ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

ছাত্রজীবনের অবসান (১৬ ডিসেম্বরের পর) আমি ২-১ দিনের মধ্যেই একটি নিয়ম করলাম, দুপুরে ঘুমাবো এবং ঘুম শেষে বেড়াতে যাওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি সচরাচর করা হয় সেইভাবে বেড়াবার কাপড়-চোপড় পরে আমাদের নির্দিষ্ট চৌহদ্দিতে চলাফেরা করবো। তাতে মনে হতো, এই বুঝি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অথবা নিউমার্কেটে যাচ্ছি ইত্যাদি। ২০ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ণে আমরা বাইরে থেকে সেøাগানের আওয়াজ শুনতে পেলাম। ধরে নিলাম, এইটি হচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারির জন্য প্রস্তুতি। ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমাদের ফালতোদের মুখে শুনতে পেলাম, অনেক ছাত্র-ছাত্রী গ্রেফতার হয়েছে এবং জেলে তাদের গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি চলছে। সন্ধ্যার আগে জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এবং জানালেন, প্রায় চারশ’ ছাত্র-ছাত্রীর জন্য জেলে জায়গা করতে হচ্ছে। সেজন্য তারা একটি এলাকায় যেখানে বড় বড় কামরা আছে এবং স্থাপনাটি দোতলা বা তিনতলা সেখানে আমাদের স্থানান্তরিত করতে চান। ওখানে গেলে আমাদের এই যে নতুন বন্দীরা আসছে তাদের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করা হবে। আমরা সোৎসাহে এই প্রস্তাব গ্রহণ করলাম এবং নিজেদের সামান্য মালপত্র নিয়ে সেখানে চলে গেলাম। ওখানে গিয়ে দেখি আমাদের বন্ধু-বান্ধব সবাই আমাদের সঙ্গী। সলিমুল্লাহ হল ইউনিয়নের এ আই এম তাহা এবং এটিএম শামসুল হক দু’জনেই আছেন। অন্যান্য হল ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ এসব থেকে অনেক ছাত্র-ছাত্রী সেখানে আছেন। ছাত্রীদের জন্য অবশ্যি আলাদা একটি মহিলা ওয়ার্ড অন্যত্র ছিল। আমরা জানলাম প্রায় ৩০ জন মহিলা গ্রেফতার হয়েছেন। হিসাব হলো, ছাত্র-ছাত্রী মিলে সর্বমোট প্রায় ৫শ’র মতো কারাবন্দী আছেন। আমরা যে জায়গায় স্থানান্তরিত হলাম তার নাম ছিল ৫ নম্বর খাতা এলাকা। সেখানে দোতলা বা তিনতলা ভবনের (ঠিক মনে নেই) বড় বড় হল আমাদের দেয়া হলো। পাশে থাকলো শুধু নির্দিষ্টসংখ্যক ‘এ’ ক্লাসের শ্রেণীভুক্ত বিভিন্ন অপরাধের সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ। দালানের সামনেই ছিল একটি জলাধার। যার চারপাশে অনেকগুলো পানির কল ছিল। এছাড়া আরও কিছু উন্মুক্ত জায়গা ছিল, যেখানে আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই ভলিবলের মাঠ তৈরি করি। আমার ঠিক মনে পড়ছে না, কাবাডির জন্য কোন মাঠ তৈরি করা হয়েছিল কি-না। ক্রিকেটের জন্যও আমরা ছোট ধরনের মাঠ তৈরি করি। জেল কর্তৃপক্ষ মোটামুটিভাব আমাদের নিয়ে খুবই পেরেশান এবং চিন্তিত ছিলেন। এত যুবককে একসঙ্গে রাখা মোটেই নিরাপদ ছিল না। তারা আমাদের সঙ্গে নানাভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাদের সহায়তায় প্রথমেই হলো, আমরা ঘন ঘন আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করা ও কথা বলার সুযোগ পেলাম, তাদের মাধ্যমেই আমাদের খেলাধুলার সামগ্রী ব্যাট, বল ইত্যাদি সংগ্রহ করলাম। আগেই বলেছি যে আমাদের এই ওয়ার্ডে ‘এ’ ক্লাসের কতিপয় সাজাপ্রাপ্ত বন্দী ছিলেন। তাদের মধ্যে দু’জন ছিলেন আমার বেশ পরিচিত। তাদের একজন ছিলেন মুরারীচাঁদ কলেজে আমার লজিকের শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম। তিনি এক পারিবারিক কলহে সম্ভবত কোন আত্মীয়কে মেরে ফেলেন এবং সেজন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান। আর একজন ছিলেন সিলেটের রাজনৈতিক নেতা আমার অতি পরিচিত পি এম শাহাবুদ্দীন। যিনি আমাকে আমার অভিনয়ে সন্তুষ্ট হয়ে একটি সোনার মেডেল দিতে অঙ্গীকার করেন। তিনি একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে আসামি ছিলেন এবং বিচারে সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রতিপক্ষ একজন গুণ্ডা প্রকৃতির কর্মী আবদুল বারীকে (কালা) তার হুকুমে হত্যা করা হয়। এই পরিচিত দুইজন জেলে আমার খুব খেয়াল করতেন। প্রায়ই তাদের খাবারের ভাগ আমাকে চুপেচুপে তারা হস্তান্তর করতেন। জেলে যে অসংখ্য ছাত্র ছিল তারা প্রায়ই ছোট ছোট দলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া বা খেলাধুলা করতো। আমার সে রকম দলে ছিল মোকাম্মেল হক, শাহেজ করিম, শহীদুল হক মোর্শেদ এবং আর একজন যার নাম আমি ভুলে গেছি। আমরা আমাদের খাবার ভাগাভাগি করতাম এবং মাঝে মাঝেই বাইরে কোন আত্মীয় বাড়ি থেকে খাবার পেতাম। আমার যেমন একদিন সুস্বাদু খাবার এলো আমার ফুফুর বাড়ি থেকে। শাহেজের বাড়ি থেকে কয়েকবারই আমাদের খাবার আসে। আমাদের কোন কোন বন্ধুও আবার এই রকম খাবার মাঝে মধ্যে পাঠাতে থাকেন। আমরা মহানন্দে এসব খাবার ভাগ করে ভোজনে আনন্দ পেতাম। সলিমুল্লাহ হল ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ আমাদের জানালো, তারা প্রতিদিন সকালে আমাদের নাশতার জন্য ভাল পাউরুটি পাঠাবে এবং হলে যেদিন উন্নত খানাপিনা হয় সেদিনও আমাদের জন্য খাবার পাঠাবে। আমার হলের যুগ্ম-সম্পাদক ইনাম আহমদ চৌধুরী (বর্তমানে বিএনপি নেতা) গ্রেফতার এড়িয়ে যায় এবং সে প্রায়ই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতো। সেই বাইরে থেকে মালপত্র, খেলাধুলার সামগ্রী, খানাদানা ইত্যাদি পাঠাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতো। আমার মনে হয়েছিল, তার একটি লজ্জাবোধ থেকে সে এ বিষয়ে সবিশেষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তার লজ্জাবোধের কারণটি ছিল, সে যে গ্রেফতার হয়নি সেটা নিয়ে ছাত্রমহলে আশ্চর্যবোধ এবং ক্ষোভ দুইটি প্রতিক্রিয়াই ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারলাম, আমাদের নিয়ে সরকারও বেশ চিন্তিত। চলবে...
×