ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রহিমা আক্তার মৌ

পুলিশ বাহিনীর ॥ সাহসী নারীরা

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫

পুলিশ বাহিনীর ॥ সাহসী নারীরা

“সাম্যের গান গাই- আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোন ভেদাভেদ নাই! বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। সেদিন সুদূর নয়- যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।” (বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের ‘নারী’ নামক কবিতার প্রথম ও শেষ অংশ। ‘সঞ্চিতা’ পৃষ্ঠা-৬৩ ও ৬৬ পৃষ্ঠা) ‘বেলামে পড়ে এল জলকে চল’ পুরনো সেই সুর কে যেন ডাকে দূরে- কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল! কোথা সে বাঁধা ঘাট, অশথতল! ডাক্্ লো ডাক্্ তোরা বল্্ লো বল্ বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল। কবে পড়িবে বেলা, ফুরাবে সব খেলা নিবাবে সব জ্বালা শীতল জল, জানিস যদি কেহ আমায় বল্্ ॥ (বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বধূ’ নামক কবি তার প্রথম ও শেষ অংশ। ‘সঞ্চয়িতা’ পৃষ্ঠা ৪৫ ও ৪৭। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৫। শান্তি নিকেতনে বসে লিখেন কবি এ কবিতা) দিন মাস বছর করে যুগও পার হয়ে গেছে এই দুটো কবিতার। বিখ্যাত এই দুই কবি সেই সমেয়ই নারীদের নিয়ে কত সাহসী স্বপ্ন দেখেছেন। নারীদের আদর্শ ও সাহসীকতার ফলে কোথায় যেতে পারেন তার অনেক কিছুই আমরা এই কবিতা দুটো থেকে বুঝতে পারি। এই দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়ানো হয়েছে। যুদ্ধ করে রক্তের নদী বইয়ে দিয়ে দেশকে মুক্ত করেছে। হয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। আজ এই মুহূর্তে সাফল্য সাহসীকতা আর মনোবলকে সম্বল করে নারীরা বিভিন্ন পেশায় নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছেন। ঠিক তেমনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার লক্ষ্যে অস্ত্র হাতে আমাদের নারীরা যোগ দিয়েছে পুলিশ বাহিনীতে। সবদিক দিয়ে নারীরা এগিয়ে গেলেও এখনও কিছু ক্ষেত্রে সেই পুরনো নিয়মগুলো রয়ে গেছে। এখনও বিয়ের সময় মেয়ের যোগ্যতাকে পেছনে রেখে বাহ্যিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে সমাজব্যবস্থা। কিন্তু সাহসী ও স্বাবলম্বী নারীরা সমাজব্যবস্থাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে নিজের যোগ্যতায়। হাজার হাজার পুরুষ সহযোদ্ধার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে নিচ্ছে নিজের পদমর্যাদা আর সম্মানের আসনটি। বলছি নরসিংদীর প্রথম নারী পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্বরত আমেনা বেগমের কথা। আমেনা বেগম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে এমএ পাস করেন। ১৯৯৯ সালে ১৮তম বিসিএসে (বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন) সম্মিলিত মেধা তালিকায় ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। এরপর বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করেন। চাকরি জীবনে কুমিল্লায় সহকারী পুলিশ সুপার (শিক্ষানবিস) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে ২০০৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও পরে র‌্যাব সদর দফতরে যোগ দেন। ২০০৬ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পূর্ব তিমুরে বাংলাদেশ আর্মড পুলিশ ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডারে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে আমেনা বেগম আন্তর্জাতিক নারী পুলিশ সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের সমন্বয়ক পদে নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় মেয়াদেও তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশের প্রথম এশিয়ান উইমেন পুলিশ কনফারেন্সে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। আমেনা বেগম বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। ২০১২ সালে ‘আইজেন হওয়ার ফেলোশিপ’-এর জন্য মনোনীত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্যসহ ১৬টি অঙ্গরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুলিশিংয়ের উপর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। আমেনা বেগম মেক্সিকো, ইউএসএ, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ইউরোপে পুলিশের বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়ে বিশ্বে নারী পুলিশ হিসেবে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছেন। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে তিনি নরসিংদী পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করছেন। সর্বশেষ ২০১৫ সালের পুলিশ সপ্তাহ পালনে দক্ষতার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) পেয়েছেন। বাংলাদেশে নারী পুলিশদের সর্বপ্রথম যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। মাত্র ১৪ জন নারীকে নিয়ে এই যাত্রা শুরু হয়। স্পেশাল ব্রাঞ্চে ৭ জন নারী উপ-পরিদর্শক ও ৭ জন নারী কনস্টেবল নিয়োগের মধ্যে শুরু হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) নারী সদস্য নিয়োগের ব্যাপারে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়। সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে অস্থায়ী ভিত্তিতে ডিএমপিতে ৮ জন নারী উপ-পরিদর্শক (এসআই) ও ২০ জন নারী কনস্টেবলের পদ সৃষ্টি করা হয়। এরপর ৮০ দশকে পুলিশ বাহিনীর অর্গানোগ্রামে সংশ্লিষ্ট সব পদ স্থায়ীকরণের মাধ্যমে নারী পুলিশের অবস্থান শক্ত জায়াগায় আসে। এরপর থেকে শুরু হয় নারী পুলিশদের পদোন্নতি। ১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে যোগ দেন ফাতেমা বেগম। বর্তমানে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন সদর দফতরে। বর্তমানে পুলিশ বাহিনীতে অংশগ্রহণকারী নারী পুলিশ সদস্যের সংখ্যা ৬ হাজার ৮৯৩ জন। এরপর ১৯৮৮ সালে ৭ম বিসিএসের মাধ্যমে যোগ দেন ৪ জন নারী। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ১৯৮৯ সাল থেকে (৮ম বিসিএস) ১৭তম বিসিএস (১৯৯৮ সাল পর্যন্ত) কোন নারীকে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ দেয়া হয়নি। ১৯৯৯ সালের ১৮তম বিসিএসে মেধাতালিকায় ৬ষ্ঠ স্থান লাভ করেন আমেনা বেগম। এই ১০ বছরে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে নারীদের নিয়োগ না দেয়ায় অনেক নারী তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আবিদা সুলতানাও আয়েশা সিদ্দিকা নামে দুইজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রয়েছেন যারা পুরুষ পুলিশের মতোই অপরাধী ধরতে অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। কনস্টেবল থেকে অতিরিক্ত আইজিপি, মেধা যোগ্যতা আর দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে পুলিশ সদস্যের নারীরা সম্মান বয়ে আনছেন। [email protected]
×