ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

২০১৮ সালেই পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া সম্ভব হবে;###;হামিদ-উজ-জামান মামুন

ঐতিহাসিক সাক্ষী হলো ২০১৫ সাল

প্রকাশিত: ০৭:৪৪, ১ জানুয়ারি ২০১৬

ঐতিহাসিক সাক্ষী হলো ২০১৫ সাল

দেশের অবকাঠামো খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছে ২০১৫ সালে। বছরজুড়েই আলোচনায় থাকলেও শেষ দিকে এসে সত্যি সত্যিই জাতি প্রত্যক্ষ করেছে সেই মহেন্দ্রক্ষণ। এতদিন যে স্বপ্নের কথা বলে বলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ তাদের শিশুদের ঘুম পাড়াত, এখন সেই স্বপ্নই সত্যি হতে চলেছে। গত ১৩ ডিসেম্বর দিনটিও স্থান পেল ইতিহাসের পাতায়। এদিন মূল সেতু এবং নদীশাসন কাজের উদ্বোধনের মধ্যদিকে নতুন এক হতিহাসের জন্ম দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০১ সালের ৪ জুলাই এই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন শেখ হাসিনা। এরপর পার হয়েছে অনেকটা সময়, কিন্তু সেতু হয়নি। সাড়ে ১৪ বছরের মুখে নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবরূপ পেতে চলেছে স্বপ্নময় এ সেতু। আয়তন ও নির্মাণ ব্যয়ের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু। ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুটি বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু। সর্বশেষ সংশোধনীর পর এর ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ভূমি অধিগ্রহণ এবং পুনর্বাসনের মতো জটিল কাজও শেষ হয়েছে। গত ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত সেতুর ১৪ দশমিক ৯ ভাগ কাজ শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। কাজ শেষ হয়েছে ১৭ দশমিক ৩ ভাগ। নদী শাসনের কাজের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক ৮ ভাগ। কাজ হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৩ ভাগ। জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়কের ৭০ দশমিক ৪৯ ভাগ কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও শেষ হয়েছে ৫০ দশমিক ৮৮ ভাগ। মাওয়া প্রান্তে সংযোগ সড়কের ৬৭ দশমিক ৩১ ভাগ কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও শেষ হয়েছে ৫৯ দশমিক ৮৭ ভাগ। মূল সেতু নির্মাণ চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (এমবিইসি)। চার বছরের চুক্তিতে ২০১৪ সালের ২৬ নবেম্বর সেতুর কার্যাদেশ দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় সেতু নির্মাণে সময় লাগবে তিন বছর। এমবিইসির কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডটি বিশাল। এখানেই তৈরি হচ্ছে বিশাল বিশাল পাইল। চীন থেকে সাগর পথে বাংলাদেশে এসেছে পাইলিং পাইপ বানানোর ইস্পাতের পাত। ৬০ মিলিমিটার বা দুই দশমিক ৩৬ ইঞ্চি পুরু ইস্পাতের পাতগুলো। একেকটির ওজন ১৩ টন। এসব ইস্পাতের পাতকে প্রবল শক্তির বেন্ডিং মেশিন দিয়ে সিলিন্ডারের আকৃতি দেয়া হচ্ছে। তিন দশমিক দুই মিটার বা ১০ ফুট ব্যাসের একেবারে নিখুঁত গোলাকার ২৫টি সিলিন্ডার একত্রে যোগ করার পর হচ্ছে একেকটি পাইলিং পাইপ। সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীরা জানান, ইস্পাতের পাতগুলো শতভাগ স্টেইনলেস। পানির নিচে ১শ’ বছরেও কিছু হবে না। যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু ওয়েল্ডিং নয়, গ্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে কোথাও যেন এক চুল ফাঁকফোকর না থাকে তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। পাইলিং পাইপ তৈরির পর, ইয়ার্ড থেকে বসানো রেললাইনের মাধ্যমে নদীতে নেয়া হচ্ছে। সেখান থেকে হাজার টনের ক্রেনের মাধ্যমে নেয়া হবে সেতুর নির্মাণস্থলে। এমবিইসি মূল সেতু নির্মাণ করলেও পুরো পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন তদারক করছে সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। নদী শাসনের দায়িত্বে রয়েছে আরেক চীনা প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো। আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে মাওয়া ও জাজিরা দুই প্রান্তে ১২ কিলোমিটার নদীশাসনের কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। মাওয়া প্রান্তে নদীর তীর ঘেঁষে চলছে নদীশাসনের জন্য কংক্রিট ব্লক তৈরির কাজ। একই কাজ চলছে জাজিরা প্রান্তে এক বর্গকিলোমিটারজুড়ে। প্রকৌশলীরা জানান, ১৮ লাখ ব্লক তৈরি করা হয়েছে। এগুলো দিয়ে নদীতীর বাঁধাই করা হবে। যাতে সর্বনাশা প্রমত্তা পদ্মা আর না ভাঙ্গে। সেতু যেন অটুট থাকে। সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চল ও মংলাবন্দরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভ্রমণের সময় এক চতুর্থাংশ কমে আসবে ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে। এই সেতু প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আঞ্চলিক যোগাযোগে যুগান্তকারী অধ্যয় সূচনা করবে। নির্মাণ শিল্পে ২৯ শতাংশ, কৃষিতে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ এবং উৎপাদন ও পরিবহনে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। এই সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের দারিদ্র্য হ্রাস পাবে শতকরা ১ ভাগ। আর জাতীয়ভাবে দারিদ্র হ্রাসের হার হবে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে এক দশমিক ৭ শতাংশ আর সারাদেশের জিডিপি বাড়বে দশমিক ৫৬ শতাংশ। স্থানীয় লোকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান এবং ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেতু দিয়ে দৈনিক যান চলাচলের সংখ্যা বর্তমানে ৪ হাজার ৩০০ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১২ হাজার ৮৩১টিতে। ২০৪০ সালে যান চলাচল ৪৫ হাজারে উন্নীত হবে। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক প্রবাহ বাড়বে ১৯ শতাংশ। সেতু নির্মাণে নদীশাসনের ফলে ৯ হাজার হেক্টর জমি নদীভাঙ্গন ও বন্যা থেকে রক্ষা পাবে। যার মূল্য প্রায় ১৫ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। বিদ্যুত, গ্যাস ও অপটিক্যাল ফাইবার কেবল লাইন এই সেতু দিয়ে যাবে। ফলে সাশ্রয় হবে ২৭ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার। মাওয়া-জাজিরা রুটে ফেরি সার্ভিস পরিচালনা বাবদ ৪০ কোটি মার্কিন ডলারের ব্যয় সাশ্রয় হবে এই পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে। পদ্মা সেতু ঘিরে হংকংয়ের আদলে নগর গড়ার পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এছাড়া রাজধানীর সঙ্গে পদ্মা সেতুর যোগাযোগ সহজ করতে মাওয়া থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত চার লেনের সড়ক হবে। রাজধানীর বিজয়নগর থেকে ঢাকা-মাওয়া সড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে হবে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার। বিভক্ত সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। সেতুর মাওয়া প্রান্তে এক হাজার ৪৭৮ মিটার ভায়াডাক্ট (ঝুলন্ত পথ) থাকবে। জাজিরা প্রান্তে ঝুলন্ত পথ থাকবে এক হাজার ৬৭০ মিটার। এই ঝুলন্ত পথগুলো সেতুকে এ্যাপ্রোচ রোডের (সংযোগ সড়ক) সঙ্গে যুক্ত করবে। প্রায় তিন দশমিক ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ভায়াডাক্টে থাকবে ৮১টি পিলার। রেললাইনের জন্য দুই প্রান্তে ৫৩২ মিটার ভায়াডাক্ট নির্মাণ করা হবে ১৪টি পিলারের ওপর। পদ্মাই হতে চলেছে দেশের প্রথম দ্বিতল সেতু। এর উচ্চতা হবে ১৩ দশমিক ৬ মিটার বা প্রায় ৪৪ ফুট। নিচতলায় (লোয়ার ডেক) ট্রেন চলবে। মিটার ও ব্রডগেজ উভয় ধরনের ট্রেন চলাচলে ডাবল গেজ রেললাইন থাকবে। দ্বিতীয় তলায় (আপার ডেক) চলবে গাড়ি। আপার ডেকের প্রস্থ হবে ৭২ ফুট। ফুটপাথ ও সেতুর রেলিংয়ের জন্য দু’পাশে আড়াই মিটার করে জায়গা থাকবে। সেতুর ওপরে চার লেনের রাস্তার প্রস্থ হবে প্রায় ৫৬ ফুট। দুই ডেককে আলাদা করা হবে আড়াআড়িভাবে বসানো ট্রেসের মাধ্যমে। ট্রেন ও যানবাহন চলাচল ছাড়াও সেতুতে ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ থাকবে দক্ষিণাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য। ৬ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসবে অপটিক্যাল ফাইবার ও টেলিযোগাযোগের লাইন স্থাপনে। উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনেরও ব্যবস্থা থাকবে। এই সেতুর বদৌলতে দক্ষিণাঞ্চলে গ্যাস পৌঁছাবে। বিদ্যুতের ঘাটতিও দূর হবে। দক্ষিণবঙ্গের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল পদ্মা সেতু। ১৯৯৮-৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা আসার পর ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর নক্সার জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। তবে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে গেলে বর্তমান সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু তৈরির উদ্যোগ নেয়। পরে ২০১৪ সালের জুন মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের সঙ্গে এই সেতু নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ২৬ নবেম্বর কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। এরপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কর্তৃপক্ষ এ বছরের মার্চে চীনের প্রথমত মাওয়ায় পদ্মার পাড়ে দুটি গরু, দুটি ছাগল ও দুটি মোরগ জবাই করে সেগুলোর রক্ত নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করে। আট মাস পর সেতুর মূল ডিসেম্বর মাসে এসে পাইলিংয়ের কাজের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেষ খবর অনুযায়ী কানাডার আদালতে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ দিতে পারছে না বিশ্বব্যাংক। বরং তথ্য প্রদানে আদালতের আদেশ ঠেকাতে অর্থায়নকারী এই সংস্থাটি কানাডার উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। দায়মুক্তি ভোগের কারণে তারা আদালতে কোন নথি দিতে চাইছে না। বিশ্বব্যাংকের তদন্তে পাওয়া তথ্যাদির নথিপত্র আদালতে উপস্থাপনের দাবি জানিয়েছেন মামলার অভিযুক্ত জুলফিকার ভূঁইয়ার আইনজীবী। এজন্যই আদালত বিশ্বব্যাংককে তথ্য প্রমাণ দিতে বলেছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক আদালতের শুনানিতে অংশ নেবে না বলে জানিয়েছে। তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে বিশ্বব্যাংক আইনী দায়মুক্তি ভোগ করে। এ কারণে তাদের কোন নথিপত্র কোন আদালতে জমা দিতে আইনগতভাবে বাধ্য নয়। কানাডার আইনও এই দায়মুক্তি দিয়েছে সংস্থাটিকে। আর এ যুক্তিতে তারা আদালতে নথি দিতে চাইছেন না। যদিও আরসিএমপির তদন্ত প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে বিশ্বব্যাংক নিজেই দায়মুক্তির লঙ্ঘন ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ চেয়েছে কানাডার আদালত। অন্টারিওর সুপিরিয়র কোর্ট অব জাস্টিসের আদালত পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব তদন্তের নথিপত্র আদালতে উপস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক ওই আদালতে তাদের তদন্তের নথিপত্র জমা না দিয়ে বরং আদালতের নির্দেশ ঠেকাতে কানাডার সুপ্রিমকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট বিশ্বব্যাংকের আবেদন গ্রহণ করেছেন। অন্টারিওর সুপিরিয়র কোর্ট অব জাস্টিসের আদালতের নির্দেশকে ঠেকাতে আইনি লড়াই করতে চায় বিশ্বব্যাংক।
×