স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ বিস্তারের নেপথ্যে বিশেষ ভূমিকা রাখছে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন ও পাকিস্তানের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার কতিপয় কর্মকর্তা। এসব গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত ইসলামী দলটির বিশেষ যোগাযোগ থাকার প্রমাণ মিলেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানী নাগরিক ইদ্রিস তিন সহযোগীসহ ডিবির হাতে গ্রেফতার হয়েছে। তাদের কাছ থেকে স্পাই মোবাইল ও বৈদেশিক মুদ্রা উদ্ধার হয়েছে। ইদ্রিসের আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জবানবন্দী দেয়া ইদ্রিস আলী ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদের গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন। ফারিনা তাকে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটাতে নগদ টাকাও দিতেন। ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ফারিনার এমন তৎপরতার বিষয়টি প্রকাশের পর সম্প্রতি পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংকের সিনিয়র জয়েন্ট ডিরেক্টর আসমা খালিদকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেই পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছে। যদিও তার ভিসা ছিল না। এসব নানা কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতি টানার কথা উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
চলতি বছরের ২৯ নবেম্বর বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানী নাগরিক ইদ্রিস শেখ ও মোঃ মকবুল শরীফ এবং আটকেপড়া পাকিস্তানী মোঃ সালাম ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের এ্যাসিসটেন্ট ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মোস্তফা জামান গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারকৃতরা ভারতীয় ও পাকিস্তানী জালমুদ্রা পাচারে জড়িত।
ইদ্রিসের কাছ থেকে উদ্ধার হয় গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদানের কাজে ব্যবহৃত একটি শক্তিশালী বিশেষ স্পাই মোবাইল। যেটি সাধারণত কোন দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যবহার করে থাকে। মোবাইলটির সঙ্গে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদ ও পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পদস্থ এক কর্মকর্তার স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগাযোগ থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে।
পরবর্তীতে ঢাকা মহানগর হাকিম আবদুল্লাহ আল মাসুদের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন ইদ্রিস শেখ ও মোঃ মকবুল শরীফ। ইদ্রিসের জবানীতে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতায় ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের মহিলা গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদ ও পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন পদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়টি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইদ্রিস ১৯৮৫ সালে ভারত হয়ে পাকিস্তান যান। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানী এক নারীকে বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করছিলেন। ২০০২ সালে দেশটির ‘পাক-মুসলিম এ্যালায়েন্স’ নামে একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। রাজনীতি করার কারণে পাকিস্তানের জঙ্গী গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে তার যোগাযোগ গড়ে ওঠে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন পদস্থ কর্মকর্তার নির্দেশে তিনি ২০০৭ সালে বাংলাদেশে এসে জেএমবির সঙ্গে যোগ দেন। গত ২ বছরে ৪৮ বার বাংলাদেশ-পাকিস্তান যাতায়াত করেছেন তিনি। তার প্রধান কাজ বাংলাদেশে জেএমবির কার্যক্রম বৃদ্ধি করা। জেএমবি সদস্যদের পাকিস্তানে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো। আবার তাদের বাংলাদেশে ফেরত এনে জেএমবির হয়ে দেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানো। পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দিতে জালমুদ্রা পাকিস্তান থেকে আকাশপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হয়েছে।
বাংলাদেশে আসার পর চলতি বছরের ৬ নবেম্বর উত্তরা থেকে গ্রেফতারকৃত বাবুলের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বাবুল ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার ওই কর্মকর্তার সুবাদে তার পরিচয় ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদের সঙ্গে। ফারিনা জালমুদ্রার ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। জঙ্গী তৎপরতা ও জালমুদ্রার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে গত বছর ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের ভিসা কর্মকর্তা মাযহার খানকে বহিষ্কারের দাবি ওঠে। পরে দ্রুত তাকে প্রত্যাহার করে পাকিস্তানে পাঠানো হয়। এরপর থেকে এ কাজটি করে আসছিলেন ফারিনা।
জবানবন্দীতে ইদ্রিস জানিয়েছেন, ২০১২ সালে এয়ার টিকেটিং ও ভিসা প্রসেসিংয়ের ব্যবসার সময় বাবুল এবং পরবর্তীতে তার মাধ্যমেই কামাল নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। বাবুল ও পাকিস্তানী এক রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে ফারিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়। ইদ্রিসের পাকিস্তানের করাচীতে ইকরাহ্ নামের একটি মাদ্রাসা রয়েছে। ওই মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়মিত তালেবান জঙ্গী সংগঠনে পাঠানো হয়। পাকিস্তানেই মাদ্রাসাটির একাধিক শাখা আছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ফারিনা বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করছিলেন। বাংলাদেশে থাকা আইএসআইয়ের পুরনো এজেন্ট ছাড়াও নতুন এজেন্টও তৈরি করা হয়েছে। এসব এজেন্টের মধ্যে পাকিস্তানী গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সরাসরি এজেন্ট ছাড়াও এজেন্ট ও এজেন্টদের এজেন্ট হিসেবে মোট ২৬ জন কাজ করছেন। এদের মধ্যে ৪ জন সরাসরি ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট। এ চারজনের মধ্যে ২ জনের খুবই শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। এদের মধ্যে আব্দুস সালাম নামে একজন গ্রেফতার হয়েছেন। অপরজন পলাতক।
সূত্র বলছে, গ্রেফতারকৃত আব্দুস সালাম মুখ খোলেননি। তবে আব্দুস সালাম পাকিস্তানের খুবই বড় মাপের এজেন্ট। তার মূল কাজ জঙ্গীদের পাকিস্তানে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে আব্দুস সালাম ও পাকিস্তানী আরেক এজেন্ট পাকিস্তানে যান। পলাতক ওই পাকিস্তানী এজেন্ট পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন বলে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। দেখা করে মোটা অঙ্কের টাকাও নিয়ে আসেন। সেই টাকা দিয়ে গ্রেফতারকৃতরা বাংলাদেশে জেএমবির কার্যক্রম বাড়ানো, রোহিঙ্গাদের জেএমবিতে ভেড়ানো এবং তাদের ট্রেনিং দিতে পাকিস্তানে পাঠানোর কাজটি করতেন। ইতোমধ্যেই বহু রোহিঙ্গাকে পাকিস্তান থেকে জঙ্গী প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে তারা। পাকিস্তানে অবস্থিত রোহিঙ্গা আবদুল কুদ্দুস মকবুলের সহযোগিতায় বহু রোহিঙ্গাকে পাকিস্তান থেকে জঙ্গী ট্রেনিং দিয়ে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ইদ্রিসের জবানবন্দীর পর নজরদারির মধ্যে রয়েছে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন ও পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের কতিপয় কর্মকর্তা। বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানী গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের বিষয়ে বাড়তি নজরদারি চলছে। পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন এবং সে দেশটির সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার (আইএসআই) সঙ্গে জঙ্গী তৎপরতা ও জালমুদ্রা ব্যবসায়ীদের একটি বড় সিন্ডিকেটের যোগাযোগ থাকার তথ্য মিলেছে।
বাংলাদেশে জঙ্গী নেটওয়ার্ক বিস্তারের জন্য ইদ্রিসকে পাকিস্তান থেকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এদেশে পাঠানো হয়। ফারিনা আরশাদ বাংলাদেশের ভেতরে জঙ্গী নেটওয়ার্ক বাড়ানোর কাজ করছিলেন। সেই সঙ্গে পাকিস্তান থেকে আসা জালমুদ্রার চালান দেখভাল করছিলেন। ইংরেজী, উর্দু ও বাংলায় অনর্গল কথা বলতে সক্ষম ফারিনা। তিনি বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ বিস্তার ও জালমুদ্রার ব্যবসার জন্য একটি বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। সিন্ডিকেটে ২৬ জনের মতো সদস্য রয়েছে। তার মধ্যে ১০ জন হাইপ্রোফাইলের।
ইদ্রিসের এমন জবানবন্দী এবং সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকরের পর ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন ও পাকিস্তানের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। দেশটির তরফ থেকে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে, তা নিয়ে রীতিমতো হৈচৈ শুরু হয়। মূলত এসব কারণেই সম্প্রতি হযরত শাহজালাল (রহ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের সিনিয়র জয়েন্ট ডিরেক্টর আসমা খালিদকে। পাসপোর্টে ভিসা না থাকার কারণে তাকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালায় যোগ দিতে গত ১৩ ডিসেম্বর রাতে কাতার এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
শুধু জেএমবি নয়, ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের কতিপয় কর্মকর্তা, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কতিপয় কর্মকর্তা বাংলাদেশে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হরকত-উল-জিহাদ ও হিযবুত তাহ্রীরকে একত্রিত করে এক প্ল্যাটফর্মে আনার চেষ্টা করছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এখন পর্যন্ত গ্রেফতারকৃত পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানীদের কাছ থেকে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে সর্বশেষ গ্রেফতারকৃত ইদ্রিস অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তার দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাইসহ সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।