ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার বয়ান

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫

অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার বয়ান

সন্ধ্যা নেমেছে। যানজটে স্থবির হয়ে আছে ঢাকা শহরের রাজপথ। হয়ত আপনি কর্মজীবী একজন নারী, আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন বাসের অপেক্ষায়। অবশেষে লোকভর্তি একটা বাস এলো। একগাদা পুরুষের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে যেই বাসের পাদানিতে পা রেখেছেন, অমনি শুনতে পেলেন ড্রাইভার কনডাক্টরকে বলছে, ওই, মহিলা উঠাইছ না! কনডাক্টর আপনাকে বলে উঠল, আপা উইঠেন না, জায়গা নাই! আপনাকে ঠেলে পুরুষরা দুদ্দাড় করে উঠে গেলেন বাসে। এই ঘটনা যান্ত্রিক ঢাকানগরীর একটি নিত্যনৈমিত্তিক ছবি। আপনি যদি একজন কর্মজীবী, ছাত্রী, গৃহিণী যে-ই হোন না কেন, বাসে যাতায়াত করতে গেলে আপনাকে কখনও না কখনও এমন ঘটনার সম্মুখীন হতেই হবে। ঢাকা শহরে সিটিং সার্ভিস খুব কমই আছে। লোকাল বলুন আর টিকেট সার্ভিস, দু’ধরনের বাসেই নারীদের এমন অপদস্থ হতে হয়। সিটিং সার্ভিসগুলো তো আরেক কাঠি সরেস! সংরক্ষিত আসন ছাড়া বাড়তি সিটগুলো তারা সংরক্ষণ করে পুরুষের জন্য! প্রেসক্লাবের সামনে বাসের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন কানন সুলতানা। পল্টনে এক অফিসে চাকরি করেন তিনি। কথা হলো তাঁর সঙ্গে। ‘দাঁড়িয়ে যেতে রাজি আছি, কোন সমস্যা নেই। কিন্তু বাসে উঠতে তো দেবে, তাও দেয় না’- ক্ষোভ ঝরে পড়ে কাননের কণ্ঠে। বিকেল বা সন্ধ্যায় যে নারীদের বাড়ি ফিরতে হয়, তাঁদের প্রতিনিয়তই সম্মুখীন হতে হচ্ছে এ সমস্যার। ধরুন, ঠেলেঠুলে উঠে পড়লেন বাসে। তারপর কী দেখলেন? দেখলেন সংরক্ষিত মহিলা আসনে বহালতবিয়তে বসে আছেন কোন পুরুষ। ড্রাইভার বা কনডাক্টরেরও এতে যেন কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই। এমনিতেই নয়টি আসনে নারীদের পাশাপাশি ভাগ রয়েছে শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের, সেখানে এই বাড়তি ঝামেলা! সবচেয়ে অস্বস্তিকর ব্যাপার হলো, নারীযাত্রী বাসে উঠলেও এই পুরুষরা ঠায় বসে থাকেন সিটে, সিট ছেড়ে দেন না। আর যদি কোন নারী বলেন, সিট ছেড়ে দেয়ার কথা, তাহলে সিট হয়ত ছেড়ে দেন, সঙ্গে দুটো কথা শুনিয়ে দিতেও ভোলেন না। মাঝে মাঝে তো দুটো কথা ঝগড়ার চূড়ান্তরূপ ধারণ করে। এমনকি অশ্রাব্য গালিও শুনতে হয় নারীদের। ইডেনের ছাত্রী শমরিতা হালদার থাকেন মোহাম্মদপুরে। বাসেই যাতায়াত করতে হয় তাকে বেশি। বাসে চলতে কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন তিনি, সেটা তার মুখ থেকেই শোনা যাক। বললেন, ‘সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় সংরক্ষিত আসনগুলো নিয়ে। এ আসনগুলো বিশেষভাবে আলাদা, তার মানে এই নয় যে, পুরো বাসের আর কোন সিটে নারীরা বসতে পারবেন না। অথচ সংরক্ষিত আসনগুলো ছাড়া অন্য কোন আসনে বসলে নারীদের শুনতে হয় নানান ধরনের কত কথা। খুব কম পুরুষই আছেন, যাঁরা এ নিয়ে বাক্যবাণ ছোড়েন না। বাসের ভেতরে এ অবস্থা তাহলে বাইরে কেমন চিন্তা করেন!’ মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য নয়টি আসন সংরক্ষিত করার আইন প্রচলনের পর থেকে আজ পর্যন্ত এই আসনগুলোর জন্য নারীদের যুদ্ধ করেই যেতেই হচ্ছে। বাসের সাধারণ একটা আসন নিয়ে যেখানে এত বচসা, সেখানে অন্যান্য ক্ষেত্রে নারী অধিকার কতখানি সফল হতে পারে, তা দুশ্চিন্তার জন্ম দেয়াটাই স্বাভাবিক। আরেকটি অতি সাধারণ কথা, যেটি বাসে উঠলে প্রায়শই শুনতে হয় নারীদের তা হলো, ‘সমঅধিকার চান তাহলে সবকিছুতেই সমান হন। বাসে পুরুষদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে যান, আলাদা সিট চান কেন?’ আসলেই তো, দাঁড়িয়ে যেতে কী সমস্যা? সমস্যা তো একটা আছে বটেই! আর সমস্যাটা হলো কিছু বিকৃত রুচির পুরুষের আচরণ। পৃথিবীজুড়েই এমন অসংখ্য মানুষ আছে, বাসগুলোতেও থাকে। এদের কাজই হলো সুযোগ বুঝে নারীদের শরীর স্পর্শ করা। কখনও সামনে, কখনও পেছনে। অহেতুক ঠেলাঠেলি সৃষ্টি করাও এদের কাজ। বাসে নিয়মিত যাতায়াত করেন, অথচ কোন পুরুষের অশ্লীল স্পর্শ পাননি, এমন নারী খুঁজে পাওয়াটাই দায় হয়ে পড়বে। প্রতিনিয়ত ধর্ষণের সংখ্যা কেন বাড়ছে, এর পেছনে অনেকেই দায়ী করেন মেয়েদের পোশাককে। কিন্তু আদতে পোশাক নয়, বিকৃত মানসিকতাই এর পেছনে দায়ী, তা আংশিক হলেও বোঝা যায় বাসে উঠলে। বাসে যে নারীরা ওঠেন তাঁদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। উগ্র পোশাক পরিধান তাঁরা সাধারণত করেন না। অথচ অশ্লীলভাবে হেনস্থা হন তাঁরাই বেশি। শোনা যাক রেহনুমার একটি অভিজ্ঞতা- ‘আমি বোরকা পরি। একদিন বসার জায়গা না পেয়ে বাসে দাঁড়িয়ে আসছি, হঠাৎ আমার শরীরে পাশবিক কোন কিছুর স্পর্শ পেলাম। ভিড়ের জন্য পেছন ফেরাও যাচ্ছে না। কোনরকমে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আমার পেছনে একজন মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে, তাঁর মুখে কুৎসিত হাসি। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম ঘিনঘিনে ওই স্পর্শটা কীসের। লজ্জা, অপমান, ঘৃণায় আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। আমি তাকে বললাম সরে দাঁড়াতে। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা বলে উঠল এতো গাদাগাদির মধ্যে সে সরবে কোথায়? আশপাশের লোকজনও তাতে সায় দিল।’ রেহনুমার মতো অভিজ্ঞতা হয়ত আপনারও আছে। হয়ত এর চেয়ে কম খারাপ বা আরও বেশি। বাসে নিয়মিত ওঠেন অথচ শরীরে কোন কদর্য ছোঁয়া পাননি, এ তো অসম্ভব! বাসে এ ধরনের আচরণ যৌন হয়রানির অন্তর্ভুক্ত হলেও এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। বাসে পুরুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং কটু কথা শোনার ভয়ে মেয়েরা সাধারণত অভিযোগ করেন না। আর যদি কেউ প্রতিবাদ করে ওঠে, তাহলে তঁাঁকে অপদস্ত করে সবাই মিলে। ‘এত সমস্যা হলে বাসে ওঠেন কেন’ - এমন কথাও শুনতে হয়। অন্ধের যষ্ঠির মতো চলাচল করে মহিলা বাস। নারীদের রাজত্বই চলে এখানে। এমনকি কনডাক্টরও এখানে নারী। শুধু চালকের আসনে থাকেন একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ। এই বাসে পুরুষের প্রবেশাধিকার থাকার কথা নয় একেবারেই। কিন্তু ফার্মগেটের খামারবাড়ির মোড়ে একদিন দেখা গেল ভিন্ন একটা চিত্র। জ্যামে আটকাপড়া দোতলা বাসটিতে জোর করে পুরুষ ওঠার চেষ্টা করছেন। সে এক ভয়াবহ চিত্র! সার্বিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণের কথা বলা হচ্ছে, অথচ প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকেই অবজ্ঞা করা হয় সবচেয়ে বেশি। তাহলে উন্নয়ন মন্থর হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। যেখানে যাতায়াত সুবিধাটাই নারীরা ঠিকমতো পাচ্ছেন না, সেখানে লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছানোটা তাঁদের জন্য কষ্টসাধ্য নয় কি? তাহলে সার্বিক উন্নয়নে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে কী করে? মোহাম্মদপুর, ঢাকা থেকে
×