ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫

ঢাকার দিনরাত

বছর শেষ হয়ে এলো। মাঝে দু’দিন, তারপর শুক্রবারে শুরু হচ্ছে নতুন বছর। বিদায়ী বছরে রাজধানীর জীবনে কত কিছুই না ঘটে গেল। রাজধানীর বুকে লেখা হলো কত ইতহাস! তার হিসেব লিখতে বসলে দিস্তে দিস্তে কাগজ লেগে যাবে। সংক্ষেপে মোটা দাগে একটা হিসেব তো নিতেই পারেন ঢাকাবাসী। সবচেয়ে বড় কথা বহু বছর পর এ নগর পেয়েছে নগরপিতা, তাও একজন নয়, জোড়া মেয়র। ঢাকার দুই প্রান্তের দুই নির্বাচিত মেয়র কিছু কিছু ইতিবাচক কাজ শুরু করেছেন, সেটা বলতেই হবে। উভয়ে বাজেট ঘোষণার পাশাপাশি কর্মপরিকল্পনার কথাও শুনিয়েছেন নগরবাসীকে। ঢাকা এমন একটি শহর যেখানে পাহাড়সমান সমস্যা বিরাজ করছে। সেসব সমস্যা ঢাকাই পড়ে আছে বছরের পর বছর। তার কিছু ঢাকনা খুলে নাড়াচাড়া করার জন্যও দুই মেয়র ধন্যবাদ পেতে পারেন। জলজট, যানজটের মতো মহাভোগান্তি লাঘবের চেষ্টা চলছে। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা অবৈধ একটি ট্রাক স্ট্যান্ড রাতারাতি সরে গেছে। সেদিন নিজ বাসাতেই দেখলাম থানা থেকে একটা ফরম এসেছে। আমার এলাকার সব ভাড়াটিয়ার কাছেই এই ফরম পৌঁছানো হয়েছে। তাদের নাম-পেশাগত তথ্যাদি সংরক্ষণ করা হবে। বিদায়ী বছরের প্রাপ্তির কথা বলতে গেলে হয় তো তালিকা খুব বেশি বড় হবে না। আর অপ্রাপ্তির ঝুলি ভারি হয়ে উঠবে। সে পথে না এগিয়ে বরং আশার কথাই বলা যাক। আসন্ন বছরে ঢাকার উন্নতির লক্ষ্যে মেয়রদ্বয় আন্তরিকভাবে কিছু কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন- এমন স্বপ্ন যে আমাদের মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, সেটাও কম বড় প্রাপ্তি নয়। শীতে জবুথবু ঢাকার দিন আর রাত নিয়ে বলার আগে সারা বছরের দিন আর রাতের সময়দৈর্ঘের বিষয়ে একটা তথ্য বলে নেয়া যাক। আমরা পেরিয়ে এলাম ২২ ডিসেম্বর। এদিন বছরের সবচেয়ে ছোট দিন ও সবচেয়ে বড় রাত ছিল। এদিন ঢাকায় সূর্যোদয় হয়েছিল ৫টা ১৭ মিনিটে, আর সূর্যাস্ত গিয়েছিল ৬টা ৩৮ মিনিটে। শীতের রাত যত না বড় তার চেয়ে একটু বেশিই বড় মনে হয় শীতকাতুরেদের কাছে। তার ওপর বছরের সবচেয়ে বড় রাত! বলব শীতে কষ্ট পাওয়া মানুষের কথা। যে কোন বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে আমাদের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে হয় ভাল দিক নিয়ে লিখি, কিংবা লিখি মন্দ দিক নিয়ে। উভয় দিক লেখা হলে বাস্তবতা পুরোপুরি উঠে আসতে পারে। তাছাড়া বাঙালীর তো স্বভাবই আছে তিলকে তাল করা, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লেখা। যা হোক, বলছিলাম বছরের সবচেয়ে বড় রাতটিরই কথা। সেদিন প্রথম ঢাকায় তাপমাত্রা নেমে এলো বারোতে। মানে চলতি মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। সেদিন শ্রীমঙ্গলে ছিল ঢাকার তাপমাত্রার প্রায় অর্ধেক, মাত্র ৬ দশমিক দুই ডিগ্রী সেলসিয়াস। ঢাকার কথাই বলছি। রাস্তায় বস্তার ভেতরে ঢুকে মানুষ শীত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে, এমন একটি ছবি তুলে পাঠালেন আমাদের এক বন্ধু। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না হয় তো। হোমলেস মানুষ কি আমেরিকায় নেই? পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই আছে। তবে ধুলো-ধোঁয়া-শিশির-কুয়াশার আধিক্যের এই শহরে খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন অনেক কষ্টের। সড়কে মাথা গরম ঢাকার সড়কে মড়ক না লাগলেও দুর্ঘটনা থেমে নেই। ট্রাফিক নিয়ম না মানার সংস্কৃতি থেকে চালকেরা বেরিয়ে আসতে পারছে না। গত সপ্তাহে এক বাসচালক তার সামনে অবস্থানরত সিএনজি অটোরিক্সা চালকের ওপর জেনেবুঝে ঠা-া মাথায় গাড়ি উঠিয়ে দিয়েছে। উত্তরার জসীমউদ্দীন রোডের মোড়ে গত মঙ্গলবার ওই কা- ঘটে। বাসচালকের নাম আবদুল মজিদ (২৫), অটোরিক্সাচালকের নাম মোঃ ফারুক (৪০)। এটিকে ঠা-া মাথায় খুন হিসেবে দেখা হচ্ছে। আসলে কি এটি মাথা ঠা-া রাখার ফল? নাকি অতিরিক্ত মাথা গরম করার কারণেই এ ধরনের অমানবিক, বলা ভাল, নৃশংস হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে! রাস্তায় নামলে বাঙালীর ভেতর অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা ও ক্রোধ কেন একটু বেশি কাজ করে সেটা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতে পারে। আগে তো বাঙালী এমন ছিল না। টাঙ্গাঅলার ঘোড়ার গাড়ির চাকায় পথচারীর পায়ের মাংস খানিকটা খুবলে গেলেও আহত ব্যক্তিটি মারার জন্য তেড়ে আসত না। পুরনো ঢাকার এই গল্প তো আমাদের জানা। কাক কাকের মাংস খায় না। কিন্তু মানুষ মানুষের হন্তারক হচ্ছে। এক চালক আরেক চালকের ওপর হামলে পড়ছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে গণপরিবহনের চালকদের নিয়ে পরামর্শসভা করতে হবে। তাদের হাতে যে বহু মানুষের বাঁচামরা নির্ভরশীল এই বোধটুকু তাদের ভেতর ভালভাবে গেঁথে দিতে না পারলে আমাদের বিপদ কিছুতেই কাটবে না। ডাঙায় জাহাজ ডাঙায় জাহাজ থাকে জলে নামার আগে। আবার মাঝসমুদ্রে বিগড়ালেও তাকে টেনে তীরে আনতে হয়। বাংলামোটর মোড় থেকে মগবাজারের দিকে তাকালে বিস্ময়ই জাগবে প্রথম দেখায়- এই ব্যস্ত রাস্তার ওপরে এত বড় জলযান কেন! আসলে এটি জলযান নয়, সেটা কাছে এলে বোঝা যায়। তবে জাহাজের ধরনে পাটাতন আর রেলিং দৃশ্যগোচর হয়। জনকণ্ঠ ভবনের ঠিক সামনেই এটি অবস্থান করছে কয়েক সপ্তাহ ধরে। উড়াল সড়কের কাজ করার জন্য একটি বিশাল যন্ত্র শূন্যে তোলা হয়েছে, তাতে রয়েছে এক জাতীয় ক্রেন। তারই সংযুক্ত অংশে রয়েছে জাহাজমার্কা সব কাঠামো। একটি উন্নয়ন কর্মের নেপথ্যে কত কাহিনীই না গড়ে ওঠে। মগবাজার এলাকার দৃশ্যপটই বদলে দিচ্ছে এই নির্মিয়মান উড়াল সড়ক। যখন এই সড়কটি চালু হবে তখনকার কথা ভেবে ভালই লাগে। সেদিন হয় তো বিশ্বাসই হতে চাইবে না এমন একটা জাহাজমার্কা বিশাল যন্ত্র এসেছিল এই রাস্তায়! কী বিপুল কর্মযজ্ঞে কেটেছিল মাসের পর মাস। ( ছবি দেখুন) বিজয়ের মাসে আরেক ধৃষ্টতা বিজয়ের মাসে ঢাকা কত উজবুকের বকবকানিই না শুনছে! শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গয়েশ্বর রায় আপত্তিকর মন্তব্য করলেন। এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘গয়েশ্বর রায় পাকিস্তানীদের জবান ধার করে কথা বলেছেন। সুস্থ মস্তিষ্কের কোন মানুষ এ কথা বলতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়ে সাত কোটি মানুষকেই কী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যেতে হতো। এ দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ এখানে থেকেই প্রতিরোধ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন, লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁরা তো পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেননি।’ তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এসব বিকৃতি রোধের জন্যই আমরা ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার প্রতিরোধ অপরাধ আইন’ তৈরির দাবি করেছি। ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। শহীদ পরিবারের সন্তান জাহীদ রেজা নূর একটি পোস্টে মোক্ষম জবাব দিয়েছেনÑ ‘ওই কাণ্ডজ্ঞানহীন মুর্খটাকে ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বরের ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়টির দিকে চোখ বোলাতে বলি। সম্পাদকীয়টা পড়তে বলি। পড়ে বুঝতে বলি। ওই ইতিহাসহীন মানুষদের স্মরণ করিয়ে দিই, এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কিন্তু ভারতে আশ্রয় নেয়নি। পৃথিবীর কোন দেশের কোন যুদ্ধেই দেশসুদ্ধ মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেয় না। দেশের ভেতরে থেকেই দেশের জন্য কাজ করা শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েই ঘটেছে, তা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও কি তা দেখা যায়নি? ওই জাতীয়তাবাদী লেবাসধারী মুর্খটাকে বলি, ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাদের হত্যা করা হয়েছে রায়েরবাজারে, কাটাসুরে, তাদের জীবনের ধারাবাহিক ইতিহাসটা দেখুন। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে একাত্তর পর্যন্ত তাদের কাজের ধারাবাহিকতা দেখুন, তারপর কোন মন্তব্য করুন। দয়া করে আলী আহসান মুজাহিদ বা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরহে এ রকম উন্মাদ হয়ে যাবেন না। বরং এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে শুরু করুন এবং প্রেসব্রিফিং করে তার উত্তরগুলো দিন- ১. দালাল আইন বাতিল করার সময় কার হাতে ক্ষমতা ছিল? বলতে চাইছি, সে সময় সামরিক বাহিনীর হর্তাকর্তা অর্থাৎ সিএমএলএ (চীফ মার্শাল ল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর) ছিল কে? নামটি যে জিয়াউর রহমান, তা বোধ করি আপনার জানা আছে। ২. স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমান যখন একটি দল তৈরি করলেন এবং সেই দলের প্রধানমন্ত্রী করলেন শাহ আজিজুর রহমানকে, তখন তার ব্যাখ্যা কী ছিল? শাহ আজিজের একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে কয়েকটি বাক্য বলুন হে জনাব! ৩. মশিউর রহমান যাদু মিয়া ছিলেন সিনিয়র মন্ত্রী। তিনি একাত্তরে কী করেছেন, জানেন কী? ৪. জিয়াউর রহমান অভুত্থানের ধুয়ো তুলে মুক্তিযোদ্ধা সেনা ও অফিসারদেরই কেন বার বার হত্যা করলেন? বলতে পারেন জিয়ার মনে কী ছিল? ৫. খালেদা জিয়া দুই চিহ্নিত আল বদর নেতাকে মন্ত্রী বানালেন, সেটা কি তার মুক্তিযুদ্ধ প্রীতি থেকে? গয়েশ্বর রায়, আপনার বাকপটুতা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই আমার মনে। এ রকম একটি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন আপনি, যে দল সারাজীবন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদেরই মদদ দিয়েছে। সে দলের হয়ে কথা বলতে হলে কাণ্ডজ্ঞান, সুরুচি লাগে না, শুধু বাকপটু হলেই চলে। আপনি দয়া করে বলুন, আপনার নেত্রী খালেদা জিয়া ‘হানাদার’ আর তাদের ‘দোসর’ বলতে কী বোঝেন? কারা এরা? এদের কি কোন পরিচয় আছে নাকি তাদের নাম করতে নেই।’ বর্ষশেষের রাত! কাল বাদে পরশু বছরের শেষ সূর্য অস্তমিত হবে; মধ্যরাতে ঢাকা মেতে উঠবে ইংরেজী নববর্ষ বরণে। থার্টি ফার্স্ট নাইটের জন্য অনেকেই ‘থার্স্টি’ থাকেন। ক্লাবে ক্লাবে জমকালো পার্টি হয়। তরুণেরা নেমে আসে রাস্তায় দল বেঁধে। মুহুর্মুহু বাজির শব্দে উৎসব হয় আরও মাতোয়ারা। উৎসবে স্ফূর্তি তো প্রাণেরই স্ফুরণ। তবে তার একটা সীমারেখা থাকা চাই। আমরা চাই উৎসব হোক শালীন, সভ্য, সুন্দর। আমার আনন্দ অন্যকে পীড়িত যেন না করে। অপরের কষ্ট ও বিরক্তি বাড়িয়ে যেন আনন্দ লাভ না করি। মধ্যরাতে কেক কাটা হোক, বাজি ফোটানো হোক, চলুক খানাপিনা নাচ-গান। সীমা লঙ্ঘন না করলে অসুবিধে কী! কিন্তু নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে গিয়ে আমরা একেবারে নতুন কিছু কি করতে পারি না? থার্টি ফার্স্ট নাইটে আমরা কি দল বেঁধে আনন্দে গা ভাসিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ করেই কমলাপুর রেল স্টেশন, কিংবা পথের ধারে ফুটপাথে অথবা কোন বিহ্বল বস্তিতে গিয়ে শীতে কষ্ট পাওয়া মানুষের হাতে হাতে কম্বল তুলে দিতে পারি না? শুভ হোক নতুন বছর। হ্যাপি নিউ ইয়ার। ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ [email protected]
×