ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহজাহান মিয়া

শহীদের সংখ্যা নিয়ে খালেদার নতুন খতিয়ান!

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১ জানুয়ারি ২০১৬

শহীদের সংখ্যা নিয়ে খালেদার নতুন খতিয়ান!

বিজয়ের মাসে বাঙালীর হৃদয়ের গভীরে নিষ্ঠুর-নিদারুণ আঘাত হেনেছে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বেগম জিয়ার অমার্জনীয় উক্তি দেশের সর্বস্তরের মানুষকে হতবাক করেছে, স্তম্ভিত করেছে। খালেদা জিয়ার এই নির্লজ্জ মিথ্যাচারে দেশের মানুষ প্রচ- ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফুঁসে উঠছে। শহীদের সংখ্যা নিয়ে এমন চরম বিতর্কিত প্রশ্ন উত্থাপন করে বিএনপি নেত্রী তার নগ্নরূপকে আবারও জাতির কাছে প্রকাশ করলেন। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের সরকারী ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পরিসংখ্যান অস্বীকার করে বেগম জিয়া তার ধবল সাদা চেহারার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কুৎসিত ঘৃণ্য চেহারাটিই উন্মোচন করলেন। তিনি তার প্রিয় পাকিস্তানের যেমন পেয়ারের মানুষ ছিলেন, এখনও তাই আছেন বলে প্রমাণ করলেন। আসলে কয়লা শতবার ধুলেও ময়লা যায় না। একাত্তরের রণাঙ্গনে দেশের সর্বত্র অকুতোভয় বঙ্গশার্দূল মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধ করেছেন। আর খালেদা জিয়া ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানী সেনাদের পরম আদর-যতœ, আপ্যায়নে সিক্ত হয়ে আরাম-আয়েশে দিন কাটিয়েছেন। তিনি কিভাবে জানবেন দেশের অন্যত্র তখন কি ঘটেছিল, বাঙালীদের জীবনের ওপর দিয়ে কি নিদারুণ ঝড় বইয়ে যাচ্ছিল। তাই সবার ধারণা তার পেয়ারে পাকিস্তানীদের নৃশংসতা ও সব দুষ্কর্মের কাহিনী আড়াল করার জন্য এখনও খালেদা জিয়া সুকৌশলে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই ইতিহাসবিকৃত বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারই নয়, সোভিয়েত বার্তা সংস্থা ‘তাস’, ‘ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফি’ ও ইউএনআইসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ বলেছিল। পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফেরার পথে বিদেশী গণমাধ্যম ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখই (থ্রি মিলিয়ন) বলেছিলেন। সারাজীবন আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে যিনি বাংলাদেশ নামক দেশটির অভ্যুদয় ঘটাতে পেরেছিলেন সেই মহান নেতার পক্ষে শহীদের সংখ্যা বলাটি কি কোন অসম্ভব বিষয় ছিল? কেউ কেউ মনে করেন শহীদের সংখ্যা আরও বেশিই হতে পারে। কারণ, জীবন বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নেয়া কমপক্ষে এক কোটি বাঙালী শরণার্থীর মধ্যে আঘাতজনিত ও অসুস্থতার কারণেও অনেকের মৃত্যু ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর সাংবাদিক সিডনি সেনবার্গ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় ঘুরে যে রিপোর্ট করেছিলেন তাতেও তিনি লিখেছিলেনÑ এমন কোন পরিবার পাওয়া যায়নি যে পরিবারের কেউ না কেউ প্রাণ হারায়নি। আর দেশব্যাপী দেখা গেছে শুধু বধ্যভূমি। দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এখনও ছাপা হচ্ছে একাত্তরের লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের কাহিনী। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি অবিলম্বে ‘হলোকস্ট ডিনায়েল এ্যাক্ট’ প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে। ইতিহাস বিকৃতি প্রতিহতকরণের উদ্দেশ্যে গণহত্যার ভিকটিম ইউরোপের ১৪টি দেশ ‘হলোকস্ট অস্বীকৃতি আইন’ প্রণয়ন করেছে। আইনটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গণহত্যার পরিসংখ্যান অস্বীকার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করার পর থেকেই আমরা বহুবার ইউরোপের ‘হলোকস্ট ডিনায়েল এ্যাক্ট’-এর মতো আইন প্রণয়নের দাবি করে আসছিলেন। তারা বলেছেন, ‘এই আইন প্রণীত না হলে ভবিষ্যতে বিএনপি যদি কখনও ক্ষমতায় আসে তাহলে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার লেশমাত্র থাকবে না।’ সারাদেশে যে কি বিভীষিকাময় পরিস্থিতি ছিল সে সম্পর্কে আমোদে-আহ্লাদে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বাস করে তিনি আর কোন ধারণাই করতে পারেননি। সেটা তার মাথায়ও আসেনি। তাই এরকম বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। কথায় আছে লজ্জাহীনদের আর লাজলজ্জার কোন বালাই থাকে না। অনেকে বলেন বেগম জিয়ার বেলায় কথাটি অনেকটাই সত্যি। হিংস্র হানাদার পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরসহ দেশের আনাচে-কানাচে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার দামাল ছেলেরা যখন মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত তখন অনেকটা নিরাপদ ঢাকার পাকিস্তানী সেনানিবাসের সুন্দর পরিবেশে প্রাসাদোপম ভবনে বেগম জিয়া মহাশানশওকতে দিন গুজরান করছিলেন। নিজের স্বামী মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে যাওয়ারও এতটুকু চেষ্টা করেননি। জিয়াউর রহমান যেভাবেই হোক যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ভারতেও গিয়েছিলেন। পরের কাহিনী সবারই কম-বেশি জানা। তার প্রাণপ্রিয় সুন্দরী স্ত্রী খালেদাকে নিজের কাছে নেয়ার জন্য একাধিকবার লোক পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যাননি। ২১ ডিসেম্বর সোমবার রাজধানী ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত সমাবেশে তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে দেশে তুমুল তোলপাড় সৃষ্টিকারী এ মন্তব্যটি করেন। ঐতিহাসিকভাবে সত্য ও স্বীকৃত ৩০ লাখ শহীদের মহান আত্মদানের বিষয়টি নিয়ে এমন জঘন্য প্রশ্ন তুলে মিথ্যাচার করা বেগম জিয়াকে মিথ্যাচারের মহারানীরূপেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি শহীদদের আত্মার প্রতি অবমাননারই শামিল। তিনি এমন মন্তব্য করে নিজেকে বিকৃতমনা ও বিকারগ্রস্ত মানুষ বলেই প্রমাণ করেছেন। দেশের তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাওয়া বেগম জিয়ার বক্তব্য এ দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস কলঙ্কিত করেছে। তার বক্তব্যে পাকিস্তানী ও রাজাকারদের বক্তব্যই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি এদেশে যখন জোরদার হয়ে উঠছে ঠিক তখনই পাকিস্তানী ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা গেল খালেদা জিয়ার কণ্ঠে। খালেদার দোসর পাকিস্তানীরা ও তাদের এদেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের অপকর্ম হাল্কা করে দেখানোর হীন অপপ্রয়াস প্রতিভাত হয়ে উঠছে বেগম জিয়ার বক্তব্যে। যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সমর্থনও ফুটে উঠেছে তার মন্তব্যে। এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। ক্ষমার অযোগ্য রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ। বঙ্গবন্ধুর স্বর্গীয় ¯েœহ-মমতা ও মহানুভবতার পরশে সিক্ত হয়েই বেগম জিয়া নিজের স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আজ সেই বেগম জিয়াই ১৫ আগস্টের ওই কলঙ্কিত বঙ্গবন্ধুর হত্যার দিনটিকেই বেছে নিয়েছেন ঘটা করে তার জন্মদিনের বিশাল কেক কাটার দিন হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর উদারতায় জীবনে স্বামীর সান্নিধ্যলাভের মতো বিরল অবদানের কথা কখনই তার ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কৃতজ্ঞচিত্তে জীবনভর স্মরণ রাখারই কথা। কিন্তু ঘটল কি কুৎসিত ব্যত্যয়। বেগম জিয়া কুৎসিত হৃদয়ের অধিকারী না হলে মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্ভ্রম হারানো আড়াই লক্ষাধিক মা-বোনের সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তুলতেন না। ২১ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর প্রতি কটাক্ষ করে বেগম জিয়া বলেন, ‘তিনি স্বাধীনতা চাননি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে দেশ স্বাধীন হতো না।’ ২০১৪ সালের আগস্ট, নবেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তারেক রহমানের ঘৃণ্য কটূক্তি করার ঔদ্ধত্য সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। লন্ডন প্রবাসী বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টের কুরুচিপূর্ণ ও ধৃষ্টতামূলক মন্তব্য দেশের সর্বত্র প্রচ- প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাংলাদেশের স্থপতি ও স্বপ্নদ্রষ্টা সম্পর্কে অর্ধশিক্ষিত অর্বাচীনের অশালীন ও অশোভন বক্তব্য এদেশের সর্বস্তরের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। গত বছরের ৭ নবেম্বর এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে ‘পাকবন্ধু’ বলে অভিহিত করার ধৃষ্টতাও প্রদর্শন করেছিল তারেক। শ্রদ্ধেয় কলামিস্ট, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক এবং অমর একুশের কালজয়ী গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তারেক রহমানের স্পর্ধা সম্পর্কে যে যথার্থ মন্তব্য করেছিলেন । গাফ্ফার ভাই বলেছিলেন, ‘তারেক রহমান একজন জীবন্ত উন্মাদ। সে পাগল হয়ে গেছে। পাগল না হলে বিলেতে বসে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এমন ধরনের বক্তব্য দিত না। তাকে অর্ধ উন্মাদ বললেও সম্মান করা হবে। এই উন্মাদ অবস্থাতেই তার শেষ পরিণতি ঘটবে।’ তিনি অবশ্য তারেক রহমানের বক্তব্যকে গুরুত্ব না দেয়ারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। আজ ছেলের মতোই যেন মায়ের অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে মনে করেন বিএনপি বিগত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে যে ভুল করেছে তারই খেসারত দিতে হচ্ছে এখন এই দলটিকে। নানাভাবে নানারূপে হিসাব-নিকাশ করে তাদের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভর করেছে চরম হতাশা। কথাটি তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, পাকিস্তান প্রেমে মশগুল খালেদা জিয়া পাকিস্তানের ঘৃণ্য গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং এদেশে তার রাজনীতির দোসর জামায়াতে ইসলামের ইশারায় বিএনপি গত ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে। তাছাড়া, তৃণমূল পর্যায়ে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে হতাশা এতটাই প্রবল যে, বারবার আন্দোলনের হুমকি দিয়েও তারা সরকারবিরোধী অন্দোলন করতে পারেনি। উপরন্তু, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন মামলায় ফেঁসে যাওয়ায় তারা এখন চারদিকে অন্ধকার দেখছেন। খালেদা জিয়ার আবোল-তাবোল প্রলাপ বকা তারই পরিচয় বহন করছে। লেখক : সিনিয়র সাংবদিক ও কলামিস্ট
×