগ পেয়েছে। ক্রিকেটের বিশ্বমোড়ল আইসিসি খানিকটা ধন্দে পড়ে গেছে- বাঙালী কি সত্যিই জাদু জানে! এত অল্প বছরের ভেতর তাদের এই বিপুল উন্নতি! অথচ বাংলাদেশকে টেস্ট স্ট্যাটাসের মর্যাদা দিতেও কত গড়িমসি, কত উপেক্ষা আর পরিহাস! আজ বিশ্বের সব ক্রিকেট পরাশক্তির সঙ্গে সমানে সমানে লড়ছে বাংলাদেশ। বাংলার বাঘের কাছে পাকিস্তানের সিংহ বনে গেছে নিতান্ত বনবিড়াল! আর গত বিশ্বকাপেই তো দেখলাম বাংলার বিধ্বংসী বোলারদের হাত থেকে শক্তিমান ভারতকে রক্ষার কী চেষ্টাই না চলেছে। এখন বাংলাদেশ একটা বিস্ময়ের নাম। যে কোন দেশ ক্রিকেটে বাংলাদেশের মুখোমুখি হতে গিয়ে কেঁপে ওঠে পরাজয়ের শঙ্কায়। আইসিসি এখন গবেষণা করে দেখতে চায় কেমন করে এমন উন্নতি করল এই দেশের ক্রিকেট। তারপর বাংলাদেশকে রোল মডেল করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের কিছু দেশকে দেয়া হবে সেই গবেষণা পত্র। যা দেখে নিজেদের ক্রিকেটকে আরও সুসংহত করার সুযোগ পাবে তারা। আলোকিত সেঞ্চুরি বায়ুর ভেতরে প্রাণ পায় আমাদের আয়ু। যদি চারপাশ থেকে কিছুক্ষণের জন্য বাতাস সরিয়ে নেয়া হয় তাহলে হাঁসফাঁস করতে থাকব একটুখানি অক্সিজেনের জন্য। আসলেই তাই। থাকলে সেভাবে মূল্য দিই না, না থাকলে হাহাকার করি। একইভাবে লোডশেডিং না হলে বুঝবো কী করে আলোর মূল্য! বিদায়ী বছরে রাজধানীর মানুষ মনেই করতে পারবে না গোটা বছরে কোন লোডশেডিং হয়েছিল কিনা। ঢাকার বাইরেও বিস্ময়করভাবে কমে এসেছে লোডশেডিংয়ের মাত্রা। আমাদের অগোচরেই ঘটে গেছে আলোকিত সেঞ্চুরি। একটু খোলাসা করেই বলা যাকÑ দেশের শততম বিদ্যুত কেন্দ্রের উদ্বোধন হয়েছে বিদায়ী বছরে। গত ৮ অক্টোবর আশুগঞ্জের ৩টি ইউনিট উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের শততম বিদ্যুত কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। বিগত ছয় বছরে ৭৩টি বিদ্যুত কেন্দ্র হয়েছে। ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুত কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি। বিদ্যুতখাতে সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল বিদায়ী বছরে। বিদ্যুতখাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে জাতীয় গ্রিডে অতিরিক্ত ৬ হাজার ৩২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুত সংযোজন, যার ফলে বিদ্যুতের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৭ শতাংশ থেকে ৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে মাথাপিছু বিদ্যুত উৎপাদনের পরিমাণ ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা থেকে বেড়ে ৩৪৮ কিলোওয়াট ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। নতুন বিদ্যুত সংযোগ প্রদান করা হয়েছে ৩৫ লাখ গ্রাহককে। ঝিলে ঝিলমিল চার চাকা ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে ঢেউ খেলিয়া যায় রে/ ঝির ঝির ঝির হাওয়ায় রে, ঢেউ খেলিয়া যায়... শচীন দেব বর্মণের কালজয়ী গানটির কথা কি নিষ্ঠুর নগরী ঢাকার অধিবাসীদের মনে পড়ে যখন তারা যান হাতিরঝিলে? না মনে পড়লেও ক্ষতি নেই, ঢাকার নয়নজুড়ানো সাফল্য হাতিরঝিলে গেলে মনের ভেতর আনন্দের ঢেউ নিশ্চিতরূপেই খেলে যায়। বিশেষ করে রাতের বেলা এই ঝিলের চারপাশের রূপ দেখে মন ভরে ওঠে গর্বে। বাংলাদেশ যে এগিয়ে চলেছে হাতিরঝিল তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই ঝিল পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের হলেও আসলে এটি ঢাকার দুই প্রান্তে গমনাগমন সহজ করে দিয়েছে। বিপুল সময়ের অপচয় থেকে রক্ষা পেয়েছে মানুষের কর্মঘণ্টা। তবে গাড়িঅলাদের জন্যই বেশি উপকার বয়ে এনেছিল ঝিলটি। হাতির ঝিলে এখনও কোন জলযান ভাসানো হয়নি, তবে চালু করা হয়েছে বাস সার্ভিস। এতে আমজনতার ভারি সুবিধা হয়েছে। কেউ চাইলে মাত্র ৩০ টাকায় গোটা ঝিল চক্রাকারে ঘুরে আসতে পারবেন। হাতিরঝিল প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাজধানীর পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে যোগাযোগ সহজ করা। কিন্তু ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি প্রকল্পটি উদ্বোধনের পর প্রায় তিন বছর ধরে প্রকল্প এলাকার দুই পাশের ১৬ কিলোমিটার রাস্তায় কোন বাস অথবা মিনি বাস চলাচলের অনুমতি ছিল না। তবে কিছু অবৈধ মাইক্রো চলত, এখন চলছে বৈধ বাস সার্ভিস। কয়লা যায় না ধুলে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, আর নরকের জীব মর্তে নেমে এলে কী হবে? সেটা আমরা কিছুটা অনুমান করে নিতে পারব হয়ত। তবে একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বাংলাদেশে এসে কী করেন, তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। বিদায়ী বছরে দু’দুজন পাকিস্তানী কূটনীতিক বহিষ্কৃৃত হলো বাংলাদেশ থেকে। এর পোশাকি ভাষা অবশ্যÑ ‘প্রত্যাহার করে নেয়া’। পাকিস্তানের দুজন সরকারী কর্মকর্তাকে ঢাকা থেকে প্রত্যাহার করে নিতে হলো পাকিস্তানকে। কেন হলো? বাংলায় একটা কথা আছেÑ স্বভাব যায় না মলে। পাকিস্তানের স্বভাব কি আর বদলাবে? তাদের পেয়ারা দোস্ত রাঘববোয়াল যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর ফাঁসি হওয়ার পর দিলে বড়ই চোট পেয়েছিল পাকিস্তান। সেই কষ্ট চেপে রাখতে না পেরে তারা আপত্তিকর বিবৃতি দেয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল। তখন বিভিন্ন মহল থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা কথা তোলা হয়। যাহোক, বলছিলাম দুই কূটনীতিকের কথা, ঢাকা যাদের গুডবাই জানিয়ে দিয়েছে। এদের একজন হাইকমিশনের কনস্যুলার কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাজহার খান জাল পাসপোর্ট ও মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিল। আর ফারিনা আরশাদের বিরুদ্ধে জঙ্গীদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ ওঠে। জাল মুদ্রা পাচারের অভিযোগে বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে অন্তত ২২ জন পাকিস্তানী নাগরিক গ্রেফতার হয়েছে। মুদ্রা পাচারের নেটওয়ার্ক থেকে বিভিন্ন সময় জঙ্গী সংগঠনকে অর্থায়ন করা হচ্ছে। কয়লা ধুলে ময়লা হয়ত যাবে একদিন, কিন্তু পাকিকে বার বার ধোলাই করলেও কি...?
×