ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাফল্য হিসেবে দেখছে ইআরডি ;###;ব্যবহার বাড়াতে নানা কৌশল ;###;চুয়াল্লিশ বছরে ৩৪ কোটি থেকে বেড়ে ২ হাজার একশ’ কোটি ডলার ;###;বছরে ব্যয় হচ্ছে তিন শ’ কোটি ডলারের বেশি

পাইপলাইন দীর্ঘ হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫

পাইপলাইন দীর্ঘ হচ্ছে

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ স্বাধীনতার পর ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তার পাইপলাইন ছিল মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। যা এখন বেড়ে মহীরূহের আকার ধারণ করেছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ১ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। দিন দিন এই পাইপলাইন দীর্ঘ হচ্ছে। বলা হচ্ছে দাতাদের প্রতিশ্রুতি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ছে এর আকার। অবশ্য পাইপলাইন বাড়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও উন্নয়ন সহযোগীরা। তারপরও চলতি অর্থবছর থেকে যাতে বৈদেশিক সহায়তার সর্বোচ্চ ব্যয় বাড়ানো যায় সেজন্য বিশেষ কৌশল নিয়েছে ইআরডি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, পাইপলাইন বাড়ছে এটা ইআরডির জন্য সাফল্য। কেননা আমরা সফলভাবে নেগোসিয়েশন করতে পেরেছি বলেই এত প্রতিশ্রুতি এসেছে। তিনি জানান, প্রতিবছর ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আমরা বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় করছি। তাছাড়া একবারেই যে এত টাকা জমে আছে তা নয়, ব্যয় হচ্ছে আবার জমা হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিশ্রুত অর্থ চুক্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো একবারে ছাড় হয় না, ধাপে ধাপে এ অর্থছাড় এবং ব্যয় হয়। সুতরাং পাইপলাইন কখনওই খালি হবে না। তিনি বলেন, আগামী ৩-৪ বছর বড় বড় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হলে একবারেই অনেক টাকা ব্যয় হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অর্থ ব্যয় করার দায়িত্ব আমাদের নয়, এটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর। তারা যত বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে ততই অর্থ ব্যয় হবে। তবে পাইপলাইনের জমানো অর্থ ব্যয় যাতে বাড়ানো যায় সেজন্য সব সময়ই নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। এ বছর যাতে সর্বোচ্চ ব্যয় বাড়ে সেজন্য আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। ইআরডির একাধিক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, দাতাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায়ে তারা সফল হয়েছে। কেননা প্রতিশ্রুতি হলেই তো পাইপলাইনে যুক্ত হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তো আর ব্যয় করা যায় না। যে কোন প্রকল্প শুরু হতেই এক দুই বছর সময় লেগে যায়। এ সময়ে প্রতিশ্রুত অর্থ পাইপলাইনে জমা ধরা হয়। আর একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দাতারা যে পরিমাণ অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয় তা তো এক বছরেই ছাড় হয় না। ওই অর্থছাড় হয় কয়েক অর্থবছরে একটি নিদিষ্ট পরিমাণে। ফলে পাইপলাইন বড় হচ্ছে। সূত্র জানায়, ইআরডির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ বছরের জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৬৫ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পাইপলাইনে ছিল ১ হাজার ৬৬৩ কোটি মার্কিন ডলার। এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৫৪৩ কোটি ডলার পাইপলাইনে ছিল। তার আগে ২০১০-১১ অর্থবছর শেষে ছিল ৮৮৬ কোটি মার্কিন ডলার। ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে ছিল ৫৯৭ কোটি ডলার। তার দশ বছর আগে ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে পাইপলাইনে ছিল ৫৩৪ কোটি ডলার। ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে ছিল ২৫২ কোটি মার্কিন ডলার এবং ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে ছিল ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। চুক্তিবদ্ধ বৈদেশিক সহায়তার সবচেয়ে বেশি অর্থ পাইপলাইনে রয়েছে বিশ্বব্যাংকের। উন্নয়ন সহযোগী এ সংস্থাটির ৫০০ কোটি ডলারের বেশি পাইপলাইনে রয়েছে। এরপর রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি), জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) এবং চীন। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, পাইপলাইনের জমানো এ অর্থ খারাপভাবে নেয়ার কিছু নেই। কেননা যদি কমিটমেন্ট না হয় তাহলে অর্থছাড় হবে কিভাবে। তাই কমিটমেন্ট বেশি হয়েছে এটা দোষের কিছু নয়। তবে যে বিষয়টি দেখা যায় সেটি হচ্ছে কমিটমেন্ট হওয়ার পরই একটি ঢিলেঢালা ভাব। আর এ পর্যায়েই দীর্ঘসূত্রিতা বিরাজ করে। কেননা ক্রেডিট এফেকটিভ করার জন্য যেসব কাজ করতে হয় যেমন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ, প্রকল্প অফিস তৈরি ও ভূমি অধিগ্রহণ ইত্যাদি কাজ করতে গিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি হয়। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে টেন্ডার প্রক্রিয়া, ইভ্যালুয়েশন পর্যায়ে অনেক সময় ঝঞ্ঝাট তৈরি হয়। তখন আবার রিটেন্ডারিং করতে হয়। এসব করতে গিয়ে অনেক সময় চলে যায়। পাইপলাইন বাড়ে। সূত্র জানায়, বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যয় বাড়াতে ইআরডি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে। এ নির্দেশনায় স্বল্পমেয়াদে ছয়টি এবং দীর্ঘমেয়াদে চারটি নির্দেশনা দেয়া হয়। স্বল্পমেয়াদী নির্দেশনা ॥ পাইপলাইনে জমে থাকা অর্থের সর্বোচ্চ ও সময়োচিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে ঋণ ও অনুদান চুক্তি কার্যকর হয়েছে সেগুলোর বৈদেশিক সাহায্যের অর্থছাড় ধীর বলে প্রতীয়মান হলে সেগুলো চুক্তির তালিকা তৈরি, হালনাগাদকরণ ও নিয়মিত পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পরবর্তী ৫ বছরে ৮০ শতাংশের কম, ৩ বছরে ৫০ শতাংশের কম এবং চুক্তি কার্যকর হওয়ার এক বছর পরে ন্যূনতম ১০ শতাংশ অর্থছাড় হয়নি। এরূপ চুক্তিগুলোকে ধীর গতিসম্পন্ন বিবেচনা করে এসব প্রকল্প অনুবিভাগে নিবিড় তদারকি এবং পরিবীক্ষণের আওতায় আনতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্ভূত সমস্যা দূর করতে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীদের অধিকতর সমন্বয় প্রতিষ্ঠা এবং অর্থছাড়ে বিলম্ব পরিলক্ষিত হয় এরূপ প্রকল্পের বাস্তবায়নে পরিবীক্ষণ জোরদার করার জন্য ইআরডিতে নিয়মিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করা। প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্ভূত সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তা দূরীকরণে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীদের গৃহীত ব্যবস্থা পর্যালোচনা। প্রকল্পের ডিপিপি/টিপিপি অনুযায়ী অর্থছাড় এবং প্রকৃত অর্থছাড়ের মধ্যে পার্থক্য পর্যালোচনা করা। বেশি পার্থক্য হলে সেক্ষেত্রে করণীয় নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করা। এছাড়া যেসব প্রকল্প চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে কিন্তু দুই মাসের মধ্যে কার্যকর করা যায়নি তার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী নির্দেশনা ॥ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুততর করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের অনুমোদন সীমা নির্ধারণ বা প্রাক অনুমোদন পদ্ধতি প্রবর্তন বা কান্ট্রি অফিসের ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করা। যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ কারিগরি জ্ঞান বা ব্যাপক প্রস্তুতিমূলক কাজ প্রয়োজন হবে সেসব প্রকল্পের ফাইন্যান্সিং এগ্রিমেন্ট দুটি পর্যায়ে অর্থাৎ প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য এবং পরবর্তী পর্যায়ে মূল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য করার সম্ভাব্যতা পরীক্ষা। প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে প্রকল্প বাস্তবায়নের রেডিনেস যাচাইয়ের জন্য ইন্ডিকেটর নির্ধারণ করা এবং প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু করতে ডিপিপি বা টিপিপি অনুমোদনের পরে কমিটমেন্টের ১০ শতাংশ অগ্রিম হিসাবে ডিসবার্সমেন্ট করার বিধান চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা সে বিষয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করা। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্প দলিল প্রণয়ন, অনুমোদন, জমি অধিগ্রহণ, অর্থায়ন, পরিবেশ-সংক্রান্ত অনুমোদন ও কারিগরি জটিলতায় বাস্তবায়ন দেরি হয়। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, পরামর্শক নিয়োগে বিলম্ব, ত্রুটিপূর্ণ ক্রয় পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়া, কার্যাদেশে বিলম্ব বৈদেশিক অর্থছাড় না হওয়া অন্যতম কারণ। এছাড়া ভূমি গ্রহণে জটিলতা, প্রকল্প পরিচালকের অপর্যাপ্ত আর্থিক ক্ষমতা ও প্রকল্পের ত্রুটিপূর্ণ ব্যয় প্রাক্কলনসহ কয়েকটি কারণে থমকে গেছে অনেক প্রকল্প।
×