ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মূল : লাইস ডাউসেট;###;অনুবাদ : ইব্রাহিম নোমান

স্বপ্নপূরণের দিশারী ‘দুই মালালা’

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫

স্বপ্নপূরণের দিশারী ‘দুই মালালা’

জর্ডানের মরুভূমি সংলগ্ন একটি শরণার্থী শিবির। গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। স্কুল বন্ধ। ছুটির অবসরে ছোট্ট মেয়েটি পড়ছে ইংরেজী। ভাববার সময় নেই জীবন থেকে কী হারিয়েছে সে। ভাবছে ভবিষ্যতে কী করতে হবে। তার চোখে আগামীদিনের পড়াশোনা ও নতুন বইয়ের স্বপ্ন। কেবল নিজের জন্য নয়, তার ভাবনা সমবয়সী আরও অনেককে নিয়ে। সব মেয়ে পড়ালেখা শিখে বড় হবে, সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচবে এমনটাই আশা তার। নিজের বয়সী লাখো মেয়েকে মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখানো মুজন। কি অবাক হচ্ছেন! এমন স্বপ্ন, চিন্তা-চেতনা তো অন্য কারও সঙ্গে মিলে যাচ্ছে? মিলে যাচ্ছে মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে। অবহেলিত শিশুদের শিক্ষার মাধ্যমে স্বপ্নপূরণের দিশারী এখন ‘দুই মালালা’। মুজন আল মেলেহানের বয়স মাত্র ১৭। সিরিয়ার এই কিশোরী দেখেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা। যুদ্ধের তাণ্ডবে সে হারিয়েছে নিজের বাড়ি, স্কুল আর প্রিয় খেলার মাঠ। বাবা-মা, তিন সহোদরসহ ঠাঁই হয়েছিল সিরিয়া সীমান্ত থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরে জর্ডানের এই আশ্রয় শিবিরে। শিবিরের জনবহুল, বিশৃঙ্খল আর অতি সংকীর্ণ বাসায় দিন কাটলেও ওর চোখে আলোকিত আগামীর স্বপ্ন। গত দুই বছর সে বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ঘুরে ঘুরে মেয়ে শিশুদের পড়াশোনার ব্যাপারে প্রচার চালিয়েছে। বাবা-মাদের বুঝিয়েছে তারা যেন মেয়েদের স্কুলে পাঠান। তার চেষ্টায় স্কুলগামী হয়েছে অনেকে। চারদিকের ধ্বংসযজ্ঞের মাঝেও লাখো মেয়ের মনে স্বপ্ন বুনে দেয়ার জন্য মুজন পরিচিতি পেয়েছে ‘সিরিয়ার মালালা’ নামে। অদম্য মুজন তাই মালালাকে গ্রহণ করেছে আদর্শ হিসেবে। ২০১৩ সালে সিরিয়ায় আসাদবিরোধী যোদ্ধা ও সরকারী বাহিনীর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ায় মুজন সপরিবারে জর্ডানে পাড়ি জমায়। প্রথম এক বছর জাতারি শরণার্থী শিবিরে কাটানোর পর তারা আশ্রয় নেয় আজরাকে। প্রতিদিন প্রায় ৬০টি করে বাস্তুচ্যুত পরিবার সেখানে আশ্রয় নিত। মানবসৃষ্ট দুর্যোগে অনেক কিছু হারালেও কোন দুঃখবোধ মুজনকে স্পর্শ করতে পারেনি। তার ভাবনা কেবল পড়াশোনা নিয়ে। মুজনের মতে, মানুষের জীবনে শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শিক্ষা এমন একটি হাতিয়ার যা আমাদের জীবন বদলে দিতে পারে। এর মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। আর পড়াশোনা ছাড়া আত্মনির্ভরশীল হওয়া যায় না। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মালালা জর্ডানের শরণার্থীদের শিবিরে এসে মুজনের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। পরে মুজন নরওয়ের অসলোতে মালালার নোবেল পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানেও যোগ দেয়। বিশ্বের নারী শিক্ষা আন্দোলনের আলোচিত এ কর্মীর সঙ্গে বন্ধুত্ব মুজনের জীবনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য : আমি গর্বিত যে, আমাকে ‘সিরিয়ার মালালা’ নামে ডাকা হচ্ছে। মেয়েদের শিক্ষার পাশাপাশি মুজনের ভাবনার বড় অংশজুড়ে আছে দেশ। তার আশা, শীঘ্রই সিরিয়ায় সর্বগ্রাসী এ যুদ্ধ থামবে। শান্তি আসবে দেশের প্রতিটি প্রান্তে। তার বয়সী মেয়েরা আবার ফিরে পাবে নিজের বাড়ি, আঙ্গিনা, স্কুল। হৈহুল্লোড় করতে করতে আবার তারা ফিরবে প্রিয় খেলার মাঠে। এমন স্বপ্ন এখন মুজনের দু’চোখজুড়ে। নোবেল পুরস্কার জয়ী শিক্ষা অধিকারকর্মী মালালা ইউসুফজাই সিরিয়ার স্কুল শিক্ষার্থী মুজন আল মেলেহানের সঙ্গে দেখা করেছেন। মুজন যুক্তরাজ্যে পৌঁছালে দুজনের মধ্যে দেখা হয়। এর আগে মুজন ও মালালার দেখা হয় জর্ডানের এক শরণার্থী শিবিরে। প্রায় দুই বছরের ব্যবধানে আবারও দেখা হওয়ার পর সিরিয়ার শরণার্থী শিশুদের মধ্যে শিক্ষার প্রচার চালাবেন বলে অঙ্গীকার করেন এই দুই কিশোরী। মুজন বলেন, ‘আমরা সবসময়ই একসঙ্গে কাজ করতে চেয়েছি। এখন থেকে তা পারব।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এমন দিন আসবে যখন তার দেশে কোন যুদ্ধবিগ্রহ থাকবে না। সিরিয়াকে নতুন করে গড়ে তুলতে হলে শরণার্থী শিবিরের হাজার হাজার শিশুকে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে রাখলে চলবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। আর মালালা বলেন, ‘দ্য মালালা ফান্ড’ নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সিরিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি বেকাভ্যালির একটি বিশেষ স্কুল চালু করেছে। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী ২০০ মেয়ে এই স্কুলটিতে পড়তে পারবে। জর্ডানে কয়েকটি স্কুলে পড়ুয়া মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। এদের একজন তাকে বলেছিলেন, ‘তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে আমাদের খুবই ভাল লাগছে, কিন্তু তুমি নও, শিক্ষার বিষয়ে আমাকে আগ্রহী করেছে মুজন।’ ২০১২ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানে তালেবানের গুলিতে গুরুতর আহত হন মালালা। চিকিৎসার জন্য তিনি সপরিবারে যুক্তরাজ্য যান। বর্তমানে সেখানেই তিনি লেখাপড়া করছেন। সঙ্গে বিশ্বের শিশুদের জন্য, বিশেষত বালিকাদের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মালালা। নারী শিক্ষায় অবদান রাখার জন্য মালালা ইউসুফজাই ২০১৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। তার সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পান ভারতের শিশু অধিকারকর্মী কৈলাস সত্যার্থী। মালালাই এ যাবতকালে সবচেয়ে অল্পবয়সী নোবেল বিজয়ী। এ ছাড়াও টাইম ম্যাগাজিনের ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের জরিপে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ জনের তালিকায় আসে তার নাম। অন্যদিকে মুজন সিরিয়ার শরণার্থী শিবিরে থেকেও নারী শিক্ষার প্রসারের চেষ্টা চালান। কন্যাশিশুদের বিয়ে দেয়ার বদলে বাবা-মার প্রতি তাদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার আহ্বান জানান মুজন। মুজনই শরণার্থী শিবির থেকে ব্রিটেনে আসা প্রথম সিরিয়ান। যুক্তরাজ্যে শুধু দুই শিক্ষাব্রতীই মিলিত হননি, মালালা ও মুজনের পরিবারও একসঙ্গে বসে নিবিড় সময় কাটিয়েছেন। তবে অভিভাবকরা পরস্পর কথা বলেছেন আরবী অনুবাদকের সাহায্য নিয়ে। মুজনের মতে, ‘নতুন কিছু শুরু করা সব সময়ই কঠিন। তবে শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তা সহজ হয়ে যায়। আমার ইংরেজী এখন আগের চেয়ে বেশি সাবলীল। মালালা ও আমার উদ্দেশ্য এক হওয়ায় আমরা খুব সহজেই ভাব বিনিময় করতে পারছি। আর এখন আমি ইংরেজীতে স্বাচ্ছন্দ্য হওয়ায় সাংবাদিকতারও স্বপ্ন দেখি। যুক্তরাজ্য আগামী পাঁচ বছরে বিশ হাজার সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মালালা ও আমি হিসাব করেছি বিশ্বের অন্য ধনী রাষ্ট্রগুলো যদি পঞ্চাশ হাজার বা পঁচিশ হাজার করেও শরণার্থীকে আশ্রয় দেয় তাহলে সিরীয় শিশুরা পাবে বেঁচে থাকার অধিকার। তবে যদি বিশ্বের অন্য প্রান্তে তাদের কান্নার শব্দ পৌঁছে।’ [email protected] সূত্র : বিবিসি
×