ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

ছাত্রজীবনের অবসান (১৭ ডিসেম্বরের সম্পাদকীয় পাতার পর) কত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে দেয়া যায়, সেটা নিয়েই তারা শলা-পরামর্শ করতে লাগলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই বড় বড় সরকারী কর্মকর্তা আমাদের নেতৃস্থানীয় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতে থাকলেন। আমাদের প্রভোস্ট ড. ওসমান গণি, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার গোফরান আহমেদ ফারুকী, ঢাকার জেলা প্রশাসক ইয়াহিয়া খান চৌধুরী এবং সর্বশেষে পূর্ব বাংলার মুখ্যসচিব নিয়াজ মোহাম্মদ খান আমাদের সঙ্গে দেখা করলেন। আমার মনে পড়ে না যে আমাদের উপাচার্য ড. জেকিনস এই দর্শকদের দলে ছিলেন। তাদের সকলের কথাই ছিল এক রকম “আপনারা দেশের ভবিষ্যত, আপনাদের লেখাপড়ার সুযোগ আছে, আপনারা কেন জেলে থাকবেন? আপনারা ইচ্ছা করলেই জেল ছাড়তে পারেন।” তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে, তারা আমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা (ইড়হফ) নেবেন যেখানে আমরা বলবো, আমরা কোন রাজনৈতিক আন্দোলন করবো না এবং তখনই তারা আমাদের ছেড়ে দেবেন। প্রথমেই তারা কয়েকদিনের মধ্যে মহিলাদের ছেড়ে দিলেন এবং আমরা দেখলাম, প্রায়ই ৪Ñ৫ ছাত্র মুক্তি পাচ্ছে। বোঝা গেল, ছেলেরা আত্মীয়-স্বজন বা অভিভাবকদের চাপে অঙ্গীকারনামা দিয়ে মুক্তি পাচ্ছে। আমাদের সঙ্গে ছিল বেশ কয়েকটি বালক, স্কুলের ছাত্র। যাদের দু’জনের সঙ্গে আমার এখনও যোগাযোগ আছে। সামসুল আরেফীন এবং আনোয়ার আনসারী খান। বর্তমান বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদও বয়োকনিষ্ঠদের মধ্যে একজন ছিল। তারা এই বন্ডে মুক্তি পাওয়াটাকে খুবই অপছন্দ করতো। তাই যারা এইভাবে মুক্তি পাচ্ছে তাদের অপদস্থ করার জন্য ব্যবস্থা নিল। যখন কেউ এইভাবে জেল ছাড়ার জন্য প্রস্তুতি নিত বা রওনা হতো তখনই সারা এলাকায় ‘টুউস’ করে একটি শব্দ বার বার উচ্চারিত হতো। এইটি বন্ড প্রদানের বিরুদ্ধে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি কৌশল হিসেবে কাজ করে। সেন্ট্রাল জেলে সচরাচর একটি হাসপাতাল থাকে। বন্ড দিতে যারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তারা তখন একটি নতুন কৌশল অবলম্বন করলো। তারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যেতে শুরু করলো এবং হাসপাতাল থেকে বন্ড দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকলো। কিন্তু অল্প বয়স্কদের অসন্তোষের ফলে বন্ড দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় রহিত হয়ে গেল। আমরা যারা ১২ ফেব্রুয়ারিতে গ্রেফতার হয়েছিলাম তাদের এক মাসের মেয়াদ প্রায় পূর্ণ হতে চললো। তখন আমাদের ছেড়ে দেয়ার উদ্যোগটা বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠলো। কৃষক-শ্রমিক-প্রজা পার্টির নেতা আবু হোসেন সরকার এবং আওয়ামী লীগের নেতা আতাউর রহমান খান দু’জনই এ বিষয়ে নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে থাকলেন। তাই আমাদের গ্রেফতারের মেয়াদ বৃদ্ধি সম্বন্ধে যখন আবার হুকুম পেলাম তখন বুঝলাম, আমাদের আরও কিছুদিন জেলের খানা খেতে হবে। এর মধ্যে জানা গেল যে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী দ্বিতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো ঢাকা আসছেন। আমরা শুনলাম, তাকে সসম্মানে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দুই বড় দলেই বেশ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের ধারণা হলো যে, প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এলে আমাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। ইতোমধ্যে হঠাৎ একদিন সম্বিত হারানোর ফলে আমাকে হাসপাতালে যেতে হলো। আমি মোটামুটি সুস্থ ছিলাম, হয়তো কিছু দুর্বলতা দেখা দেয় সুতরাং আমি ২-১ দিনের মধ্যেই ৫ নম্বর খাতায় ফিরে এলাম। হাসপাতালে দেখলাম, মোকাম্মেল হকের অবস্থা খুবই খারাপ। সে অনেকটা শুকিয়ে গেছে কিন্তু সে কোনমতেই বন্ড সই করবে না। আমার ওই হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়। তিনি একজন লব্ধ প্রতিষ্ঠ ডাক্তার ছিলেন এবং হত্যায় সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাবাস করছিলেন। তার নিজের কাহিনী তিনি আমাকে শোনালেন। তিনি তার স্ত্রীকে হত্যা করেছিলেন বলে তার কোন অনুশোচনা ছিল না এবং কারাবাস যাপনের বিষয়েও তার কোন অভিযোগ ছিল না। তার স্ত্রীকে তিনি সুখেই রাখেন কিন্তু সেই মহিলা অন্য ব্যক্তির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং প্রকাশ্যে এ বিষয়ে সমাজে আলোচনা চলতে থাকে। সেই সময় তিনি হাতেনাতে প্রেমিক যুগলকে ধরে ফেলেন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে হুজুগের মাথায় স্ত্রীকে হত্যা করেন। ডাক্তার সাহেব যদিও সর্বরোগের চিকিৎসক ছিলেন কিন্তু আমার মনে হলো তিনি দাঁতের সেবা সম্বন্ধেও বিশেষভাবে অবহিত ছিলেন। দন্তসেবায় তার কতিপয় উপদেশ আমি এখনও অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী অবশেষে ২১ মার্চে ঢাকা ভ্রমণে আসলেন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রীয় সংসদে সমর্থন সংগ্রহ। তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের নেতা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে মুসলিম লীগ বড় দল ছিল কিন্তু পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন মাত্র একজন (ফজলুর রহমান)। তাই তাকে হয় আগামী লীগ নয় কৃষক-শ্রমিক-প্রজা পার্টির সমর্থন আদায় করতেই হবে। এদিক পূর্ব বাংলার দুই মুখ্য দলেরই ক্ষমতায় অংশগ্রহণের আশা ছিল। দুই দলই প্রধানমন্ত্রীকে সোৎসাহে সংবর্ধনা দিলেন। প্রধানমন্ত্রীও কম কুশলী ছিলেন না। তিনি সন্ধ্যার পর বিমানবন্দরে অবতরণ করেই একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে যে ছাত্র ও অন্য লোকজন জেলে ছিলেন তাদের মুক্তির হুকুম দিলেন। জেলের নিয়মানুযায়ী রাতে কোন বন্দীকে মুক্ত করার সুযোগ ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হুকুম দিলেন যে প্রয়োজনে নিয়ম ভেঙে আমাদের রাতেই মুক্ত করতে হবে। তাই সম্ভবত রাত ১০/১১টার দিকে আমরা জেল থেকে মুক্তি পেলাম এবং জেলগেটে তখন বেশ বড় বন্ধু সমাগমও হলো। আমাদের মুক্তি ছিল আমাদের বিজয়, নিঃশর্তে কারাবাসের অবসান। তাই সলিমুল্লাহ হলে ২৬ মার্চে অনুষ্ঠিত হলো আমাদের সংবর্ধনা। সেই উপলক্ষে ইনাম আহমদ চৌধুরী অতি চমৎকার একটি গীতিনাট্যের আয়োজন করেন “আমার দেশ আমার ভাষা”। সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি হিসেবে পূর্ব বাংলা মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে আমাকে মাঝে মাঝেই দেন-দরবার করতে হত। কেমন করে জানি মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের সঙ্গে আমার বেশ পরিচয় হয়। তাই কোন ছাত্র সমস্যা থাকলে তার সঙ্গে আমি মাঝে মাঝে দেখা করতাম। আমার মনে হয়, আমি তার ¯েœহাস্পদ ছিলাম। তিনি ছিলেন চমৎকার গল্পকার এবং অতি সহজ সরল মানুষ। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি তার চারপাশে কোন দেয়াল তোলেন নি বলে আমি মনে করতাম। তিনি ছিলেন খুবই বিনয়ী ব্যক্তি। তিনি প্রায়ই বলতেন, তিনি কখনও মুখ্যমন্ত্রী হবেন বলে ভাবেন নি এবং সেজন্য কোন প্রস্তুতিও নেননি। সহসা শেরে বাংলা তাকে ডেকে বললেন, রাজনীতিতে ফিরে আসতে হবে। কারণ তিনি ঠিক করেছেন, তিনি দলবল নিয়ে নির্বাচন করবেন। তিনি আরও বলেন, দেশটা উচ্ছন্নে গেছে এবং তাকে পুনরুদ্ধারের ভার তাকেই নিতে হবে। সরকার সাহেব বললেন, তিনি তেমন উৎসাহিত না হলেও শেরে বাংলাকে বিফল মনোরথ হতে দেয়া তার পক্ষে যথাযথ হবে বলে তিনি মনে করেন নি। আমার মনে হলো শেরে বাংলার প্রতি তার নিখাঁদ আনুগত্য ছিল। নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন এবং হক সাহেব যখন কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দিতে গেলেন তখন তিনি আবু হোসেন সরকার সাহেবকে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য করেন। তিনি অকপটে বললেন, একজন রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব নিতে তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না এবং কোনমতে এই দায়িত্বটি পালনের চেষ্টা করছেন। তিনি গল্পচ্ছলে আমাকে আরও বলেন, শেরে বাংলা তাকে একটি বিষয়ে ভাল শিক্ষা দেন। তিনি বলেন, রাজনীতিতে প্রয়োজনে কঠিন ও জটিল দায়িত্ব নিতে হয় এবং রাজনীতিবিদদের গুণই হলো, তারা কঠিন দায়িত্ব পালনে কখনও পিছপা হন না। তিনি প্রায়ই বলতেন, ছাত্ররাই হলো ভবিষ্যৎ। কারণ তারা স্বাধীন দেশে রাজনীতি করছে এবং দায়িত্ব গ্রহণে প্রশিক্ষণ পাচ্ছে। তার বক্তব্য ছিল, “আমি তো অপ্রস্তুত ব্যক্তি। কোনমতে দায়িত্ব পালন করছি। আপনাদের হাতে দায়িত্ব প্রদানের জন্য আমরা অপেক্ষা করে আছি। আপনারা দেশটাকে অনেক ভালভাবে পরিচালনা করবেন।” আমার মনে হতো তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কথাগুলো বলতেন এবং তাতে বিশ্বাসও করতেন। ১৯৫৪-৫৫ সালে পূর্ব বাংলা সচিবালয়ের একজন সচিব আইসিএস কর্মকর্তা আসগর আলী শাহর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। তার সঙ্গে মাঝে মাঝে আমি দেখা করতে যেতাম। আসগর আলী শাহকে আমাদের হলে একটি বিতর্কে যোগ দেয়ার জন্য আমি অনুরোধ করি। যদিও তার কথা বলতে মাঝে মধ্যে তোতলামী এসে যেত কিন্তু তিনি সানন্দে এই দাওয়াতটি গ্রহণ করেন। বিতর্কের বিষয় ছিল ‘পাকিস্তানে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য হওয়া উচিত’ এবং এইটি অনুষ্ঠিত হয় ২০ সেপ্টেম্বরে। এই বিতর্কের পক্ষে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যার সুবক্তা অধ্যাপক ডব্লিউ বি কাদরী এবং বিপক্ষে নেতৃত্ব দেন শিক্ষা সচিব আসগর আলী শাহ। প্রস্তাবটি অবশ্যি বিপুল ভোটে পরাজিত হয়। চলবে...
×