ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পৃথক হচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫

পৃথক হচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর

বিভাষ বাড়ৈ ॥ কাজের বোঝা কমানো, শিক্ষক হয়রানি ও অনিয়ম বন্ধে অবশেষে জাতীয় শিক্ষা নীতির সুপারিশ অনুসারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই অধিদফতর থেকে মাধ্যমিক শিক্ষাকে পৃথক করে ‘মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর’ নামে একটি পৃথক অধিদফতর গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একটি প্রকল্পের অধীনে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এদিকে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে মাউশি থেকে মাদ্রাসা শাখাকে পৃথক করে গঠন করা মাদ্রাসা অধিদফতরের কাজ। কাকরাইলে স্কাউট ভবনে নতুন এ অধিদফতরের কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট সকলেরই দীর্ঘদিনের দাবি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর বিকেন্দ্রীকরণ। এ নিয়ে দিনের পর দিন আন্দোলন করে আসছে শিক্ষক সংগঠনগুলো। তবে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে পৃথক ‘মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর’ গঠনের দাবি এখনও জোরালো। সব দিক বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতিতে স্পষ্টভাবে বলা হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর বিকেন্দ্রীকরণের কথা। নতুন করে পৃথক ‘মাদ্রাসা অধিদফতর’ ও ‘মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর’ গঠনের কথা বলা হয় শিক্ষানীতিতে। শিক্ষানীতির শিক্ষা প্রশাসন অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় পৃথক একটি মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর গঠন করতে হবে।’ অন্যদিকে পৃথক মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের বিষয়ে বলা হয়, শিক্ষা প্রশাসনে বর্তমান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরকে দুটি পৃথক অধিদফতর যথাক্রমে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর ও উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদফতর গঠন করা হবে। শিক্ষা প্রশাসনে নিয়োজিত সকল সংস্থার জন্য দায়িত্ব নির্ধারণ করে তা যথাযথভাবে পালনের জন্য লোকবল ও অর্থবলের ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি যথাযথ জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।’ শিক্ষানীতি অনুসারে ইতোমধ্যেই মাউশির মাদ্রাসা শাখাকে নিয়ে আলাদা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করার পর নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পেরিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি কাজ শুরু করেছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন নিয়ে অসন্তোষ আছে শিক্ষক সমাজের বিশেষত শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের মাঝে। কাকরাইলের ন্যাশনাল স্কাউট ভবনে কার্যালয় স্থাপন করে মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট পদগুলোতে জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। মাউশি থেকে মাদ্রাসা শাখার কাজও হস্তান্তর শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে মাদ্রাসা অধিদফতর আলাদা হলেও প্রায় এক বছর ধরে চিঠি চালাচালি হচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের। মাউশি থেকে মাধ্যমিক শাখা আলাদা হয়ে পৃথক অধিদফতর হলে তার শীর্ষ পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন হবে এই ভেবে আপত্তিও আছে শিক্ষকসহ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের। এ অবস্থায় কিছুটা ঝুলে ছিল পুরো প্রক্রিয়া। তবে এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আপত্তি নেই কারও। জানা গেছে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই সরকার এবার দ্রুত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাউশিকে দুটি স্বতন্ত্র অধিদফতরে বিভক্ত করতে সরকার নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। কিন্তু নানা কারণে কাজ এগোয়নি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালেও মাউশিকে বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দেন বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পৃথক মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর বলছিলেন, মাউশির ওপর লাখ লাখ লোকের কাজের বোঝা। বিশাল বোঝা এক সঙ্গে নিয়ে চললে সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। কাজের গতি আনতে বাস্তবতা বিবেচনা করেই শিক্ষানীতিতে তাই স্পষ্ট করে মাউশির বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হয়েছে। হয়েছে মাদ্রাসা অধিদফতর। এখন মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর হওয়াটাও জরুরী। সরকার এ কাজে এগোলে তা দেশের শিক্ষার জন্যই ভাল হবে। বাংলাদেশ শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের সমন্বয়কারী বিশিষ্ট শিক্ষক নেতা মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম বলছিলেন, পৃথক মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর হওয়া জরুরী। বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর সারাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কাজ সামলাচ্ছে। একে আলাদা করতে পারলেই কেবল কাজের গতি আসবে। হয়রানি কমবে। কাজও সহজ হবে। তিনি বলেন, আমরা বহুবছর ধরে এ দাবি জানিয়ে আসছি। মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর করে সেখানে মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর থেকেই জনবল নিয়োগ দিতে হবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে একটি পৃথক মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর প্রতিষ্ঠার দাবি করে আসছি, যা ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও কেন যেন এটা হচ্ছিল না। জানা গেছে, পৃথক মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর গঠনের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছিল। এতে বলা হয়, বর্তমান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের পক্ষে দেশের মাধ্যমিক স্তরের বিপুলসংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় পরিদর্শন ও ব্যবস্থাপনার সমন্বয় সাধন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ওই সারসংক্ষেপ অনুযায়ী এবার জোরালো পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাউশির অতীত ও বর্তমান ॥ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নথিতে বলা হয়েছে, মাউশি অধিদফতর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিদফতর। এর অর্গানোগ্রাম ১৯৮৩ সালে প্রণীত হয়, যা ১৯৮৪ সালে কার্যকর হয়েছে। ১৯৮৪ সালে অধিদফতরের অধীনে চারটি বিভাগীয় কার্যালয়, ২১ জেলা শিক্ষা অফিস, ১০৫ সরকারী কলেজ, ১০ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ৩ সরকারী মাদ্রাসা এবং ১৭৪টি সরকারী স্কুলসহ সর্বমোট ২৯২টি প্রতিষ্ঠান ছিল। এছাড়া ওই সময়ে মাত্র ১০৬ কোটি টাকা সরকারী অনুদান প্রদানের মাধ্যমে প্রায় নয় হাজার বেসরকারী স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার কর্মকা- নিয়ন্ত্রিত হতো এ অধিদফতরের মাধ্যমে। তবে বর্তমানে মাউশির আওতায় নয়টি আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস, ৬৪ জেলা শিক্ষা অফিস, ৪৭৪ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, ২৭৫ সরকারী কলেজ, ৩৩০ সরকারী মাধ্যমিক স্কুল, ৪ সরকারী মাদ্রাসা, ১৪টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ৫ উচ্চ মাধ্যমিক টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, একটি মাদ্রাসা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং ১৬ গবর্নমেন্ট কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটসহ সর্বমোট এক হাজার ১৯২ সরকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমপিও দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। বর্তমানে দেশে ২৬ হাজারের বেশি সাধারণ স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা, ৭৭৫ কারিগরি কলেজ এবং কারিগরি স্কুলসহ প্রায় ২৮ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় ছয় লাখ শিক্ষক-কর্মচারী এমপিও সুবিধা পাচ্ছেন। তাদের এমপিও বাবদ প্রতিমাসে সরকারের ব্যয় হচ্ছে প্রায় পাঁচ শ’ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনভাতা প্রদান সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমও মাউশি অধিদফতরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যদিও সম্প্রতি এমপিও কার্যক্রম অনলাইনে করে নয়টি অঞ্চলের হাতে দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও মাউশির পক্ষ থেকে অনলাইন ও আঞ্চলিক কেন্দ্রে দেয়ার পর কাজে গতি আসার দাবি করলেও মাঠপর্যায় থেকে আসছে অভিযোগের পাহাড়। সক্ষমতা বিবেচনা না করে হঠাৎ করে অনলাইনে কাজ করতে গিয়ে রীতিমতো স্থবির হয়ে গেছে কার্যক্রম। কাজ করছে না সার্ভারে। শিক্ষকরা দিনের পর দিন দৌড়ঝাঁপ করেও একটি ফাইল পাঠাতে পারছেন না। অন্যদিকে উপজেলা শিক্ষা অফিসার থেকে জেলা হয়ে আঞ্চলিক কেন্দ্রের উপ-পরিচালক পর্যন্ত টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না বলে অভিযোগ করছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। কাজের ক্ষেত্রে সঙ্কট এমন পর্যায়ে গেছে যে, সর্বশেষ দুই মাসে সারাদেশে মাত্র ৫১২ শিক্ষক কর্মচারীর এমপিও দেয়া সম্ভব হয়েছে অথচ স্বাভাবিক সময়ে এই সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার।
×