ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বব্যাংকের জরিপে তথ্য দুর্বল সড়ক অবকাঠামো, বিদ্যুত সমস্যা, সংরক্ষণে সঙ্কট ইত্যাদি

কৃষিপণ্যের বাণিজ্য প্রসারে ১৭ বাধা

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ২০ ডিসেম্বর ২০১৫

কৃষিপণ্যের বাণিজ্য প্রসারে ১৭ বাধা

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ দেশে কৃষিপণ্যের বাণিজ্য প্রসারে ১৭ বাধা চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ দুর্বল সড়ক অবকাঠামো, ঋণ পাওয়া ও এজন্য বাড়তি ব্যয়, বিদ্যুত সমস্যা, সংরক্ষণ সুবিধা সঙ্কট ইত্যাদি। কৃষি খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ওপর পরিচালিত বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক জরিপের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা টেকসই দারিদ্র্য বিমোচন এবং গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে সংস্থাটির বক্তব্য হচ্ছে, রাজনৈতিক অস্থিরতায় হরতাল-অবরোধে ঘন ঘন সড়ক পরিবহনে অচলাবস্থা তৈরি হওয়ায় সবচেয়ে বেশি চাপে পড়ে এ খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য। এছাড়া আরও কয়েকটি কারণে মার খাচ্ছে কৃষিপ্রধান দেশের প্রধান এ খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপে ৭৯ শতাংশ ব্যবসায়ীর দৃষ্টিতে কৃষিপণ্য ব্যবসার ক্ষেত্রে দুর্বল সড়ক অবকাঠামো মূল বাধা। সড়ক অবরোধকে দ্বিতীয় বাধা হিসেবে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। প্রায় ৭৫ শতাংশ ব্যবসায়ীর দৃষ্টিতে সড়ক অবরোধ কৃষিপণ্য ব্যবসার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। ৬৫ শতাংশের কাছে মূল সমস্যা ঋণের ব্যয়। এছাড়া সংরক্ষণ সমস্যার কথা বলেছেন ৫৩ শতাংশ ব্যবসায়ী, অপ্রাতিষ্ঠানিক বিপণন বলেছেন ৫৫ শতাংশ, ঋণ পাওয়ার সমস্যা বলেছেন ৪৮ শতাংশ, বিদ্যুত সঙ্কট বলেছেন ৫৬ শতাংশ, দুর্নীতি বলেছেন ৫৪ শতাংশ, চুরি ও অপরাধ কর্মকা- বলেছেন ৫৩ শতাংশ এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিরতাকে ব্যবসার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা বলে মনে করেন ৩০ শতাংশ ব্যবসায়ী। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃষি খাতের একেকটি খাতে একেক রকম সমস্যা রয়েছে। যেমন একজন মাছ ব্যবসায়ীর কাছে যেটি প্রধান সমস্যা হয়ত একজন শাক ব্যবসায়ীর কাছে তা অন্যরকম সমস্যা। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, কৃষিক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আছে এ কথা যেমন সত্য, এসব সমস্যা সমাধানে সরকার ইতোমধ্যেই বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় ব্যাপক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে সমস্যা অনেকটাই সমাধান হবে। তাছাড়া সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও কৃষি ও এ সংশ্লিষ্ট শিল্প বিকাশে নানামুখী পদক্ষেপের কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রতিবেদনে উঠে আসা কৃষিপণ্য ব্যবসার ক্ষেত্রে অন্যান্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে সরকারের নীতি, শিক্ষা ও দক্ষতা, লাইসেন্স, ব্যবসার আইন ও বিধি, কর, টেলিযোগাযোগ এবং শ্রম বিধি। এসব বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষি খুবই ভাল করছে। খাতটিতে গত এক দশকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। মূলত উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধি, কারিগরি উন্নয়ন এবং নীতি সংস্কারের কারণে এগুলো সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে কৃষিতে গড়ে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৬ শতাংশ, যা চীন এবং পূর্ব এশিয়ার দেশের তুলনায়ও অনেক ভাল। একাধিক কৃষি অর্থনীতিবিদ মনে করেন, কৃষকদের মূল সমস্যা সংরক্ষণ। এ কারণে মৌসুমের সময় অনেক কৃষক অল্প দামে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করছেন বাধ্য হয়েই। ফলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সংরক্ষণের সমস্যা দূর করতে বেসরকারী খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে সরকারের কাছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের নিশ্চয়তা পাওয়া গেলে সেটি সম্ভব হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামে কৃষির সঙ্গে অকৃষি কর্মকা- সমানতালে হচ্ছে না। এটিকে উদ্বেগের বিষয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, কৃষিতে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হলে অকৃষি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ বাড়বে। কিন্তু কৃষিবহির্ভূত কার্যক্রম এখনও গতানুগতিক এবং নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন করছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যেভাবে অবদান রাখা প্রয়োজন সেটি সম্ভব হচ্ছে না। কৃষি খাতে দক্ষতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছে বিশ্বব্যাংক। দক্ষতা বাড়ালে কৃষিতে উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে চাল উৎপাদনে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হচ্ছে। যদিও এ খাত থেকে কৃষকদের আয় তেমন বাড়ছে না। এর বদলে শস্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করলে অনেক বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কৃষিতে ভর্তুকির বিষয়েও দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, কৃষি খাতের বড় অংশ সারের ভর্তুকিতে ব্যয় হচ্ছে। বিশেষ করে ২০০৭ সালের পর থেকে সারে ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে। তবে সেটি কৃষি উৎপাদনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ, কৃষিতে মাত্রাতিরিক্ত সারের ব্যবহার করছেন কৃষকরা। এতে অতিরিক্ত উৎপাদন হচ্ছে না, বরং স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদফতর সূত্র জানায়, কৃষিপণ্য ব্যবসায় সরকারও বেশকিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে। তার অধিকাংশই বিশ্বব্যাংকের জরিপের সঙ্গে মিল আছে। এগুলো কাটিয়ে উঠতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে একগুচ্ছ প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তবে কৃষি বিপণন অধিদফতর কিংবা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সরকারী-বেসরকারি সংস্থাগুলো একসঙ্গে কাজ করলে কৃষি বিপণনে মূল সমস্যাগুলো দূর হবে বলে তারা উল্লেখ করেন। এ জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে সংস্থাটি সাম্প্রতিক যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে সেটি সম্প্রতি অর্থ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এটি পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আগামী পাঁচ বছরে কৃষি খাতে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে কৃষি বহুমুখীকরণ এবং কৃষি খাতসংশ্লিস্ট শিল্পকে প্রণোদনা দেয়া অন্যতম। পরিকল্পনায় মধ্য আয়ের দেশে যেতে কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলো হলোÑ পোশাক খাত থেকে লব্দ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অ-পোশাক রফতানি খাতের জন্য উদ্দীপক কাঠামোর উন্নতিকরণ, রফতানি সম্ভাবনাসহ কৃষি কৌশল পুনর্বিবেচনা করা, কৃষকদের ভাল প্রণোদনা প্রদানে মূল্যনীতি প্রণয়ন ও গ্রামীণ অবকাঠামোর ওপর বেশি জোর প্রদান করা, পশু ও মৎস্যক্ষেত্রে মনোযোগ সৃষ্টি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে প্রমাণভিত্তিক নিরূপণ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের সাহায্যে সঠিক কৌশল নির্ধারণ করা, বিনিয়োগকারীদের দ্বারা চিহ্নিত সীমাবদ্ধতা দূরীকরণের মাধ্যমে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা, পাবলিক বিনিয়োগ ঘাটতি দূর করতে আধুনিকায়ন পরিকল্পনা তৈরি, বিদ্যুত ও জ্বালানীর সঠিক মূল্য নির্ধারণ ও ভর্তুকির পরিমাণ যুক্তিযুক্তকরণ, সরকারী-বেসরকারী বিনিয়োগ অংশীদারিত্ব পুনর্গঠন ও গতিশীলতা আনয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আইসিটি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাবিষয়ক সেবা রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট বিধিগত এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা ও এর সুনির্দিষ্ট সমাধানের জন্য একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা।
×