ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল মান্নান চৌধুরী

যুদ্ধ জয় করল যারা ॥ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনী

প্রকাশিত: ০৮:১৭, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫

যুদ্ধ জয় করল যারা ॥ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনী

যে কোন দেশের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন বাহিনীর অংশগ্রহণ কোন বিরল বা অবিশ্বাস্য ঘটনা নয়। দূর অতীত বা নিকট অতীতেরই এমন প্রমাণ আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এমন বহু শক্তি বিভিন্ন ধারায় যুক্ত হয়ে একই লক্ষ্য অর্জন করেছে। দুর্ভাগ্য, কেবলমাত্র নিয়মিত বাহিনী ছাড়া অন্য সব বাহিনীর কথা ইতিহাসের পাতায় বড় একটি স্থান পায়নি। মুক্তিযুদ্ধে তদানীন্তন সৈনিক, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, মোজাহেদ বাহিনী নিয়ে গঠিত মুক্তি বাহিনীর গৌরবগাথা জাতির গর্বের বিষয়। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গণযোদ্ধারা। এই গণ-বাহিনীকে ভারতীয়রা বলত এফ এফÑ ফ্রিডম ফাইটার। আমরা সকল যোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বললেও তাদের বিভিন্ন শ্রেণীবিন্যাস ছিল। নিয়মিত বাহিনীর অধীনে গণবাহিনী বা যোদ্ধা ছাড়াও সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বা বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে ওঠা বহু বাহিনী যুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে। এমনি একটি বাহিনী হলো কাদেরিয়া বাহিনী। নিয়মিত বাহিনীর পরই কাদেরিয়া বাহিনী সম্পর্কে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এবং তাদের বিভিন্ন ফোরামে স্বীকৃতিও মিলেছে। কাদেরিয়া বাহিনী প্রতিপক্ষের হাতে নিন্দিত ও নন্দিত হয়েছে। এছাড়া অন্য যেসব বাহিনীর সন্ধান পাওয়া যায় সেগুলোর নাম হচ্ছেÑ আফসার বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, এবাদ বাহিনী, আলম বাহিনী ইত্যাদি। গণ-মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে কোন কোন বাহিনীর অধিনায়কসহ অনেককেই মাঝে মাঝে সংবর্ধনা দেয়া হলেও একটি বাহিনী সংখ্যা ও গুরুত্বের দিক থেকে অগ্রগামী থেকেও বিন্দুমাত্র স্বীকৃতি ও প্রশংসা লাভ তো দূরের কথা প্রতিনিয়ত শত্রুমিত্র ও গোত্রের কাছ থেকে নিন্দিত হয়েছে। এই বাহিনীটির নাম মুজিব বাহিনী। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এ বাহিনী সম্পর্কে যারাই অভিমত প্রকাশ করেছেন বা লিখেছেন, তারাই তাকে একটি ভিলেন বা খলনায়ক হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। বর্তমান লেখাটি সেদিক থেকে এ্যান্টিথিসিস। মুজিব বাহিনী ও তার সাংগঠনিক কাঠামো মণি ভাইয়ের কাছে শুনেছি মুজিব বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো আগেই মোটামুটি ঠিক করা ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সর্বাধিনায়ক করে সমগ্র দেশকে ৪টি অঞ্চলে বিভক্ত করে ৪ যুবনেতার প্রত্যেককে এক একটি অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয়। পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব পান শেখ ফজলুল হক মণি, উত্তর পূর্বাঞ্চল দেয়া হয় আবদুর রাজ্জাককে, উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয় যথাক্রমে সিরাজুল আলম খান ও তোফায়েল আহমদকে। তুলনামূলকভাবে পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চল ছিল অতিশয় অনুন্নত ও দুর্গম এলাকা। আঞ্চলিক প্রধানগণ অনেকটা অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের কমান্ড গড়তে থাকেন। প্রত্যেক আঞ্চলিক প্রধান তাদের হেড কোয়ার্টার লাইন ও স্টাফ জাতীয় কিংবা কার্যভিত্তিক সংগঠন গড়ে তোলেন। মুজিব বাহিনীর প্রতিটি আঞ্চলিক প্রধান এক বা একাধিক সহযোগী বেছে নিয়ে প্রধান কার্যালয় বিন্যস্ত করেন। পূর্বাঞ্চলে শেখ মণি তার শীর্ষস্থানীয় সহকর্মী হিসেবে তদানীন্তন ডাকসুর ভিপি আবদুর রব, জিএস আবদুল কুদ্দুস মাখন, প্রাক্তন ছাত্রনেতা ডা. নূরুল হোসেন চঞ্চল, আবদুল মান্নান এবং ছাত্রলীগ নেতা এম এ রশিদকে বেছে নেন। তার টু আই সি বলতে যা বুঝায় তা ছিলেন তারই বয়োজ্যেষ্ঠ খালাত ভাই ইলিয়াস আহমদ চৌধুরী (দাদা ভাই)। ইলিয়াস আহমদ চৌধুরীর সহকারী হিসেবে মুজিব বাহিনীতে আমার প্রবেশ নিশ্চিত হয়। পরবর্তী সময় ভাগ্যগুণে কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার থাকার কারণেই ইলিয়াস আহমদ চৌধুরীর অবর্তমানে তার দায়িত্বটি আমাকে দেয়া হয়েছিল। আবদুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খান মাত্র একজন সহকারী নিয়ে তাদের কেন্দ্রীয় কমান্ড সাজিয়েছিলেন। তাদের সহযোগী ছিলেন যথাক্রমে সৈয়দ আহমদ ও মনিরুল ইসলাম। আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও ছিলেন। তোফায়েল আহমদের প্রধান কার্যালয়ে একাধিক সহযোগী ছিলেন। তারা হলেনÑ নূরে আলম জিকু, কাজী আরেফ আহমদ, এনামুল হক। শেখ মণি পার্বত্যÑচট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট, ঢাকা, টাঙ্গাইল ও ফরিদপুরের একাংশের দায়িত্বে ছিলেন। উল্লিখিত জেলাগুলো এখন বৃহত্তর জেলা নামে পরিচিত। একটি জেলাতেই তখন কমপক্ষে তিন বা ততোধিক মহকুমা ছিল। একমাত্র টাঙ্গাইল ছাড়া বাকি জেলার মহকুমাগুলো এখন পরিপূর্ণ জেলা। আবদুর রাজ্জাকের দায়িত্বে ছিল সিলেটের কিয়দংশ, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা এবং ঢাকার কিয়দংশ। সিরাজুল আলম খান দায়িত্ব নিলেন দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, রাজশাহীর একাংশ এবং তোফায়েল আহমদের দায়িত্ব ছিল ফরিদপুর (কিয়দংশ) খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া ও রাজশাহীর একাংশ। প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রনেতা, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও শ্রমিক নেতাদের নিয়ে জেলা, মহকুমা, থানা কমান্ড গঠিত হয়। থানা কমান্ডের অধীনে প্রতিটি থানায় প্রতি দশজনকে নিয়ে একটি করে বেশ ক’টি গেরিলাদল গঠিত হয়। আমাদের পূর্বাঞ্চলে যারা নেতৃত্বে এলেন তারা ছিলেন প্রধানত প্রাক্তন ছাত্রনেতা, শ্রমজীবী, পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের বিভিন্ন সময়ের নেতা। ট্রেনিং সুবিধার স্বল্পতাসহ বিভিন্ন কারণে হাজারে হাজারে প্রশিক্ষণ প্রত্যাশীদের আমরা বিমুখ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তবুও যাদেরকে আমরা গ্রহণ করেছিলাম তাদের ডিগ্রীর বাহুল্য, নেতৃত্বের অবস্থান ও দীক্ষার ভিন্নতার কারণে অন্য কোন নিয়মিত বাহিনীতে তাদের আত্তীকরণ শুধু দুষ্কুর নয়, অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত হতো। স্বাভাবিক অবস্থায় তারা নিয়মিত বাহিনীর নেতৃত্ব মেনে নিত না। যার ফলে তারা হতাশা নিয়ে নিষ্ক্রীয় হয়ে যেত বা আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে আত্মÑবিধ্বংসী হয়ে উঠত। এমতাবস্থায় দেশের সোনার সন্তান, মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত এক বিশাল যোদ্ধার অংশগ্রহণ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বঞ্চিত হতো। কলহ, সংঘাত বা সংঘর্ষের কারণে নিয়মিত বাহিনীও মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করতে পারত না। এসব কথা চিন্তা করেই এলাকার ন্যাচারাল নেতাকে ভিন্ন কমান্ডে তার এলাকাতেই পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলো। হেড কোয়ার্টার্সে বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন দায়িত্ব দেয়া হলো। আমাদের অঞ্চলে কেউ পেলেন রিক্রুটমেন্টের দায়িত্ব, কেউ পেলেন ট্রেনিং, কেউ পেলেন ইনডাকশান, আবার কেউ পেলেন অস্ত্র, অর্থ ও রশদ সংগ্রহের দায়িত্ব। কারও দায়িত্ব হলো মটিভেশন বা প্রেষণা। এসবই ছিল মনি ভাইয়ের ইচ্ছায়Ñঅনানুষ্ঠানিক দায়িত্ব বণ্টন। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তিনিই রইলেন। তবে তিনি অর্থ, অস্ত্র সংগ্রহ ও অপারেশন প্লানিং আমাকে প্রথম থেকে ডাকতেন। আমাদের কিছু কেন্দ্রীয় জনসংযোগমূলক কার্যকলাপও চলত। শরণার্থী শিবির ছাড়াও মাঝে মাঝে যোদ্ধা সংগ্রহ, তদারকি ও সমস্যা সমাধানের জন্যে বিভিন্ন এলাকায় যেতে হতো। আমরা যা করতাম সেগুলো নিয়মিত বাহিনীর লোকেরাও করত। তবে আমাদের রণকৌশল ছিল সম্পূর্ণরূপে গেরিলা যুদ্ধ। অন্যান্য অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার দায়িত্বপ্রাপ্তদের কথা বলতে না পারলেও পূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন জেলার দায়িত্বপ্রাপ্তদের নাম এখনও স্মরণে আছে। শহীদ স্বপন চৌধুরীকে পার্বত্য চট্টগ্রাম, এএসএম ইউসুফকে চট্টগ্রাম, মোস্তাফিজুর রহমানকে নোয়াখালী, রেজাউর রহমানকে কুমিল্লা, ডা. নুরুল হোসেনকে কেন্দ্রীয় কামন্ড ছাড়াও সিলেটে, বোরহানউদ্দিন খান গগনকে ঢাকা, আবদুল বাতেনকে টাঙ্গাইল এবং মণি ভাই, শেখ সেলিম যৌথভাবে ফরিদপুরের অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন। এসব জেলা নেতারা তাদের মহকুমা প্রধান এবং থানা প্রধানসহ বিভিন্ন গেরিলা দলের নেতা নির্বাচন ও সামগ্রিক তদারকিতে ছিলেন। এতদিন পরে অনেকের কথাই ভুলে গেছি তবে এই অঞ্চলের মোস্তাক আহমেদ, ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম ও আফসার, মাহমুদুর রহমান বেলায়েত, রুহুল আমীন, শফীউল্লাহ্, মান্নান মজুমদার (মরহুম), শহীদ মোজাম্মেল, শহীদ আবু তাহের খন্দকার, শহীদ আবু জাহিদ, শহীদ সাইফুল ইসলাম সাপুর, নাজমূল হাসান পাখী, রোস্তম আলী, আকবর কবির, ইউসুফ, আবু তাহের, কেনু ভাই, রাজু ভাই, খসরু, মন্টু, ঢালি, মোয়াজ্জেম, রফিক (মরহুম), আবদুল আলী (মরহুম), আহসান উল্লাহ মনি, শরফুদ্দীন (মরহুম) ঢাকার শহীদ নজরুল, কিবরিয়া ও কুমিল্লার শহীদ নজরুলের নাম আজও স্মৃতিপটে আঁকা আছে। মাঝে মাঝে আজও শহীদরা আমাকে স্বপ্নে তাড়িয়ে মারে। আমাদের প্রতিটি অঞ্চলে একটি করে মেডিক্যাল ইউনিট এবং তার সঙ্গে ছাত্রীদের সমন্বয়ে নার্সিং ইউনিট সংযুক্ত ছিল। এই অঞ্চলের ডাক্তার ছিলেন ডাঃ আলী হাফিজ সেলিম (মরহুম) আর তার সহকারী ছিলেন মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও প্রাণ গোপাল দত্ত। ’৭১ সালে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পূর্বাঞ্চলে মুজিব বাহিনীর রিক্রুট শুরু হয়। রিক্রুটদের এনে আগরতলার অদূরে হাপানিয়ার গ্লাস ফ্যাক্টরির পরিত্যক্ত ভবনে রাখা হতো। আমাদের দেখাশোনার জন্য বিএসএফ-এর একটি ইউনিটজুড়ে দেয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের নির্বাচনের ব্যাপারে দীক্ষা, শারীরিক গঠন, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও পরিচিতির মাত্রাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হতো। কয়েকদিনের মধ্যে সিনিয়র লিডার ট্রেনিংয়ের জন্য বাছাইকৃতদের তান্দুয়া ও জুনিয়র লিডার প্রশিক্ষণের জন্যে হাফলংয়ে পাঠান হতো। এভাবে ট্রেনিং চলতে থাকে। উভয় কেন্দ্রে প্রথম দিকের ইন্সট্রাক্টরগণ ছিলেন ভারতীয়। প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে ক্রমশ মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষকগণই সমস্ত প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষকগণের মধ্যে হাসানুল হক ইনু, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, এএফএম মাহবুবুল হক, মাসুদ আহমদ রুমি, মোহন লাল সৌম, সফদার রহমান (জুডু) মনি, সৈয়দ আহমদ ফারুক প্রমুখ ছিলেন। দেরাদুনের প্রশিক্ষণ যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত চলতে থাকে। হাফলং ট্রেনিং কেন্দ্রের লিডারসহ মোট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লিডারদের সংখ্যা প্রায় চৌদ্দ হাজারের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল। আঞ্চলিক প্রধান, উপÑপ্রধান বা শীর্ষস্থানীয় মুজিব বাহিনীর নেতাদের পৃথকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আমাদের জন্য প্রশিক্ষণের বিষয় ছিল গেরিলা যুদ্ধ কৌশল, ভারতীয় বিভিন্ন অস্ত্রের ট্রেনিং, মুক্ত এলাকা গঠন প্রক্রিয়া, খালি হাতে লড়াই, বিমান থেকে অবতরণ। কমবেশি রাজনৈতিক ট্রেনিংও সবাই লাভ করেছে। প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং মে মাসেই সমাপ্ত হয়ে যায়। ট্রেনিং শেষে লিডারদের নিজ নিজ সেক্টরে ফেরত আনা হয়। তাদের যাতায়াতের জন্যে ভারতীয় বিমান বাহিনীর পরিবহন বিমানও ব্যবহার করা হতো। সেক্টরে ফেরত এনে প্রত্যেক দশজনকে দিয়ে একটি করে অপারেশন গ্রুপ গঠন করা হতো। প্রত্যেকের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হতো। দশজনের গ্রুপে একটি এলএমজি, স্টেনগান, এসএলআর, ৩০৩ রাইফেল, রিভলভার ও বিস্ফোরক দেয়া হতো। ধীরে ধীরে আমাদের যোদ্ধাদের মধ্যে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন, ৩ ইঞ্চি মর্টার, এসএমজি ও যোগাযোগের জন্য রেডিও সেট সরবরাহ করা হয়। এসব অস্ত্র যে শুধু ভারতে তৈরি ছিল তা নয়, অন্য দেশের অস্ত্রও দেদার পাওয়া যেত। বিস্তারিত পরিকল্পনাভিত্তিক বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ ও প্রেক্ষিত যোদ্ধাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করা হতো। ইনডাকশনের আগে গাইডরা আসত। তারা নিরাপদ আশ্রয়, রসদ ইত্যাদির ব্যবস্থা করে তবে নিয়ে যেতে আসত। অর্থের বিনিময়ে কোন কোন রাজাকার ইনডাকশনে সহায়তা করত। তবে মাঝে মাঝে বিশ্বাসঘাতকতাও হয়েছে। রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং ও ইনডাকশনের কাজগুলো গেরিলা যুদ্ধের রীতি ও নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অতি গোপনে করা যেত। কয়েকটি ব্যাচ ইনডাকশনের পরে বিষয়টি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নজরে আসে এবং এ ব্যাপারে তারা প্রধান সেনাপতি ওসমানী ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের কাছে অভিযোগ করেন। মুজিব বাহিনীর বিষয়টি সৈয়দ নজরুল এমনকি জেনারেল ওসমানীও জানতেন। দেশের অভ্যন্তরে এসে দশজনের দলটির প্রথম কাজ ছিল জনগণের মাঝে মিশে যাওয়া। এলাকার প্রাকৃতিক নেতা হিসাবে তাদের জনগণের মন জয়ের ক্ষেত্র আগেই প্রস্তুত ছিল। তারা এখানে এসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করত, রসদ সংগ্রহের জন্য সাহায্যকারী রিক্রুট করত এবং যোগাযোগ উন্নতির জন্য খবর আদানÑপ্রদানকারী নিয়োগ করত। দশজনের একটি দলকে অপারেট করতে আরও দশজন সহযোগীর প্রয়োজন হতো। ধীরে ধীরে দশজনের দল থেকে স্থানীয় রিক্রুট ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নিয়ে বাইরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১ জনকে নেতৃত্ব দিয়ে দশজনের একটি দল গঠন করা হতো অর্থাৎ বাইরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দশজনকে দিয়ে ১০টি অপারেশন টিম গঠন করা হতো। তাদের স্থানীয়ভাবে অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হতো। এলাকার অন্যান্য বাহিনীর যোদ্ধাদের সঙ্গে সুÑসম্পর্ক রাখার নির্দেশ থাকলেও সম্মুখ যুদ্ধের নির্দেশ প্রথমদিকে দেয়া হতে না। আমাদের প্রধান কৌশল ছিল ‘আঘাত কর, কেটে পড়’। উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর মনোবল ও স্নায়বিক শক্তি চুরমার করে দেয়া। নির্দেশ ছিল ফাঁকা আওয়াজ করে হলেও শত্রুকে বিনিদ্র রাত কাটাতে বাধ্য করা। শত্রুর চর, রাজাকার, শান্তি বাহিনীকে সন্ত্রস্ত্র, নিরস্ত্র ও নিবীর্য করার দায়িত্ব মুজিব বাহিনীর যোদ্ধাদের দেয়া হতো। এর মানে এই নয় যে তারা কখনও সম্মুখ লড়াইয়ে জড়াত না। আমাদের নির্দেশ অমান্য করেও তারা মাঝে মাঝে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে মিশে অপারেশনে চলে যেত। এজন্য কিছু খেসারত যে আমাদের দিতে হয়নি তা নয়। একবার দেশের অভ্যন্তরে চলে এলে দলপতি বা খবর বাহক ছাড়া অন্য কেউ কোন বেস ক্যাম্পে তেমন একটা আসত না। অস্ত্রশস্ত্র, গোলা বারুদ, বিস্ফোরক বা গ্রেনেড ফুরিয়ে গেলে পুনরায় সেগুলো নিতে কুরিয়ার বা দলপতি কয়েকজনকে নিয়ে আসতেন। এসব কারণে এক ব্যাচের যোদ্ধাদের সঙ্গে অপর ব্যাচের যোদ্ধাদের পরিচিত ঘটত না। সর্বাধিক গোপনীয়তার কারণে আমাদের সুশিক্ষিত যোদ্ধাদের এলাকাবাসী রাজনৈতিককর্মী বলে মনে করত। তাদের কাছে বিভিন্ন প্রচারপত্র বিশেষত সাপ্তাহিক ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকা ও ‘বাংলার বাণী’ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হতো। এসব কারণে আমাদের যোদ্ধাদের যোদ্ধা বলে মনে হতো না। যুদ্ধশেষে এরাই অস্ত্র প্রদর্শনের লোভ সামলাতে পারেনি। তখন অনেকে ভেবেছে তাদের জন্ম যুদ্ধের পরে। বিএলএফ ও মুজিব বাহিনী বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট বা বি.এল.এফ এর ধারণা ১৯৬১ সাল থেকে বর্ধিষ্ণু হতে থাকে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৪ সালের সমাবর্তন উৎসবকেন্দ্রীক আন্দোলনে তা আরও সঞ্জীবিত হয়। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানÑভারত যুদ্ধ না বাধলে হয়ত ১৯৬৬ সালের ৭ জুন হতো বি.এল.এফÑর সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর সশস্ত্র যুদ্ধ। মুজিব বাহিনী নামটি যুদ্ধকালে গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার নিদর্শন হিসাবে বি.এল.এফ নাম পরিবর্তন করে মুজিব বাহিনী রাখা হয় এবং তা একটি প্রকাশ্য বাহিনীতে পরিণত হয়। এই বাহিনী গঠনের প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়, তখন অনেকেই নিশ্চিত ছিলেন না যে, এই বাহিনী ছাড়া অন্য কোন বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবে কিনা। আগেই বলেছি, মুজিব বাহিনীর অধিকাংশ যোদ্ধাই ছিল উচ্চশিক্ষিত। তাদের বিশাল অংশ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রবৃন্দ। এছাড়া ছিল বিভিন্ন কলেজের ছাত্র সংসদের বিগত ২০ বছরের ভিপিÑজি. এস উচ্চ পদের সঠিক দীক্ষায় দীক্ষিত কর্মকর্তাবৃন্দ। যে সব মেয়েরা সেবামূলক বা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে তাদের পটভূমিও অনুরূপ। এই জাতীয় উচ্চশিক্ষার কারণেই তারা স্বল্প সময়ে অতি উন্নত মানের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক যুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। ভারতীয় প্রশিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বিরল কৃতিত্বে অভিভূত হতে দেখেছি। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ পূর্বেই অস্ত্র চালনায় পারদর্শী ছিল। শুধুমাত্র ভারতীয় অস্ত্রের সঙ্গে পরিচিতির জন্যে কিংবা উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তাদেরকে মূলত দেরাদুনে প্রেরণ করা হতো। তারা অতি উচ্চমানের শৃঙ্খলাবোধ ও আত্মত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিল আর বাংলাদেশের মতো দেশে গেরিলা যুদ্ধ করার জন্য জনÑসমর্থনের অধিকারীও তারা ছিলেন। মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা দেশে এসেই সাথে সাথে অপারেশনে চলে যায়নি। নিরাপদ আশ্রয় সৃষ্টি থেকে শুরু করে নতুন নতুন যোদ্ধা সৃষ্টির মাধ্যমে সারাদেশে জালের মতো তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এইসব নেতাদের স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল এমনকি তাদের অনেকের পরিবারই ছিল এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরিবার। যোদ্ধাদের সামাজিক সুদৃঢ়, অবস্থান ছাড়াও তাদের ছিল সংগ্রাম, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও দীক্ষার দীর্ঘ ঐতিহ্য, জনগণের সঙ্গে নিবিড় ও গভীর সম্পর্ক। এই কারণে জনগণই পানি এবং গেরিলারা মাছ হয়ে বাঁচতে পেরেছে। আদর্শবাদিতা ও অগ্নিশপথের কারণে অভাবÑঅনটনে, দুঃখÑদর্দশায় ও অন্যান্য প্রতিকূলতার মাঝেও তারা বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবিচল ছিল। আমাদের অত্যাধুনিক ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র থাকলেও আর্থিক বুনিয়াদ ছিল অতি দুর্বল। নয় মাসের যুদ্ধে সরকারের কাছে কোন অর্থ সাহায্য চাইনি বা পাইনি। গেরিলাযুদ্ধ ছাড়াও আমাদের যোদ্ধারা গতানুগতিক কায়দায় বিভিন্ন সময়ে লড়েছে। সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হবার নির্দেশ না থাকলেও তারা আস্তে আস্তে উন্মুক্ত হতে থাকে। পূর্বাঞ্চলের যোদ্ধাদের বিশাল অংশ গতানুগতিক যুদ্ধের মাধ্যমে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল এলাকা দখল করে। অবশ্য ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে এটা ছিল একটি সমন্বিত প্রয়াস। উদ্দেশ্য ছিল স্বদেশে মুজিবনগর সরকারকে প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বের স্বীকৃতি অর্জন। কিন্তু মিত্রবাহিনী গঠনের মাধ্যমে দ্রুত সম্মুখপানে এগিয়ে ঢাকাভিমুখী হবার কারণে মুজিব বাহিনীর শেষোক্ত উদ্দেশ্য সফল হয়নি। যুদ্ধের শেষের দিকে একে একে জেলাগুলো শত্রুমুক্ত হতে থাকে। আমরা সেসব জেলা বা মহকুমা শহরে দ্রুত গণ-প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও জানÑমালের প্রতিরক্ষার কাজে ব্যাপৃত হই। কেবল মাত্র তখনই সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে জানতে পারে আমরা একটি বিশাল বাহিনীর সদস্য। আমাদের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে গিয়ে আমরা এতকাল পরিচিতি গোপন রেখে হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করায় বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জন্ম হয়েছে। যুদ্ধকালে ও যুদ্ধ পরবর্তীতে মুজিব বাহিনী নিন্দিত হয়েছে। অবমূল্যায়নের এই ধারাটা চলমান ছিল বলেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের সামান্য স্বীকৃতি দিতেও ভুলে গেছে। যুদ্ধ শেষে মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা নীরবে, নিঃশব্দে স্ব স্ব ক্ষেত্রে ফিরে গেছে।
×