ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিস্তম্ভ সংরক্ষণে-

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২০ ডিসেম্বর ২০১৫

স্মৃতিস্তম্ভ সংরক্ষণে-

ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্মারক স্তম্ভ এবং মিনারগুলো বাঙালীর রক্ত আখড়ে স্থাপিত। অজস্র প্রাণের স্পন্দনে গ্রন্থিত এই সব স্থাপনা বাঙালীর প্রাণের তরঙ্গে লহর তোলা পবিত্রতার প্রতীকও। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর বিজয় গৌরবের, অহঙ্কারের এবং স্বাধীন জাতির চিহ্নিত স্মারক হিসেবে প্রতি মুহূর্তে জাগরূক হয়ে আছে। বাঙালীর প্রাণের পতাকা পত পত করে বাতাসে ধ্বনি তোলে জয়ের গৌরবে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত শহীদ মিনার। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে দিয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের স্মারক হিসেবে দেশজুড়েই আজ রয়েছে শহীদ মিনার। বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন এই শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করেই হয়েছে পল্লবিত। এখনও হচ্ছে। কিন্তু এসব মিনার সংরক্ষণে যথেষ্ট অবহেলাও পরিলক্ষিত হয়- একুশের সময় ছাড়া অন্যান্য সময়ে নিঃসঙ্গ পড়ে থাকে। কোথাও ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, মাদকাসক্তদের আখড়ায় পরিণত হয়। অথচ এসব দেখাশোনা ও সংরক্ষণের দায়িত্ব যাদের, তারা থাকেন নির্বিকার। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে ওঠে অরক্ষিত। অথচ এই মিনারকে কেন্দ্র করে জাদুঘর গড়ে তোলা হয়নি আজও। আরও করুণ অবস্থা দেশের প্রায় সংরক্ষিত বধ্যভূমিগুলোর। সংরক্ষিতগুলো কোনটা ময়লা আবর্জনার স্তূপ। কোনটা ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। তবে অরক্ষিত দেশের প্রায় সব বধ্যভূমি। এসবে নেই কোন স্মৃতিস্তম্ভ। বধ্যভূমির অনেক জায়গা দখল হয়ে গেছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোও সংরক্ষণ করা হয়নি। ফলে অনেক ঐতিহাসিক স্থান এখনও নতুন প্রজন্মের আগোচরেই রয়ে গেছে। এমনকি চিহ্নিত হয়নি রেসকোর্স ময়দান তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো। ইতোমধ্যেই দেশের বহু গণকবরের নাম নিশানা মুছে ফেলে সেখানে দালানকোঠা তোলা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লতাগুল্ম বনজঙ্গলে ঢাকা পড়ে অযতœ অবহেলায় অনেক গণকবর আজ লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছে। এদেশে একাত্তর সালে অধিকাংশ গণহত্যা ঘটেছে নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের ধারে। ফলে হত্যার চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য নদী বা খালে লাশ ফেলে দিয়েছে। পাকিস্তানী হানাদার ও তার দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস এভাবেই গণহত্যার চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। তারা বাঙালী হত্যায় সবসময় বুলেট ব্যবহার করেনি। কখনও বেয়নেট, কখনও বা ধারালো ছুরি দিয়ে নির্মমভাবে মানুষ জবাই করেছে। ময়লার ডিপোতে স্থান পেয়েছে বাঙালীর লাশ। যেখানে নদ-নদী ছিল না সেখানে মাটিচাপা দিয়েছে। এই গণকবর তথা বধ্যভূমিগুলো শনাক্ত করা জরুরী হলেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তেমন তৎপর নয়। দেশের বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণের পক্ষে ২০০৯ সালে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল। এর আগে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ৩৫টি বধ্যভূমি ও স্মৃতি বিজড়িত স্থান সংরক্ষণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছিল। যার বেশিরভাগই অবহেলিত থাকে বিশেষ দিবস ছাড়া। আদালত কমিটি গঠনের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবহেলা অযতেœ পড়ে থাকা বধ্যভূমি এবং মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সমাধিক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে বলেছিল। এর পর সরকার সারাদেশে ২০৪টি বধ্যভূমি ও ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণে প্রকল্প নিলেও সেসব কাজ স্থবির হয়ে রয়েছে। ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও কাজ শুরু হয়নি। ঢাকার মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে জল্লাদখানা বধ্যভূমি ছাড়া আর কোনটিই সংরক্ষিত হয়নি। আদালতের রায় রয়েছে বধ্যভূমিগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে। নতুন প্রজন্ম এমনিতেই ইতিহাস জানে কম। সেখানে এসব সংরক্ষণ না করার অর্থ ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়া। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও আবেদন ধরে রাখতে হলে এসব সংরক্ষণ যেমন জরুরী, তেমনি যেসব স্থাপনা রয়েছে, তা সারাবছর পরিচ্ছন্ন রাখাও অবশ্য কর্তব্য। ইতিহাস শুধু নয়, দেশ ও জাতির স্বার্থে এসব সংরক্ষিত হোক- দেশবাসী তাই চায়।
×