ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী কানেকশন, শনাক্ত হয়নি হামলাকারী, এলাকায় আতঙ্ক

বাগমারার মসজিদে আত্মঘাতী বোমায় হত ১, আহত ১০

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫

বাগমারার মসজিদে আত্মঘাতী বোমায় হত ১, আহত ১০

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ অতি সম্প্রতি বগুড়ায় শিয়া মসজিদে নামাজে গুলির ঘটনার পর এবার রাজশাহীর বাগমারার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি আহমদিয়া মসজিদে জুমার নামাজের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় একজন নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় আরও অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। আহতরা সবাই জুমার নামাজের মুসল্লি। শুক্রবার জুমার নামাজ চলাকালে মুসল্লিবেশে এ আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়। ঘটনার পর থেকে এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, উপজেলার মচমইল সৈয়দপুর চকপাড়া আহমদিয়া মুসলিম জামাতের ওই মসজিদে দুপুর দেড়টার দিকে জুমার নামাজ শুরুর পর দ্বিতীয় রাকাতে এক যুবক পোশাকের নিচ থেকে বোমা বের করে বিস্ফোরণ ঘটায়। বিস্ফোরণে হামলাকারী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তবে তার পরিচয় জানা যায়নি। এ ঘটনার সঙ্গে জঙ্গী সম্পৃক্ততার ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঘটনার পর পরই আহতদের মধ্যে ময়েজ উদ্দিন (৪০), সায়েব আলী (৩৫) এবং নয়ন নামে ১২ বছরের এক বালককে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনই ওই মসজিদে নামাজ পড়েন। বিস্ফোরণের পর পুলিশ মসজিদটি ঘিরে রেখেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত হামলাকারীর লাশ সেখানেই ছিল। রাতে এশার নামাজের আগে তার লাশ উদ্ধারের পর আবার সেখানে পুলিশের পাহারায় নামাজ আদায় করেছেন মুসল্লিরা। কারা এ হামলা চালিয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ২০০৩-০৪ সালে এই বাগমারা এলাকাতেই জেএমবির শূরা কমিটির প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ বা জেএমজেবি নামে একটি জঙ্গী দল সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। মসজিদের ইমাম সৈয়দ গোলাম মোস্তফা ও মসজিদ কমিটির সভাপতি এসএম সাইফুল ইসলাম জানান, ৬০-৬৫ জন মুসল্লি জুমার নামাজ আদায় করছিলেন। এদের মধ্যে শিশু এবং নারীও ছিলেন। দ্বিতীয় রাকাত নামাজ শুরু হলে রুকুতে যাওয়ার সময় সামনের সারির বাঁ দিকের এক যুবকের কোমরে বাঁধা বোমাটি প্রচ- শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এ সময় সবাই দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করে। তখন পাশের একটি আহলে হাদিসের মসজিদের মুসল্লিরা এগিয়ে এসে আহতদের উদ্ধার করে মসজিদ থেকে বাইরে নিয়ে আসে। এ সময় হামালাকারী যন্ত্রণায় ছটফট করলেও আরও বোমা বিস্ফোরণের ভয়ে কেউ তাকে উদ্ধারে এগিয়ে না যাওয়ায় কয়েক মিনিটের মধ্যে তার মৃত্যু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিস্ফোরণের পর পরই আহমদিয়া ওই মসজিদের পাশে থেকে এক যুবককে দৌড় দিয়ে যেতে দেখেন তারা। পরে ওই গ্রাম সংলগ্ন চকপাড়া-সৈয়দপুর পাকা রাস্তায় অপেক্ষমাণ একটি মোটরসাইকেলে করে দুজনকে দ্রুত চলে যেতে দেখেন অনেকে। খবর পেয়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী, পুলিশ সুপার নিশারুল আরিফ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম, উপজেলা চেয়ারম্যান জাকিরুল ইসলাম সান্টু ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসিফ মাহমুদ তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে ছুটে যান। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন র‌্যাব-৫ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহাবুব আলম ও সহকারী পুলিশ সুপার আসলাম উদ্দিন। এ ছাড়াও সিআইডির ক্রাইম সিন, বিস্ফোরক টিম, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পিবিআই, ও এনএসআইর কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বাগমারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মতিয়ার রহমান জানান, হামলাকারীর কোমরে বিস্ফোরক বেল্ট পাওয়া গেছে। এ থেকে ধারণা করা যায় বোমাটি তার সঙ্গেই বাঁধা ছিল। শুক্রবার সন্ধ্যায় পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের মর্গে পাঠিয়েছে। রাজশাহীর অতিরিক্ত ডিআইজি মাহমুদ ঘটনাস্থলে পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের জানান, বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাটি আত্মঘাতী না অন্য কোনভাবে সংঘটিত হয়েছে তা তদন্তসাপেক্ষে জানা যাবে। যেভাবে ঘটল আত্মঘাতী বোমা হামলা ॥ রাজশাহীর বাগমারায় মচমইল সৈয়দপুর এলাকার কাদিয়ানী মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় হামলাকারী নিজেই নিহত হয়েছে। একজন যুবক এ হামলা চালায়। যুবকটি যেভাবে এ আত্মঘাতী বোমা হামলা ঘটিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় তা উঠে এসেছে। এ হামলায় গুরুতর আহত সায়েব আলীর ভাতিজা সান্টু রহমান জানান, তার চাচা সায়েব আলী ও তিনি ওই মসজিদে নামাজ পড়তে যান। মসজিদে দুপুর ১টা ২০ মিনিটের দিকে জুমার নামাজ শুরু হয়। তার চাচা মসজিদে যে কাতারে নামাজ আদায় করছিলেন, একই কাতারে হামলাকারী যুবকও নামাজ আদায় করছিলেন। জুমার নামাজ শুরুর পর প্রথম রাকাত আদায় হয়। দ্বিতীয় রাকাতে যাওয়ার সময় দুষ্কৃতকারী ওই যুবক তার কোমরে থাকা বোমা বের করতে গেলে তা বিস্ফোরিত হয়। এতে হামলাকারী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। অন্যরা আহত হন। সান্টু রহমান অন্য কাতারে নামাজ আদায় করায় তিনি আহত হননি বলে জানান। সান্টু রহমান আরও বলেন, মসজিদে নামাজ আদায়ের শুরুতে অপরিচিত ওই যুবককে দেখে মুসল্লিরা তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। মুসল্লিদের প্রশ্নের জবাবে হামলাকারী যুবক বলেছিলেন, তার বাড়ি মোহনপুরে। রাজশাহী পলিটেকনিকে পড়েন। এক বন্ধুর বাসায় তিনি এসেছেন। সেখান থেকে এই মসজিদে নামাজ আদায় করতে এসেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, যুবকটির বয়স ২২ থেকে ২৩ বছরে মধ্যে। জিন্সের প্যান্ট পরা যুবকটির গায়ে ছিল কালো রঙের জ্যাকেট। সেই জ্যাকেটের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল বোমাটি। হামলাকারী ৩ জন, দূরে প্রস্তুত ছিল মোটরসাইকেল ॥ প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী হামলাকারীরা ছিল তিনজন। এদের একজন নামাজ চলাকালীন আত্মঘাতী হামলা চালায় ও অপর দুইজন মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যায়। মুসল্লিদের কয়েকজন জানান, দ্বিতীয় রাকাত নামাজ শুরু হলে রুকুতে যাওয়ার সময় বোমাটি প্রচ- শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এ সময় সবাই দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করে। তখন পাশের একটি আহলে হাদিস মসজিদের মুসল্লিরা এগিয়ে এসে আহতদের উদ্ধার করে মসজিদ থেকে বাইরে নিয়ে আসে। বিস্ফোরণের পর পরই আক্রান্ত আহমদিয়া মসজিদের পাশ থেকে এক যুবককে দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখেন তারা। পরে ওই গ্রাম সংলগ্ন চকপাড়া- সৈয়দপুর পাকা রাস্তায় অপেক্ষমাণ একটি মোটরসাইকেলে করে ওই যুবকসহ দুজনকে দ্রুত চলে যেতে দেখেন মুসল্লিরা। বাগমারার মচমইল চকপাড়া গ্রামটি প্রত্যন্ত পল্লীতে। যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই নাজুক। এ এলাকায় বসবাস করে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের কিছু লোকজন। মচমইল চকপাড়া কাদিয়ানী জামে মসজিদে তারা নামাজ আদায় করেন। বোমা হামলার সময় মসজিদে নামাজ আদায় করছিলেন মুসল্লিরা। টার্গেট ছিল হাটবার ॥ শুক্রবার ছিল সেখানে হাটবার। এদিন ওই মসজিদে নামজ পড়েন হাটুরেরাও। সেই সুযোগ নিয়ে হামলাকারীরা রাজশাহী বাগমারা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের (কাদিয়ানী) মসজিদে আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। এদিন মচমইল বাজারে বসে বিশাল পানের হাট। স্থানীয়রা জানান, মচমইল বাজারে সপ্তাহে চারদিন হাট বসে। এরমধ্যে শুক্র ও সোমবার পান এবং বাঁশের হাট বসে। রবিবারে বসে গরুর হাট আর বুধবার সাধারণ হাট। হাটের দিনে ওই মসজিদে বাইরের অনেক মুসল্লি নামাজ পড়তে আসেন। একই গ্রামে পাশাপাশি তিনটি মসজিদ আছে। একটি কাদিয়ানী, একটি হানাফি ও অন্যটি আহলে হাদিস। যে যে সম্প্রদায়ের লোকজন ওইসব মসজিদে নামাজ আদায় করেন। কাদিয়ানী মসজিদটি ছিল মাঝখানে। মুসল্লিদের কয়েকজন জানান, জুমার আজানের পরপরই দুইজন অপরিচিত ছেলে মসজিদে প্রবেশ করে। অনেকেই তাদের পান বিক্রেতাও মনে করেন। অপরিচিত হিসেবে কয়েকবার কথাও হয় তাদের সঙ্গে। হাটবার ছাড়া পরিচিতরাই ওই মসজিদে নামাজ পড়ে থাকেন। যারা ওই মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি তাদের সবাই চেনা। কিন্তু ওই দুই ছেলে পরিচিত ছিল না। অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা ॥ এদিকে মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনায় অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। শুক্রবার রাতেই বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলাটি দায়ের করা হয়। বাগমারা থানার ওসি মতিয়ার রহমান মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। হামলার পর পুলিশ পাহারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ ওই মসজিদে এশার নামাজ আদায় করেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বোমা বহনকারী নিহত যুবকের পরিচয় মেলেনি। হামলাকারী যুবকই বোমা বহনকারী ॥ এদিকে ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে বোমা হামলাকারী অজ্ঞাত পরিচয় সেই দুষ্কৃতকারী যুবকের। তার মরদেহ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। ময়নাতদন্তে মসজিদে হামলাকারী যুবকই বোমা বহনকারী বলে নিশ্চিত হয়েছেন চিকিৎসক। শনিবার দুপুরে নিহত যুবকের ময়নাতদন্ত শেষে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. এনামুল হক বলেন, ওই যুবক বোমার আঘাতেই মারা গেছেন। কারণ তার শরীরে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ছাড়া ময়নাতদন্তের সময় তার লিভার থেকে চারটি স্পিøন্টার বের করা হয়েছে। বহনকৃত বোমাটি বাঁ দিকে থাকায় তার শরীরের বাম অংশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাম হাতও ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। তবে তার পরিচয় এখনো সনাক্ত হয়নি। দিনের মধ্যে পরিচয় পাওয়া না গেলে আজ রবিবার বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করার জন্য স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে পাঠানো হবে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। আইএসের দায় স্বীকার বিডিনিউজ জানায়, বাগমারায় আহমদিয়া মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় আইএস জড়িত বলে দাবি করেছে ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ’। জঙ্গী তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাটির ওয়েবসাইটে শনিবার আইএসের একটি বার্তা প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে এ হামলায় দায় স্বীকারের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, টুইটার ও টেলিগ্রামে বিবৃতি পাঠিয়ে বাংলাদেশের রাজশাহীতে মসজিদে হামলার কথা জানিয়েছে আইএস। আইএসের বরাত দিয়ে সাইট ইন্টিলিজেন্সের রিপোর্টে বলা হয়, ‘আবু আল-ফিদা আল বেঙ্গলি’ নামে তাদের এক অনুসারী এই হামলা চালায়। এতে কয়েক ডজন হতাহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে আইএস। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আইএসের নামে যে টুইট করা হয়েছে তা বাংলাদেশে থেকেই গেছে। গোয়েন্দারাও আইএস সংশ্লিষ্টতার কোন ভিত্তি খুঁজে পাননি।
×