ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মেহেরুননেছা

বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫

বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে

‘বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ’ গ্রন্থের রচয়িতা এ দেশের গণমানুষের অর্থনীতিবিদ খ্যাত অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। ১৫ আগস্ট ২০১৫-তে প্রকাশিত গ্রন্থটির শিরোনামটা বেশ বড়। পূর্ণ শিরোনাম ‘বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ : বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে কোথায় পৌঁছতো বাংলাদেশ? সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব প্রভুত্বের যুগে সমতাবাদী সমাজ বিনির্মাণের সম্ভাব্যতা প্রসঙ্গে।’ ব্যতিক্রমী এ গ্রন্থটি পাঠ শেষে মনে হলো এটি রাজনীতি-অর্থনীতি-বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতি, ইতিহাস, সমাজনীতি সংশ্লিষ্ট এক দার্শনিক মহাকাব্য। গ্রন্থটির শিরোনাম আপাতদৃষ্টে সহজ-সরল মনে হলেও বিষয়টি আসলেই স্বল্প-গবেষিত ও জটিল। তথ্য ও তত্ত্বসমৃদ্ধ এ গ্রন্থটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যাপক চিন্তা উদ্রেগের এক একটি সমন্বিত সমাহার। অধ্যাপক আবুল বারকাত রচিত এ গ্রন্থটি পাঠ করে ‘মহাকাব্য’ মনে হলো অন্তত চারটি কারণে। কারণ চারটি হলো : ১. মহান মুক্তি সংগ্রাম-এর পেছনের ও পরবর্তী ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন ও প্রজ্ঞাবান-দূরদর্শী রাজনীতিকে সম্ভবত এই-ই প্রথম কোন একটি গ্রন্থে গভীর চিন্তা উদ্রেগকারী দার্শনিক রূপ প্রদান করা হয়েছে; ২. এ গ্রন্থে ঐ রূপ-রূপসমূহের খুঁটিনাটিসহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে; ৩. শোষণহীন-বঞ্চনামুক্ত- বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও সমাজ এবং অসাম্প্রদায়িক মানুষের বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছিলেন তা বাস্তবায়ন সম্ভাব্যতা প্রসঙ্গটি নিখুঁতভাবে উত্থাপন ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে; এবং ৪. সম্পূর্ণ বিষয়টিকে দেখা হয়েছে সমগ্রতার নিরিখে, খ-িতভাবে নয় এবং কামরাভুক্তভাবে নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বেঁচে থাকলে’ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্র কাঠামো কেমন হতে পারত তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধ্যাপক বারকাত বলেছেন- ‘এ দৃশ্যকল্প রচনা অনেকের কাছেই ভাগ্যগণনা শাস্ত্রের (!) মতোই মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অনেকের কাছেই এও মনে হতে পারে যে, এ ধরনের হিসেব-পত্তরের ভিত্তি দুর্বল, আর সেজন্য এ নিয়ে সময় ব্যয়, সময় নষ্টেরই সমতুল্য। আবার কারও কাছে মনে হতে পারে যা হয়নি তা নিয়ে সময় নষ্ট করে কি লাভ।’ পরমুহূর্তে জনৈক ব্যক্তির প্রশ্ন লেখকের বাবা-মা বেঁচে থাকলে কী হতো তাঁর একটি প্রত্যয়ী উত্তর দিয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ভবিষ্যত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক রূপরেখা নিয়ে গ্রন্থকার যথেষ্ট যুক্তি প্রমাণ তথ্য-উপাত্তসহ যে নিখুঁত, বিজ্ঞানমনস্ক ও দৃঢ়চেতা বক্তব্য দিয়েছেন তাতে লেখকের সঙ্গে একমত না হওয়ার কোন কারণ নেই। দ্বিমত পোষণ দুঃসাধ্য। নির্ভেজাল দেশপ্রেম যে একটি রাষ্ট্র গঠন পুনর্গঠনের পূর্বশর্ত বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে সেই প্রথম শর্তটি ছিল স্বতঃসিদ্ধ শাশ্বত; বিষয়টি এ মহাকাব্যে প্রমাণিত। লেখকের এই গ্রন্থে ‘সামূহিক’, ‘সমগ্রত্ব’ এ ধরনের অনেক নতুন নতুন শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় যা বাংলা ভাষার লেখনী শৈলিতে নতুন শব্দ ব্যঞ্জনার ব্যবহারে উৎকর্ষতা এনেছে। গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে অত্যন্ত ক্যালকুলেটিভ একটি তথ্য তিনি উপস্থাপন করেছেন। তথ্যটি এরকম : ১৯৪৭-৭১ সময়ে মোট ২৩ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানে যে শাসন এবং শোষণ চালিয়েছিল তার অর্থ মূল্য কম পক্ষে ১২ লাখ কোটি টাকা। হিসাবটি আরও নিখুঁত করতে তিনি পাদটিকায় উল্লেখ করেছেন যে বর্তমান বাজার মূল্যে এ শোষণের অর্থমূল্য হবে কমপক্ষে ৫০ লাখ কোটি টাকা। এ ধরনের যে সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসেবপত্তর তিনি দেখিয়েছেন যার অন্তর্নিহিত পরিসংখ্যানটি আমরা কখনও ভেবে দেখিনি অথবা ইতোপূর্বে এ বিষয়ে কোন সত্যানুসন্ধানমূলক গবেষণা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এ গ্রন্থের মহাকাব্যিকতা এখানেও। বঙ্গবন্ধুুর দেশপ্রেমের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট (১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার) বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘আপনার শক্তি কোথায়?’ বঙ্গবন্ধুর উত্তর ‘আমি আমার জনগণকে ভালবাসি।’ আর যখন জিজ্ঞেস করলেন ‘আপনার দুর্বল দিকটা কি?’ বঙ্গবন্ধুর উত্তর ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালবাসি।’ বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেমের দিকটি তাঁর শত্রুপক্ষকেও মেনে নিতে হয়। এ বিষয়টি এ গ্রন্থে বার বার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিধৃত হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে লেখক মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সম্ভবত তিনিই সর্বপ্রথম বললেন যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আর্থিক ও মানসিক বিপর্যয়ের সামাজিক মূল্য অপূরণীয় এবং অপরিমেয়। “২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি’ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন এ হিসেব ভুল। তার হিসেবে সঠিক সংখ্যাটি হবে কমপক্ষে ১০ লাখ। ২ লাখ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন সংখ্যাগত দিকের কথা কিন্তু ১০ লাখ বলেছেন সম্ভ্রমহানি ও ইজ্জতহানির ক্ষতির মূল্য প্রসঙ্গে। ইতোপূর্বে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে অনুরূপ অন্তর্নিহিত পরিসংখ্যান অন্য কেউ করেছেন কিনা আমার জানা নেই। আমরা কখনও গভীরভাবে এই ক্ষতির বহুমাত্রিকতা নিয়ে ভাবিনি। যা লেখক ভেবেছেন। আমি মনে করি এটি লেখকের একটি মানবিক হিসাব বা পরিসংখ্যান যা মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণে একটি নতুন দিক নির্দেশনা দান করেছে। এখানেও মহাকাব্য গুণ লক্ষণীয়। লেখক গভীর মনন চেতনায় উপলব্ধি করেছেন বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ আজ কোথায় থাকত এবং বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশ আজ কোথায় আছে। লেখক অতীত ও বর্তমান বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার উন্নয়নের মধ্যে তুলনাপূর্বক অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণসহ তা উপস্থাপন করেছেন। কারণ বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার উন্নয়ন যাত্রা ছিল সমসাময়িক। তিনি বলেছেন বঙ্গবন্ধুসহ আজকের বাংলাদেশের উন্নয়ন চিত্র এরূপ হতো যে, মোট দেশজ উৎপাদন ও মোট জাতীয় আয়ের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার হতো ৯ শতাংশ এবং ৪টি যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাখ্যা করেছেন যা পাঠককে আন্দোলিত করবে প্রশ্নোত্তরের আবর্তে। গ্রন্থে একটি অভিনবত্ব লক্ষ করা গেছে তা হলো ইতোপূর্বে কেউই যখন বলেননি যে বঙ্গবন্ধু ‘বেঁচে থাকলে’ বাংলাদেশের দৃশ্যপট কেমন হতে পারতো কেমন হতো আজকের রাষ্ট্র কাঠামো তখন সম্ভবত অধ্যাপক বারকাতই প্রথম যিনি এক্ষেত্রে সারণি-লেখচিত্র-ছক-ডায়াগ্রাম ব্যবহার করে এ সবের নিখুঁত বিশ্লেষণের মাধ্যমে সম্ভাব্য রূপচিত্র তুলে ধরেছেন (পৃ: ১৪৩)। দুটি ছকে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, ‘বঙ্গবন্ধুহীন’ আজকের বাংলাদেশে নিরষ্কুশ দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৯ কোটি ৮৯ লাখ ও ধনীর সংখ্যা ১০ লাখ কিন্তু বঙ্গবন্ধু ‘বেঁচে থাকলে’ এবং তাঁর উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়িত হলে এসব সংখ্যা হতো যথাক্রমে মাত্র ৪১ লাখ ও ১ লাখ। এক কথায় তিনি বলতে চেয়েছেনÑ “বঙ্গবন্ধু ‘বেঁচে থাকলে’ এবং বঙ্গবন্ধুর মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণ ও বৈষম্য হ্রাসকরণ-উদ্দীষ্ট উন্নয়ন দর্শন কার্যকর হলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক শ্রেণী কাঠামোটা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ও প্রগতিবাদী হতো এতে আমার কোনই সন্দেই নেই।” সুশীল সমাজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন সুশীল সমাজ বলতে আসলে কোন সমাজ হতে পারে না। এই ধারণাটি সাম্রাজ্যবাদের তোষামোদকারী, প্রতারক ও ষড়যন্ত্রকারী অনুষঙ্গ একটি মাত্রা। লেখক এখানে প্রশ্ন করেছেন সুশীল সমাজ যদি একটি সমাজ হয় তাহলে সমাজের অন্য সবাই অসুশীল কিনা। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তাদের সক্রিয় কোন ভূমিকা ছিল না। তাদের তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক জালিয়াতি চক্র বলে অভিহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে লেখক বলেন, ‘‘উপরোল্লিখিত বিচার-বিশ্লেষণ করে আমি যুক্তিসঙ্গত কারণেই ‘সুশীল সমাজ’ প্রত্যয়, প্রপঞ্চ বা ধারণাটি বাতিল ঘোষণা করছি (কেউ তা গ্রহণ অথবা বর্জন করুন তাতে আমার খুব এসে যায় না; আমি এটা করছি নিজের বিবেকের কাছে নিজে পরিষ্কার-স্বচ্ছ থাকার স্বার্থে)। যৌক্তিক বিধায় আমি এও ঘোষণা করছি যে, যদি এদের ‘সুশীল’ বলতেই হয় তাহলে বলতে হবে ‘সুশীল শ্রেণী’Ñ সুশীল সমাজ নয়।’’ এক কথায় লেখকের মতে সুশীল সমাজ হলো এক ধরনের সুবিধাবাদী-সুবিধাভোগী সাম্রাজ্যবাদের তোষামোদকারী ধনিক শ্রেণী, দেশের কোন ইতিবাচক পদক্ষেপে তাদের কখনও কোন ভূমিকা ছিল না। সর্বোপরি ভাষার দক্ষতা গ্রন্থকার অধ্যাপক বারকাত-এর মুন্সিয়ানার পা-িত্যই প্রমাণ করে। গ্রন্থটি পাঠ করে মনে হয়েছে অধ্যাপক বারকাত কেবলম বিশ্লেষক। এমন একটি বই পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতে তাঁকে দীর্ঘমেয়াদী অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুর সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, অর্থনীতি সম্পর্কে অন্তর্নিহিত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণসাপেক্ষে তিনি বিদগ্ধ পাঠক সমাজকে এমন একটি গবেষণালবব্ধ গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন যা সাধারণ পাঠক হয়ত একবার পাঠ করে পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারবেন না। কিন্তু একাধিকবার পাঠ করলে যে কোনো সমাজসচেতন পাঠক হয়ে উঠবেন কৌতূহলী ও চিন্তাশীল। লেখক অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতকে ধন্যবাদ জানাই এরূপ একটি গ্রন্থ পাঠক সমাজের হাতে তুলে দেবার জন্য। অধ্যাপক আবুল বারকাত রচিত ‘বঙ্গবন্ধু-সমতা-সা¤্রাজ্যবাদ’- এমন গ্রন্থটি সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক অর্থনীতি-সাহিত্যে এক অনবদ্য অবদান আর অন্যদিকে সামাজিক বিজ্ঞান সাহিত্যে চিন্তা-ভাবনার পদ্ধতিগত নিরিখে এক সৃজনশীল নবতর সংযোজন। আমার মতে গ্রন্থটি বহুভাষায় অনূদিত হওয়া প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশে তা অন্তত স্কুল পর্যায়ে অবশ্য পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি রাখে।
×