স্মৃতির উদ্ভাস
মতিন বৈরাগী
আর যদি সেই জায়গাটা খুঁজে পাওয়া যায় কখনো
আর যদি আশপাশ কণ্টকাকীর্ণ না হয় কিংবা গোক্ষুর না হাঁটে
আর যদি সেই শিরীষগাছটা যে ছিল নিশানা
আর সেই নদী যেটা ছিল খরস্রোতা
আর যদি সেই নদী তীর থেকে পঞ্চাশকদম দূরত্বটা
আর সেই স্মৃতি যদি ঠিকঠাক সক্রিয় আগের মতোন
আর তাদেরকে গোর দেয়া হয়েছিল খুব গোপনে
আর পাজ্ঞাবী জ্বালিয়ে দিচ্ছিল গ্রাম মুক্তি মুক্তি বলে
আর পাঞ্জাবী খুঁজছিল ‘জয়বাংলা’
আর সেসব অনেক দিন হয়ে গেছে তুমি বললে:
আর আমি বললাম আমার তো মনে হয় সে কেবল সেই দিন
আর আমি সব কিছু থেকে পালিয়ে ছিলাম
আর আমি বলেছি কিচ্ছু জানি না কেউ জিজ্ঞেস না করতেই
আর যখন দেখি সেই তারা নিজের দিকে টানছে সব পাঞ্জাবীর মতো
আর আমি বলছি
আমি ওসবের কিচ্ছু জানি না
আর তা কেউ জিজ্ঞেস না করলেও ।
মুখ ফেরাও
সাযযাদ কাদির
ভালবাসো, শান্তি-কল্যাণ পাবে
হাসি দেখবে নারীর চোখেমুখে।
ভালবাসো, মহান বিজয় পাবে
শুনবে শিশুর কল-কলহাসি।
হিংসা করো, ঘৃণা ও আক্রোশ পাবে
দেখবে মানবতার রক্তস্রোত
মায়ের কান্না পাবে, শিশুর চোখে জল।
বারুদের ধোঁয়া, আগুন তো কেবলই ছড়ায়
কোন সাগর সেঁচে নেভাবে তাকে?
হৃদয়ে হৃদয়ে পোড়ে দুঃখ
দেখি মৃত্যু অর্থহীন, নিস্ফল, অকারণ।
ভালবাসো, অস্ত্র নয় পুষ্প
হাত বাড়াও বন্ধনে
মুখ ফেরাও সূর্যের দিকে
চলো, আবার হাঁটি সেই সুকঠিন পথে
আনি আরও এক বিজয়।
০৩.১২.২০১৫
যুদ্ধদিনের স্মৃতি
জাফর ওয়াজেদ
তুমি তখন করাচীতে পাকিস্তানের জিন্দাখানায়
কাটছে দিন কেমন করে সবই ছিল অজানায়
আমি তখন মেলাঘরে সময় কাটে ছাউনিতে
ট্রেনিং নেই সমুখযুদ্ধে হানাদারে হটিয়ে দিতে
সকাল বিকাল মার্চপাস্টে- রাতে ভাবি তোমায়
তুমি কি আর যুদ্ধ বোঝ, ঝরে প্রাণ বাংলায়...
রক্তে বারুদে খেলছে হোলি বাংলাদেশের মানুষজন
গণহত্যায় প্রাণ দিয়েছে অকাতরে, নির্যাতিত মা-বোন
আমরা তখন পাকিস্তানী দেখলে পরে নিধন চাই
সুযোগ পেলে অতর্কিতে হানাদারের প্রাণ খসাই
তুমি তখন করাচীতে বাপে তোমার পাকি সেনা
দেশের প্রতি থাকলে মায়া কে হয় আর খানসেনা
করাচীতে আটকে পড়া বাংলাভাষীর দলেও তুমি
আমরা তখন লড়াই করি মুক্ত করতে স্বদেশভূমি।
তোমাকে যেভাবে পেয়েছি
নাসরীন নঈম
অবশেষে তোমাকে পেয়েছি স্বাধীনতা
ঝুঁটি তোলা মেঘের জমাট গায়ে
একটি একটি করে তীর ছুড়ে
তোমাকে পেয়েছি স্বাধীনতা।
তুমি খরায় প্লাবনে মাতমে ছেঁড়া হাওয়ায়
ভাঙাছাতার মতোই চিরদিন অবিনশ্বর
হাঁটার সিঁড়িতে অর্জিত অহঙ্কার তুমি
পাঁজরের হাড় ভেঙে ভেঙে তোমাকে গড়েছি
সময়ের কাছে গচ্ছিত রেখেছি রক্তের দরিয়া
তুমি প্রিয় সুখ স্বাধীনতা।
জানো তো কতটা পলাশ বকুল আর প্রজ্বলিত
আগুনের শিখার ওপর বসেছিলাম এতটা দিন
মধ্যরাতের শরীরজুড়ে আত্মরতির দহনে দহনে
চন্দন কাঠের সোনালি প্রলেপ ঘষে ঘষে আমাদের শুদ্ধ হয়ে ওঠা।
ধেয়ে আসা ঢেউয়ের মাথায় ফেনার মতো
দিন আসে রাত যায়। লোহার খাঁচায় আর নয়
যেখানে ঘামের গন্ধে মানুষের স্বপ্ন জেগে ওঠে
বঞ্চনার ঋণ শোধ নিয়ে আসে অধিকারের বারতা।
তোমাকে এভাবেই পেয়েছি
স্বাধীনতা।
হাওয়া বাতাস
সরকার মাসুদ
ওই কাশফুল মেঘ রওনা দেয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছে
শুধু আমার সম্মতির অপেক্ষা!
এই ঝিরিঝিরি লম্বা ঘাস, পানির ওপরের,
আবার দোল খাওয়ার জন্য রেডি হয়ে আছে...
খালি আমার সংকেতের জন্য যা একটু দেরি!
হাওয়া কী দেয় আমাদের
হাওয়া উস্কে দেয় বিশ্বাস আর সংশয়
ছিন্নবৈচিত্র্যের দিন হাওয়া আবার
যোগসূত্র তৈরি করে হৃদয় ও জলছবির মাঝে!
বাতাস বয়ে নিয়ে যাবে এই পলিথিন মেঘ
কিন্তু কোথায়?
পানিবর্তী লম্বা ঘাস, ছিটপোকা, ছোটগল্পের কল্পছবি
ফুটবে আঁধারে!
শরতের রঙপাগলের মন পাল তুলে দিয়েছে মেঘের নদীতে
হাওয়া তৈরি করেছে নড়বড়ে সাঁকো
হাওয়া ছিঁড়ে দিয়েছে রঙিন সুতা
ভাদ্রের লুকোচুরি রোদে
হাওয়া আনে ভালোবাসার ভুয়া আশ্বাস
ডালপালার ফাঁকে ছেঁড়া আশা ঝুলে থাকে সুতাকাটা ঘুড়ি।
স্মৃতির পাঁজর
রেজাউদ্দিন স্টালিন
আবারো গুলির শব্দে সচকিত স্মৃতির পাঁজর
এফোঁড়-ওফোঁড় সব স্বপ্ন-সহোদর
ডুকরে ওঠে সত্তর মিছিলের মাস
ফুঁসে ওঠে একাত্তর বারুদে বিশ্বাস
বার বার শুরু হয় প্রতীক্ষার পালা
ফিরে আসে গেরিলার গভীর গর্জন
চোখে মুখে ষড়যন্ত্র ঘাতকেরা ঘোরে
ফিস্-ফাস শব্দ ওঠে গাঁ-গঞ্জ, নগরে-বন্দরে
এ সময়ে মানুষের আহ্বানে ফিরবে কি আর্গোনটগণ
স্বর্ণমেষের চেয়ে দামী আজ স্বদেশের মাটি
ইথাকা অরক্ষিত
লক্ষ-লক্ষ সূচকন্যা পেনোলপি নক্সীকাঁথা বোনে
আর গুনগুনিয়ে আবৃত্তি করে-
এক জীবনে কেউ মাতৃভূমির জন্যে যদি
যুদ্ধে যেতে পারে
এবং মৃত্যুর সাথে মুক্তির বদল দিতে সমর্থ হয়
তার চেয়ে সার্থক জন্ম নেই এই বাংলাদেশে
সন্ধ্যালতার স্বীকারোক্তি
ফকির ইলিয়াস
কবিতাটি এখনও লিখিনি। তবে লিখবো। তার শরীর
থাকবে পুনর্বাসন সংক্রান্ত। আর ছায়া থাকবে,
প্রেমপুরের পরীদের ডানা যেমন-
থাকবে কিছু আগুনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখার
সরঞ্জাম। কয়েক টুকরো মোমবাতি। কিছু শুকনো
পাতা। ভাঙনের দখলে যাওয়া কয়েকটি ঋতু। এবং
এই শহর ছেড়ে যেসব মানুষ একাত্তরে পালিয়েছিল
ভয়ে, আর যারা আশ্রয় দিয়েছিল- তাদের যৌথ ইশতেহার।
থাকবে একমুঠো মাটির গলিত দাগরেখা। যে দাগ
দেখে আমাকে শনাক্ত করেছিল প্রিয় চিত্রকরের তুলি-
আর বনেদি বাউল আমাকে বলেছিল, তুমি গান লিখো
কবিয়াল, আমি সেই গানে ঢেলে দিতে চাই সুরমার সুর।
কবিতাটি এখনও লেখা হয়নি আমার।
সন্ধ্যালতার স্বীকারোক্তি পেলেই শুরু করবো ভেবেছি-
কিছু শব্দ ধার নেবো,
নদীর কাছ থেকে, কিছু শব্দ-
আকাশকে কোনোদিনই আমি আর ফিরিয়ে দেবো না।
প্রিয় রোকোনালী
মাকিদ হায়দার
অনায়াসে পার পাবি ভাবিসনে তোরা,
আমার মাতুলকে যারা বসিয়ে রেখেছিস
হুইল চেয়ারে।
বিনা দোষে, অকারণে রেখেছিস বৃদ্ধাশ্রমে
অথচ, মাতুল আমার হননি
তেমন বৃদ্ধ,
যেমন হননি তিনি তোদের সেই চুক্তিযুদ্ধের বছরে
অথচ, তোরা আমার মাতুলকে
রেখেছিস হুইল চেয়ারে।
মাতুল জানিয়েছেন আমাদের
তোরা সকলেই হারামির হাতবাক্স
শিম্পাঞ্জির নিকট আত্মীয়, অধস্তন বংশধর
দিন-রাত্রি যতো শলাপরামর্শ করিসনে কেন
রক্ষা পাবিনে কখনো কোনদিন।
আমার মাতুলকে তোরা ক’ভাই ভুলিয়ে দিয়েছিস, দেশপ্রেম,
সেই সঙ্গে এখানে-সেখানে বলছিস, প্রিয় রোকোনালী নাকি
চুক্তিযুদ্ধবিরোধী। ঘাতক দালাল
অথচ তোরা একবারও ভেবে দেখিসনে, মামা ছিলেন শান্তির দূত
কমিটির প্রধান, শান্তি কমিটি ছিল বলে অশান্তির বদলে শান্তির
মায়া ছিল ঘরে ঘরে,
সেই ছিল মাতুলের প্রিয় অভিপ্রায়।
নৌকাপ্রিয় চুক্তিযোদ্ধারা এখনি ফিরিয়ে নিয়ে যা
হুইল চেয়ার,
সময় আমাদের সকলের নয়নমণি, বলেছেন তিনি
সময় সুযোগ পেলে দেখে নেবে তোদের একবার।
যেভাবে তোরা জানিয়েছিলি চুক্তিযুদ্ধের বছরে।
নুনাপানি
সৈয়দ রফিকুল আলম
ইকো ভারসাম্যের জিম্মিÑ লক্ষ কোটি মানুষের অশ্রু
নিপাতে ধরিত্রী স্থানু নিশ্চল নীরবে ঝিম ধরে
বসে আছে, গতানুগÑ প্রকৃতির খেয়ালীপনারÑ
বিভ্রম ইচ্ছানুরাগে আকাশী মেঘালয়ের স্তম্ভ
হতে শীলাবৃত্ত ফোঁটা, তীর ধনুকের অনির্বাণ
ফলক-ফোঁড় ব্যবচ্ছেদে মাটির কোমল অস্তিত্বের
খ--বিখ- ফাটলে; ভূ-বৈচিত্র্যের চিত্রমায়ার
মোহনীয় দৃশ্যভোগ চোখের উপড়ে বীভৎস
কালিমালিপ্তে আঁধার করে দেয়। সবুজ পাহাড়
ধসে পড়ে ভূ-কম্পন প্রলয়ঙ্করী আক্রোশ বেগে,
অর্ধমৃত মানুষেরা ঘুমঘোরে তলের বসত
ভিটেয় মাটির চাপা ধসে লাশের মিছিলে লীন
হয়ে নিশ্চিত বিয়োগে মাহফেজখানা ক্রমিকে
যোগ হয়। প্রকৃতির ভারসাম্যের সুদৃঢ় প্রস্তুতি কাম্য।
প্রতীক্ষায় আছি
দাউদ হায়দার
হত্যার মোটিফ কি , অজানা?
অয়ি সুহাসিনী, পূর্ণ হোক তোমার কামিয়াব?
সন্ত্রাসের পুরোনো ঘরানা
পাল্টেছে আমূল ধুলোয় লুণ্ঠিত আমার কিংখাব
পথেবিপথে সশস্ত্র গু-ারা, গভীর বিভীষিকা
আর্তনাদ?ঘাসমাটি-নদী-বাগান-উদ্যান
মুহূর্তে তছনছ?শান্তি ও গণতন্ত্রের নামে আমেরিকা
হত্যা করেছে ইরাক, আফগানিস্তান
চার্লস নদের তীরে সন্ধ্যায়, বস্টনে
কবি বদিউজ্জামান নাসিমের আর্তস্বরে
প্রশ্ন : এখনো কি নিষেধাজ্ঞা ফেরায়, আঙনে?
আমৃত্যু রয়ে যাবে প্রবাসে, পর-ঘরে ?
অয়ি সুহাসিনী , অয়ি প্রিয়তমে
আমাকে কখন হত্যা করবে অবাচী-
মেঘ জানবে না, প্রকাশিত করো সমে
প্রতীক্ষায় আছি
১২ ডিসেম্বর ২০১৫
বার্লিন, জার্মানি
পিতার পাঁজর
মারুফ রায়হান
কোথায় খুঁজছো তুমি জনকের অস্থি
তুমি কি জানো না গোটা দেশে মিশে আছে
পিতার পাঁজর
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে ব্যাপ্ত বধ্যভূমি
কোথায় খুঁড়ছো তুমি বাংলার হƒৎপিণ্ড
যেখানেই হাত দেবে মুক্তিযোদ্ধার স্মারক
জননীর অশ্রুধারা আজ বাংলার তের শত নদী
রক্তধারা মিশে আছে বঙ্গোপসাগরে
লাল ও সবুজে মোড়া প্রতি ইঞ্চি জমি
পিতার পাঁজর বুকে ধরে আছে
একাত্তর-উত্তর প্রজš§ তুমি
চিনে নাও আজ সেই পবিত্র জমিন
যাঁকে খুঁজে ফেরো পাবে তাঁকে সুনিশ্চিত
অনুভব করবে অন্তরে
যদি ঊর্ধ্বে তুলে ধরো
তাঁরই রক্তে ধোয়া দেশের সম্মান
১৬ ডিসেম্বর
জাহানারা জানি
দু’গালে দিয়ে দুটি, স্মরণের চুমো
ঘুমো মা ঘুমো, গেলে শুধু বলে
যাচ্ছি মা তোর সনদ আনতে,
চৈত্রের মাঠে ফলাবো সোনার ফসল,
সুকান্তের ঝলসানো চাঁদের দেশে
ঝরাবো আলোর প্লাবন
ক্ষুধার্ত আগুন জ্বলবে না আর অতৃপ্ত প্রহরে।
বৃথায় ছিল বাক্য ব্যয়, কিছুই বুঝিনি তখন
শুধু বনপোড়া হরিণী শাবকের মতো
তুর-তুর করে কেঁপেছিল বুক অজানা ভয়ে
কোমল কণ্ঠে তুলে সুর
বলেছিলাম বাবা আসবে কবে?
বাবার চোখে ছিল দীপ্ত অঙ্গীকার
সান্ত¡নার ভাষা ছিল না জানা তার,
গম্ভীর গলায় তুলে গৌরবের সুর
শুধু বলেছিল পথ ছাড় লক্ষ্মী সোনা,
যাচ্ছি মা, তোর সনদ আনতে!
মায়ের চোখে তখনও ছিল চকচকে আশা
অশ্রুতে ঝরছিল অব্যক্ত ভাষা
আমার চোখে এলো রাজ্যের ঘুম
আমি ঘুমিয়ে ছিলাম যেন তিন দশক
ততক্ষণে মা আমার ভেসে গেছে
নিয়তির স্রোতে, ভিক্ষার থলি হাতে
মা এখন মোজাইক শহরে হাঁটে,
বাবা এসেছিল কিনা জানি না আজও!
হঠাৎ সুউচ্চ মিনারে মিনারে,
আর বস্তির বাবলুর হাতে
পতাকা দেখে আর ঐ
টোকাই টেপুটার ভাষণ শুনে
মনে হয় বাবা একবার এসেছিল
নিশ্চয়, ষোলই ডিসেম্বরে
ষোলই ডিসেম্বরে।