ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ফিরোজ মান্না

বড় অর্জন ছিল আইটিইউ ও ওয়ার্ল্ড সামিট পুরস্কার

প্রকাশিত: ০৭:৪৫, ১ জানুয়ারি ২০১৬

বড় অর্জন ছিল আইটিইউ ও ওয়ার্ল্ড সামিট পুরস্কার

২০১৫ সাল। আলোচনা সমালোচনা আর উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তির নানা ঘটনাই ঘটে বছরজুড়েই। এরমধ্যে শীর্ষ দুই যুদ্ধাপরাধী সাকা ও মুজাহিদের ফাঁসির রায় ঘোষণার দিন থেকে টানা ২২ দিন ফেসবুক বন্ধ ছিল। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ট্যাঙ্গো, লাইন, হ্যাংআউটস, স্কাইপ, টুইটার, ইমোর মতো আরও ১১টি এ্যাপস বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ঘটনা দিয়েই যে বছর শেষ হয়েছে। তবে এ সেক্টরে উন্নয়নও ঘটেছে অনেক। ২০১৫ সাল অবশ্য দেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার বছর। আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উন্নয়ন সূচকে দেশ এ বছর একধাপ এগিয়ে গেছে। তথ্য ও যোগাযোগ সুবিধার এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪তম। ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে ছিল ১৪৫তম স্থানে। এ বছর ১৬৭ দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের টেলিকমিউনিকেশন সংস্থা আইটিইউ। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে আইটিইউ পুরস্কারও পেয়েছে বাংলাদেশ। এই পুরস্কার তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অত্যন্ত মর্যাদা সম্পন্ন হিসেবে বিবেচিত ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি (ডব্লিউএসআইএস)। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার ফলে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদর দফতর থেকে এ পুরস্কার দেয়া হয়। এটুআইয়ের ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল প্রজেক্ট ‘এক্সেস টু ইনফরমেশন এ্যান্ড নলেজ’ ক্যাটাগরিতে এবার পুরস্কার বাংলাদেশ। এ বছরই তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরে অগ্রগতির স্বীকৃতি হিসেবে ‘পাবলিক সেক্টরে এক্সিলেন্স’ ক্যাটাগরিতে ‘গ্লোবাল আইসিটি এক্সিলেন্স এ্যাওয়াড পেয়েছে। গত ১ অক্টোবর মেক্সিকোর গুয়াদালাজারা শহরে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনে (ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অন আইটি ডব্লিওসিআইটিতে) এ পুরস্কার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে তুলে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, দেশে এবারই প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড’ এর মতো একটি বড় আয়োজন করা হয়। একই সঙ্গে বিপিও সামিট হয়েছে। এ বছর বিশ্বজুড়েই তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব ঘটেছে। তার হাওয়া দেশেও লেগেছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নানা আবিষ্কার হয়েছে। সেই আবিষ্কারের সুবিধা দেশের মানুষ ভোগ করছে। স্কুল-কলেজে ক্লাশ রুম হয়েছে প্রযুক্তি নির্ভর। স্থাপন হয়েছে আইসিটি পার্ক। দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে এই পার্কগুলো। এখান থেকে প্রশিক্ষিত আইটি বিশেষজ্ঞ বের হচ্ছে। তারা দেশে বিদেশে উচ্চ বেতনে চাকরি পেয়েছে। সমৃদ্ধ হয়েছে সফটওয়্যার শিল্প। গত এক বছরে সফটওয়্যার রফতানি করে এক শ’ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে দেশ। আউটসোর্সিং করেও আয় হয়েছে কোটি কোটি ডলার। এত কিছুর পরেও তথ্যপ্রযুক্তির উল্টো পিঠে অসুবিধাও রয়েছে অনেক। যা কিনা দেশে-বিদেশে নানা অপরাধের জন্ম দিয়েছে। তবে সবকিছুকে উপেক্ষা করে দেশে টানা ২২ দিন ফেসবুক বন্ধ করে রাখা। তবে দেশের মানুষের মনে রাখার মতো ঘটনা হচ্ছে, বছরের গোড়ার দিকে ভাইবার ও ট্যাঙ্গো এ্যাপস দুটি বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন বিষয়টি নিয়ে এতটা হৈচৈ হয়নি। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) মৌখিক নির্দেশে সেবা দুটি বন্ধ করে দেয়ার হয়েছিল। ভাইবার ও ট্যাঙ্গো বন্ধের কারণ হিসেবে বিটিআরসির তখন বলেছিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিটিআরসি ওই দুই সেবা বন্ধ করে দেয়। নিরাপত্তার স্বার্থেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমন নির্দেশ দিয়েছিল। পরে হোয়াটসএ্যাপ, মাইপিপল ও লাইন নামের আরও তিনটি ভয়েস ও মেসেজিং সেবা বন্ধ করে দেয় সরকার। সেই সময় বিভিন্ন অনলাইন, ফেসবুকসহ সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যমেও ভাইবার ব্যবহার করতে না পারায় ব্যবহারকারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ভাইবার বন্ধ করে দেয়ার খবরটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো ফলাও করে প্রচার করে। পরে সরকার ২১ জানুয়ারি এসব সেবা আবার খুলে দেয়। ১৮ জানুয়ারি এ্যাপসগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল বিটিআরসি। তখন সরকারের যুক্তি দেশে তখন বিএনপি-জামায়াতের চরম অরাজকতা চলছিল। ট্রেন, লঞ্চ,বাস ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যায় নেমেছিল। তখন জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীরা বিনা টাকায় ভাইবার ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান গোপন রেখে কথা বলে হামলার জন্য নির্দেশ দিত। ওই নির্দেশগুলো বন্ধ করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ভাইবার বন্ধ করা হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সম্প্রতি যোগাযোগের জন্য ভাইবার ব্যবহার করেন। এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেবা দুটি বন্ধে বিটিআরসির সহায়তা চায়। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিটিআরসি থেকে নির্দেশ পেয়ে মোবাইল অপারেটরদের ও আইজিডব্লিউ সেবাগুলো বন্ধ রাখার জন্য বিটিআরসি চিঠি পাঠায়। তখন অপারেটররা ভাইবার ও ট্যাঙ্গো সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। সেই সময় হোয়াটসএ্যাপ, লাইন ও মাইপিপল ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে ছিল। দেশে থ্রি জি (তৃতীয় প্রজন্মের ফোন) চালু হয়েছে। এখন ফোর আসছে। উন্নত প্রযুক্তি কারণে জঙ্গীরা ইন্টারনেট, ভাইবার থেকে শুরু করে নানা ধরনের এ্যাপস ব্যবহার করে জঙ্গী কার্যক্রম চালিয়েছে। অপরাধ ঘটিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। সাইবার অপরাধ বন্ধ করতে এবং সন্ত্রাসী ও জঙ্গীদের ধরতে প্রয়োজন হলে কিছুদিনের জন্য ভাইবার, হোয়াটসএ্যাপ বন্ধ করা হয়। সব ভাল দিকের মধ্যে কিছু খারাপ দিকও থাকে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যেমন সুফল পাচ্ছে তেমনি অসুবিধার মধ্যেও পড়ছেন। পাকি দোস্ত সাকা ও মুজাহিদের ফাঁসির রায় ঘোষণার পরের দিন দেশব্যাপী নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গত ১৮ নবেম্বর থেকে ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসএ্যাপসহ ইন্টারনেটে যোগাযোগের ১২টি মাধ্যম বন্ধ করা হয়। ওইদিন প্রথমে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার ও হোয়াটসএ্যাপ বন্ধ করার নির্দেশ দেয় বিটিআরসি। পরে আরেকটি নির্দেশে লাইন, ট্যাঙ্গো, হ্যাংআউটসহ আরও কয়েকটি মাধ্যম বন্ধের কথা জানানো হয়। তবে এ কাজটি করতে গিয়ে ওই দিন প্রায় দেড় ঘণ্টা দেশ ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ঘটনার পর বিটিআরসি পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধের এ নির্দেশ বলবৎ থাকবে। ফেসবুক ২২ দিন বন্ধ থাকার পর ১০ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক খুলে দেয় সরকার। ওইদিন দুপুরে ফেসবুক খুলে দেয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বন্ধ থাকার কারণে অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা ১৪ ডিসেম্বর হাফ ছেড়ে বাঁচেন। ওই দিন ভাইবার, হোয়াটসএ্যাপ, টুইটার, স্কাইপসহ বন্ধ থাকা সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যম খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয় বিটিআরসি। বিটিআরসির যুক্তি ছিল, এসব এ্যাপস ব্যবহার করে দেশে নাশকতা চালাতে পারে। সাইদীর রায়ের পর দেশব্যাপী ফেসবুকের মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে জ্বালাও পোড়াওসহ ৮৪ মানুষকে হত্যা করা হয়। সেই চিন্তা মাথায় রেখেই এবার ফেসবুকসহ ১২টি এ্যাপস বন্ধ রাখা হয়। ২০১৫ সালকে যেমন তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের বছর হিসেবেও উল্লেখ করার মতো। আবার সরকারের বেশকিছু সিদ্ধান্তের সমালোচনা আলোচনাও রয়েছে। বছর জুড়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং সেবাগুলো বন্ধ ও খোলার ঘটনা দেশের তরুণ উন্মুক্ত পেশাজীবীদের বেশ প্রভাব ফেলেছে। এতে দেশের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে দেশের এসব ঘটনা নেতিবাচক প্রচার হয়েছে। এতে বিশ্বজুড়ে একটা বদনামও হয়েছে। এ ঘটনায় নবেম্বরে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাত লাখের বেশি কমে গিয়েছিল। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বন্ধ থাকার কারণে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কমে যায়। দেশে বর্তমানে পাঁচ কোটি ৪৬ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন। ওই ঘটনার কারণে ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসেবে ফেসবুক বন্ধ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ২৩০ থেকে ২৪০ জিবিপিএস (গিগা বিট পার সেকেন্ড)। ১২টি মাধ্যম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তা ৩০ শতাংশ কমে যায়। যা অন্য কোন গত বছর হয়নি। টানা ২২ দিন সামাজিক যোগাযোগের ১২টি মাধ্যম বন্ধ করে দেয়ার বিষয় দেশের মানুষ অনেক দিন মনে রাখবেন। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বন্ধ করার কারণে দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে। এ ক্ষতি ডিজিটাল বাংলাদেশ সেøাগানের সঙ্গে যায় না। কারণ ডিজিটাল সুবিধা বন্ধ রাখার কারণে দেশের কোটি কোটি মানুষ নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এসব সেবা বন্ধ করা এক ধরনের আত্মঘাতী বলেই প্রতিয়মান হয়েছে। দেশের মানুষ একবার তথ্যপ্রযুক্তির স্বাদ পেয়েছে। তাই এটা কেড়ে নেয়া বা বন্ধ রাখা কোন যুক্তি সঙ্গত কাজ না। প্রযুক্তি দিয়ে অপরাধীরা অপরাধ করে তাহলে আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধীদের আটক করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মানুষ গত বছরটা সরকারের এ রকম সিদ্ধান্তের বিষয়টি দীর্ঘদিন মনে রাখবে। কারণ কোটি কোটি মানুষ প্রযুক্তির অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল।
×