ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মামুন রশীদ;###;দেশের খেলাধুলা

ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫

ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি

হতাশা দিয়ে একটি বছর শেষ করল বাংলাদেশের ফুটবল। দক্ষিণ এশিয়ার ‘বিশ্বকাপ ফুটবল’ খ্যাত সাফে এবারও চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় দল। গত দুই আসরের মতো এবারও গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছে। বছরজুড়েই পুরুষদল তেমন সাফল্য পায়নি। তবে প্রথমবারের মতো কোন আন্তর্জাতিক আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলাররা। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ গার্লস রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয় করেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এছাড়া বছরজুড়েই এ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, শূটিং ও জিমন্যাস্টিকসসহ বিভিন্ন ইভেন্টে ছিল শুধু হতাশার চিত্র। আর পুরো ক্রীড়াঙ্গনে সমস্যা জর্জরিত হকিতে ছিল বছরজুড়েই বিদ্রোহের আগুন। তাই হকি খেলোয়াড়রা মাঠেই নামতে পারেননি সেভাবে। বছরটা শেষ হয়েছে এভাবেই। বছরের শেষভাগে সবার দৃষ্টি ছিল সাফ ফুটবলের দিকে। ২০০৩ সালে সর্বশেষবার আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশ শিরোপা জিতে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল বাংলাদেশ দল। এরপর আর সাফ ভাল যায়নি। এবার শিরোপা ছিনিয়ে আনার মিশন নিয়ে দেশীয় কোচ মারুফুল হকের অধীনে ভারতের কেরলে অনুষ্ঠিত সাফে গিয়েছিল মামুনুল ইসলামের দল। কিন্তু আফগানিস্তানের কাছে ৪-০ এবং মালদ্বীপের কাছে ৩-১ গোলে হেরে আগেভাগেই বিদায় নিয়ে নেয়। সেই ব্যর্থতার ভার নিয়ে কোচ মারুফুল পদত্যাগ ও অধিনায়ক মামুনুল অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। অবশ্য শেষ ম্যাচে ভুটানকে ৩-০ গোলে হারিয়ে কিছুটা ছন্দ ফিরে পায় বাংলাদেশ। এই জয়টা এসেছে সাফে ৬ বছর ও ৯ ম্যাচ পর প্রথম। পুরো বছরই এভাবে হতাশায় কেটেছে জাতীয় দলের। প্রথমবারের মতো সরাসরি বিশ্বকাপ বাছাইয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে অস্ট্রেলিয়া, জর্দান, তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানের কাছে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছে ঘরের মাটিতে ও তাদের মাটিতে। এর পেছনে তিনবার কোচ পরিবর্তনটাও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। তবে ক্লাবগুলোর সাফল্য অনুসারে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাব। আগের বছর যে সাফল্য পেয়েছিল সেটা এবারও ধরে রেখেছে ক্লাবটি। বছরের শুরুর দিকে ফেডারেশন কাপের শিরোপা জয় করে দলটি। জমজমাট ও উপভোগ্য ফাইনালে শেখ জামাল ৬-৪ গোলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখায়। ঘরোয়া ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগেও শিরোপা জেতে শেখ জামাল। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এএফসি ক্লাব কাপের মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে শেখ জামাল ধানম-ি। কিরগিজস্তানে গিয়ে গ্রুপ পর্বে দুর্দান্ত খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এ যোগ্যতা অর্জন করে তারা। প্রথমবারের মতো আট দলের অংশগ্রহণে অক্টোবরে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। ভারতের কলকাতার পরাশক্তি ইস্টবেঙ্গলকে ফাইনালে ৩-১ গোলে হারিয়ে আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে স্বাগতিক চট্টগ্রাম আবাহনী। অবশ্য এ টুর্নামেন্টে দেশের সেরা দুই ক্লাব শেখ জামাল ও শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তবে দেশের মুখ রক্ষা করেছে চট্টগ্রাম আবাহনী। এছাড়া বয়সভিত্তিক ফুটবলে বড় সাফল্য এনে দেয় বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ ও অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল দল। বছরের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ ফুটবল মাঠে গড়ায়। দুর্দান্ত খেলা স্বাগতিক বাংলাদেশ টুর্নামেন্টের ফাইনালেও পৌঁছে যায়। ৮ ফেব্রুয়ারি শিরোপানির্ধারণী ম্যাচে মালয়েশিয়া অনূর্ধ্ব-২৩ দলের বিরুদ্ধে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর একপর্যায়ে ২-২ ব্যবধানে সমতা ফেরায় লোডভিক ডি ক্রুইফের দল। কিন্তু ম্যাচের শেষ মুহূর্তে কর্নার থেকে দুর্দান্ত এক গোল করে শিরোপা জয় করে অতিথি মালয়েশিয়া। অবশ্য শিরোপা হাতছাড়া হলেও বঙ্গবন্ধু কাপের সেরা খেলোয়াড় হন বাংলাদেশের জামাল ভূঁইয়া। আর সিলেটে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ সাফ ফুটবলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশ। আগস্টে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে ফাইনালে স্বাগতিক বাংলাদেশ টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারায় শক্তিশালী ভারতকে। তবে ফুটবলের সবচেয়ে বড় সাফল্যটা এনেছে অনূর্ধ্ব-১৪ মহিলা ফুটবল দল। বিজয়ের মাসে হিমাচলের চূড়ায় উঠে বাংলাদেশের মেয়েরা। ১৬ কোটি বাংলাদেশীকে গৌরব উপহার দেয় বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ প্রমীলা ফুটবল দল। কাঠমান্ডুর আর্মি গ্রাউন্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ গার্লস রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ১-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফেরে বাংলাদেশের মেয়েরা। একমাত্র গোলটি করেন মারিয়া মান্দা। এই মারিয়া ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের। এই এলাকার মেয়েরা বিদায়ী বছরে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন নজরকাড়া ধারাবাহিক সাফল্যের মধ্যদিয়ে। কলসিন্দুর বাংলাদেশ মহিলা ফুটবলে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। সেই সাফল্যটা এই কলসিন্দুরের মেয়েদের মাধ্যমেই আসে। প্রথমবার কোন বড় আসরে বাংলাদেশের মেয়ে ফুটলাররা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে। বছরজুড়েই বাংলাদেশের আরেকটি বড় ক্রীড়াঙ্গন হকি ছিল টালমাটাল। সম্ভাবনাময় এ ক্রীড়াটি নানাবিধ বিতর্কে অস্থিরতার মধ্যে কাটিয়েছে। পুরো বছরই মাঠে নামার সুযোগ পাননি খেলোয়াড়রা। দলবদলের দাবিতে জাতীয় দলের ক্যাম্প বর্জন করেন খেলোয়াড়রা এবং ক্লাবগুলো দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। ফেডারেশনের চলমান কমিটির পদত্যাগ দাবি করে ক্লাবগুলো। সে কারণে বড় কোন টুর্নামেন্ট হয়নি। আন্দোলনের কারণে হকি ফেডারেশনে আসে পরিবর্তন। বছরের শেষ দিকে বিজয় দিবস হকি মাঠে গড়ায়। এতে বিকেএসপিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনী। আর খেলার সুযোগ পায় জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা। অন্যান্য ইভেন্টের মধ্যে সাঁতার, এ্যাথলেটিক্স, জিমন্যাস্টিকস ও শূটিংয়ে পুরো বছরই কোন সাফল্য আসেনি। জাতীয় পর্যায়ের ইভেন্টেই ছিল সীমাবদ্ধ। জাতীয় এ্যাথলেটিক্স ও চ্যাম্পিয়নশিপসেও এ্যাথলেটরা আগের মতো সামর্থ্য ও সাফল্য দেখাতে পারেননি। তাই এই ইভেন্টগুলোও গেছে ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে। আরচ্যারিতেও বিগত বছরের সাফল্য দেখা যায়নি। দেশের সেরা আরচ্যাররা ব্যর্থ হয়েছেন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নিজেদের ধারাবাহিকতা রাখার ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক দাবায় তেমন কোন সাফল্য না আসলেও কিশোর মোহাম্মদ ফাহাদ রহমান গর্ব বয়ে এনেছেন দেশের জন্য। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ষষ্ঠ সুয়েনসেন এজ গ্রুপ র‌্যাপিড দাবায় অনূর্ধ্ব-১২ বছর গ্রুপে অপরাজিত থেকে স্বর্ণ জেতেন বাংলাদেশের ক্ষুদে দাবাড়ু ফাহাদ। এ প্রতিযোগিতায় ৬ দেশের মোট ১২৬ জন দাবাড় অংশ নিয়েছিলেন। সেখান থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে স্বর্ণপদক জিতে দেশের নাম উজ্জ্বল করেন ফাহাদ। আর জাতীয় প্রতিযোগিতায় আগের মতোই শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখেন মহিলা ইভেন্টে রানী হামিদ। গত বছর গলফেও আন্তর্জাতিক সাফল্য এসেছিল। সিদ্দিকুর রহমান একের পর এক সাফল্য এনে দিয়েছিলেন বাংলাদেশকে। কিন্তু এ বছর তিনিও ব্যর্থ হয়েছেন ধারাবাহিকতা দেখাতে। আসেনি তেমন কোন সাফল্য। অবশ্য ইনজুরিতে পড়ার কারণে নিজেকে সেভাবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোয় মেলে ধরতে পারেননি তিনি। সবমিলিয়ে একটি ব্যর্থতার বছর গেছে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে।
×