ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুন্সীগঞ্জে বই পড়ার আন্দোলন

ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির ঘণ্টা শুনে ঘুম ভাঙ্গে গ্রামবাসীর

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫

ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির ঘণ্টা শুনে ঘুম ভাঙ্গে গ্রামবাসীর

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল ধলেশ্বরী তীরে মালিরপাথর গ্রাম। শুক্রবার শীতের সকালেই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি গ্রামটিতে প্রবেশ করে। এই লাইব্রেরির ঘণ্টা শুনতেই দৌড়ে আসে শিশুরা। এদের একজন পঞ্চম শ্রেণীর সুমি আক্তার। সুমি জানাল, ছুটির দিনে তার ঘুম ভাঙ্গে লাইব্রেরির ঘণ্টা শুনে। শিশুতোষ নানা রকম বই পাওয়া যায় এই লাইব্রেরিতে। তাই লাইব্রেরির ঘণ্টা শুনে কি আর বিছনায় থাকা যায়? এই প্রশ্ন করে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চসারের মালিপাথরের বাসিন্দা সুমি জানায়, বই পড়ার মজা যে কত বেশি, আমি তা এখন বুঝতে পারি। এমনিভাবে আলোকবর্তিকা হিসেবে মুন্সীগঞ্জে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য সুমি, যারা আগামী দিনে নেতৃত্ব দেবে সভ্যতার। প্রবীণ শিক্ষক কাজী কসবা গ্রামের গিয়াসউদ্দিন ভূঁইয়া জানান, বই সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু। পারিবারিক মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, দেশীয় সংস্কৃতি আর নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে বই-ই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আর সে কারণেই নতুন প্রজন্মের মধ্যে সৃজনশীল মানসিকতা, মননশীলতা, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ও ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্যের বিবেচনাবোধ জাগ্রত করতে পারে বই। তাই বই নিয়ে নতুন আন্দোল শুরু হয়েছে প্রাচীন জনপদ মুন্সীগঞ্জ তথা গোটা বিক্রমপুর অঞ্চলে। সেই লক্ষ্যে মুন্সীগঞ্জের ৬৭ ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভায় ৬৯ ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি ও ৫৪ স্থায়ী লাইব্রেরি উদ্বোধন হচ্ছে। এই লাইব্রেরি বা বই পড়া আন্দোলনের উদ্যোক্তা মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল হাসান বাদল জানান, আকাশ সংস্কৃতির কুপ্রভাব থেকে মুক্ত থাকা, মাদকমুক্ত সমাজ গঠন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, পরিকল্পিত পরিবার গ্রহণ তথা বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধান ও শিক্ষার্থীদের সমাজ সচেতন করে গড়ে তুলতে ‘বই পড়ার অভ্যাস’ অসাধারণ ভূমিকা রাখবে। আজ শনিবার বিকেলে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোঃ আবুল কালাম আজাদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। লাইব্রেরিগুলোর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করতে জনপদটিতে এখন ধুম প্রস্তুতি। কিছু ইউনিয়নে ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে চলছে এই লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরির গায়ে লেখা রয়েছে বই পড়ায় উৎসাহী করার জন্য নানা অমীয় বাণী। জেলার অনগ্রসর এলাকাসহ প্রায় এক হাজার গ্রামের দুয়ারে দুয়ারে বিনামূল্যে বই দেয়া-নেয়া করবে। ছয় উপজেলা এবং দুই পৌরসভার পৃথক সাত রঙে লাইব্রেরিগুলো প্রাচীন এই জনপদে জ্ঞানের রং ছড়াতে যাচ্ছে। গ্রামের মেঠোপথগুলোতে হরেক রকমের বইয়ের পসরা নিয়ে ভ্যান বিচরণ করছে সর্বত্র। ঘরের দুয়ারে ঘণ্টা বাজাতেই ছুটে আসছে পাঠক। কেউ নতুনভাবে বই নিচ্ছে আবার কেউ আগে নেয়া বই ফেরত দিয়ে আবার নতুন বই সংগ্রহ করছে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! শিশুসহ নানা বয়সী নারী-পুরুষ বই নিচ্ছে রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে। এটি পরীক্ষামূলক চালু হওয়া সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউপি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতে কালজয়ী গল্প-উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধের বই ছাড়াও শিশুতোষ নানা বই স্থান পেয়েছে। তবে পাঠকদের বইয়ের চাহিদা আরও বেশি। ইউনিয়নের দফাদার ইউসুফ আলী তার কাজের অতিরিক্ত হিসেবে লাইব্রেরিয়ানের কাজ করছেন। তবে বেশি পরিশ্রম হলেও জ্ঞানের আলো ছড়াতে পেরে তার ভাল লাগে। ইউনিয়ন থেকে এই লাইব্রেরির যাবতীয় খোঁজখবর এবং বইয়ের চাহিদা রেজিস্টার তদরাকি সবই করছেন ইউপি সচিব। ইউনিয়নের নিজস্ব অর্থায়নে এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। পঞ্চসার ইউনিয়ন পরিষদের সচিব রেজাউল করিম তুহিন জানান, ভ্যান তৈরিতে খরচ হয়েছে ৩৮ হাজার টাকা। এ পর্যন্ত বই কেনা হয়েছে ৫৫ হাজার টাকার। লাইব্রেরিয়ানকে মাসিক অতিরিক্ত বেতন দেয়া হচ্ছে ১৫শ’ টাকা। তুলনামূলক অল্প টাকা খরচে আউটপুট বেশি হচ্ছে। জেলার এই বিশেষ ধরনের লাইব্রেরির অধিকাংশ তৈরি করছেন শহরের পুরনো বাসস্ট্যান্ডের ওয়ার্কশপে। ওয়ার্কশপটির স্বত্বাধিকারী রাশেদুল হাসান জানান, লাইব্রেরি ভ্যানটি তৈরি করতে পেরে তৃপ্তি পাচ্ছি। জীবনে বহু কাজ করেছি কিন্তু এই কাজটির মধ্যে রয়েছে আলাদা ভাললাগা। জেলা প্রশাসক জানান, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন জ্ঞানার্জন। নানা কারণে বই পড়ার অভ্যাস কমে যাচ্ছে। তাই প্রথমে প্রতিটি ইউনিয়ন কমপ্লেক্সে লাইব্রেরি চালু করা হয়। এতে পাঠকের আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই ঘরের পাশেই যেন লাইব্রেরি থাকে, অজপাড়াগাঁসহ সবখানে সব শ্রেণীর মানুষ বই পড়তে পারে, সেজন্য এই লাইব্রেরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে মুন্সীগঞ্জের শতাব্দী প্রাচীন হরেন্দ্র লাল পাবলিক লাইব্রেরিসহ জেলার সকল লাইব্রেরি এবং স্কুল ও কলেজ লাইব্রেরিকে সরব করা হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জের শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সুখেন চন্দ্র ব্যানার্জী জানান, বই যে মানুষের পরম বন্ধু, তা আবার বুঝতে শুরু করেছে এই জেলার মানুষ। এই বই পড়ার মাধ্যমে আবার প্রাচীন জনপদের মানুষ ফিরে পাবে পুরনো গৌরব। জেলার ৪৭ ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন, ছয়টি উপজেলা পরিষদ ভবন ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটিসহ মোট ৫৪টি স্থায়ী লাইব্রেরি এবং ৬৭টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার প্রত্যেকটিতে একটি করে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি স্থাপনের অনন্য সাধারণ উদ্যোগ আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করছে। ভ্রাম্যমাণ ৬৭টির মধ্যে ৬৬টি বিশেষ ভ্যান লাইব্রেরি আর নদীবেষ্টিত গজারিয়ার গুয়াগাছিয়ায় রয়েছে নৌকা লাইব্রেরি।
×