ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার মানুষের দুর্জয় সাহস, ঐক্য এবং ধৈর্য ছিল সুদৃঢ়। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টকে অতিক্রম করে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। লাখো শহীদের আত্মত্যাগ এবং কোটি মানুষের সম্পদ ও মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা বিশ্বে বাঙালীদের মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় আমি কলেজের ছাত্র, জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। গণআন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালী ফুঁসে উঠল। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজ হয়ে আন্দোলনের ঢেউ লাগে স্কুল পর্যায়ে। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আমরা মিছিলে যেতাম বড় ভাইদের আহ্বানে। পাকিস্তান জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের প্রচারে আমরা ছাত্ররা অংশ নেই। বক্তৃতা ভালই দিতে পারতাম। এ কারণে অগ্রজ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন স্থানে আমাদের নিয়ে যেতেন জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার জন্য। জনসভার শুরুতে বক্তৃতা দিয়ে আমি আসর গরম করতাম। সমগ্র জেলা চষে বেড়াতাম আহমেদ রফিক, আমি, আব্দুস সাত্তার লালু, রফিকুল ইসলাম বকুল, ফজলুল হক মন্টু, পাকনসহ কয়েকজন। ছাত্র-যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতে দিন-রাত কাজ করতাম। নাওয়া-খাওয়া অনেক দিন হতোই না। চিড়া-গুড়-মুড়িতেই সারাদিন চলে যেত। এখনকার মতো তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল ছিল না। কখনও হেঁটে, ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বা নৌকায় যাতায়াত করতে হতো। নেতাকর্মীদের মধ্যে ছিল গভীর সখ্য এবং আন্তরিকতা। অগ্রজদের সম্মান করত অনুজরা। আমরা বড়দের আদেশ-নির্দেশ বিনা বাক্যে মাথা পেতে কাজ করতাম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সব প্রার্থী জয়লাভ করলেন। বৃহত্তর পাবনা জেলার (পাবনা ও সিরাজগঞ্জ) সব জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীগণ জয়লাভ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের ৩শ’ আসনের ২শ’ ৮৮টিতে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। আমরা ছাত্র-জনতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ বসবে। কিন্তু ক্রমেই আমাদের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল। বুঝলাম, পাকিস্তানীরা সহজে বাঙালীর হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে লাগল পাকিস্তানের নেতারা। ওরা ঢাকা-চট্টগ্রামে সৈন্য সমাবেশ করাসহ সারাদেশে সৈন্য প্রেরণ করে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিতে লাগল। অবস্থা দেখে মনে হলো পাকিস্তানীরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। অধীর আগ্রহ এবং শঙ্কায় অপেক্ষা করতে হলো সকলকে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিলেন। তখন আমি পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। আহ্বান জানালেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার। ওই দিন আমরা কয়েক বন্ধু বসে ছিলাম রেডিওতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনবার জন্য। কিন্তু ভাষণের পরিবর্তে রেডিওতে গান বাজানো হচ্ছিল। পরে জানা গেল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজানো হবে না। পর দিন সকালে অবশ্য বঙ্গবন্ধুর রেকর্ডকৃত ভাষণ রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আহ্বান মোতাবেক আমরা প্রস্তুত হতে শুরু করি। প্রতিদিন শহরে মিছিল হতো, আমরা ক’জন থাকতাম মিছিলের অগ্রভাগে। আমাদের স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব-শেখ মুজিব’ ইত্যাদি। পুরনো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট মাঠে ছাত্র-যুবক-কৃষক-জনতা ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে জড়ো হলো। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর আমজাদ হোসেন, আমিনুল ইসলাম বাদশা, প্রসাদ রায়, মহবুবুল হক ওরফে ফেরু দেওয়ান, রণেশ মৈত্র, আব্দুর রব বগা মিয়ার তত্ত্বাবধায়নে পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা কসিম উদ্দিন শরীরিক এবং মানসিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন। আমি যেহেতু রাইফেলস ক্লাবের সদস্য ছিলাম, আমরা রাইফেলস ক্লাবের কয়েক সদস্য মাওলানা কসিম উদ্দিনের সহকারীর দায়িত্ব পালন করতাম। জাতীয় পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমজাদ হোসেন নাটোর থেকে পাবনা ফেরার পথে হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন। আমরা একজন বিজ্ঞ দেশ দরদী নেতাকে হারালাম যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ২৫ মার্চের মধ্যেই পাকিস্তানী বাহিনী পাবনায় অবস্থান নেয়। হানাদার বাহিনী শহরের পুরনো টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এবং বিসিক শিল্প নগরীতে অবস্থান নেয়। আমরাও প্রস্তুতি নেই। জেলা প্রশাসক নূরুল কাদির খানের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। পুলিশের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারাও আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার থেকে আমাদের অস্ত্র সরবরাহ করা হলো। এ সময় নকশালপন্থীরাও অস্ত্রের দাবি করলে তাদের সঙ্গে বিরোধ হয়। উল্লেখ্য, নকশালপন্থীদের সঙ্গে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই পাবনায় দ্বন্দ্ব ছিল আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের। মার্চের শেষ সপ্তাহের দিকে পাবনায় অবস্থান নেয়া প্রায় পঞ্চাশ জন পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের হাতে নিহত হয়। দিনভর যুদ্ধ হয় পুরনো টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনকে ঘিরে। হাজার হাজার জনতা দেশীয় অস্ত্রসহ পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘিরে রাখে এবং মুহুর্মুহু ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আকাশ-পাতাল প্রকম্পিত করে রাখে। হানাদার সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। এভাবে ১০ দিন পাবনা শত্রু মুক্ত থাকে। এর পর শহরে বিমান থেকে পাকিস্তানী বাহিনী গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আমরা নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেই। ছাত্র-জনতা বেশ কয়েকজন ইপিআর সদস্য এবং পুলিশের সঙ্গে নগরবাড়ী ঘাটে অবস্থান নেয়। ৯ এপ্রিল হানাদার বাহিনী জল, স্থল এবং আকাশপথে আমাদের অবস্থান বা বাঙ্কারের ওপর গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে। আমাদের কাছে ছিল হাল্কা অস্ত্র। পাকিস্তানী বাহিনীর ভারি মেশিনগানের গুলি, শেল নিক্ষেপ এবং ওপর থেকে বিমানের গুলিবর্ষণে আমরা টিকে থাকতে পারছিলাম না। আমরা আমাদের কমান্ডারের নির্দেশে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেই। হানাদার পাক সেনারা আরিচা ঘাট থেকে গোলাবর্ষণ করতে করতে ফেরি, লঞ্চ এবং নৌকায় যমুনা নদী পার হয়ে পাবনার খানপুর হাই স্কুলের মাঠে জড়ো হয়। সেখান থেকে তারা বিমানবাহিনীর ছত্রছায়ায় ১১ এপ্রিল সকালে অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার সময় হানাদাররা সড়কপথের দু’ধারের বাড়িঘর, দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে। নগরবাড়ী থেকে কাশিনাথপুর হয়ে আহম্মদপুর, বনগ্রাম, চিনাখড়া, আতাইকুলা, পুষ্পপাড়া বাজারসহ সড়কের উভয় পাশের বাড়িঘর পুড়িয়ে পাবনা শহরে প্রবেশ করে বিকেল বেলায়। হানাদার সৈন্যরা এ সময় গানপাউডার ব্যবহার করে। যেখানে যে অবস্থায় যাকে পেয়েছে গুলি করে হত্যা করে। দৃষ্টির মধ্যে পড়া কৃষককে গুলি করে হত্যা করে। অনেক কৃষক ক্ষেতে কাজ করা অবস্থায় গুলিতে নিহত হয়। অনেক গবাদিপশু মারা যায় পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলিতে। আমরা পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হই। আমাদের দলে ছিলেন ভাষাসৈনিক আমিনুল ইসলাম বাদশা, রফিকুল ইসলাম বকুল, রবিউল ইসলাম রবি, ইকবাল হোসেন, শিরিন বানু মিতিল, আবুল কালাম আজাদ বাবুসহ ১০ জন। নৌকায় পদ্মা এবং গড়াই নদী অতিক্রম করে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা-মিরপুর হয়ে শিকারপুর-প্রাগপুর হয়ে ১১ এপ্রিল কেচুয়াডাঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যোগ দেই। ১৬ এপ্রিল রাতে আমরা জানতে পারি ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (পরে নামকরণ হয় মুজিবনগর) অস্থায়ী সরকার গঠন করা হবে। পাবনার জেলা প্রশাসক নূরুল কাদির খান, রফিকুল ইসলাম বকুল, মোহাম্মদ ইকবাল এবং আমি মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। আমরা শ্রদ্ধেয় এম মনসুর আলীর সঙ্গে ছিলাম সার্বক্ষণিকভাবে। মুজিবনগরের আম্রকাননে আমাদের সঙ্গে নূরুল কাদির খান সাহেব পরিচয় করিয়ে দেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম এবং ড. আহসাবুল হক এমপির সঙ্গে। শপথ গ্রহণ শেষে ভারতীয় এবং বিদেশী সাংবাদিকদের যানবাহনের বহরে একটি জীপে আমরা ক’জন কলকাতায় ফিরে যাই। সেখান থেকে পরদিন আমরা চলে যাই কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে। কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে আমাদের প্রশিক্ষণ দেন পুলিশের আর আই আবুল খায়ের। উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য সহযোগীদের পাঠনো হলো ভারতের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে। আমাকে কেচুয়াডাঙ্গা যুব ক্যাম্পে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। বন্ধু মুক্তার হোসেনকে দেয়া হয় রেশন দ্রব্যাদি সংরক্ষণের দায়িত্ব। এ সময়ই আমরা ক’জন ছাত্রনেতা ভারতের নেত্রীবৃন্দের সার্বিক সহযোগিতার জন্য বিশেষ করে অস্ত্রের জন্য কলকাতায় যাই। কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে একদল ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবক আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে সাংবাদিকদের সামনে নিয়ে গেলেন। আমি আমার সহযাত্রীদের পক্ষে সাংবাদিকদের কাছে পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতার বর্ণনা দিলাম। তখন ভারতে লাখ লাখ শরণার্থী প্রবেশ করছে। বানের পানির মতো শরণার্থীর স্র্রোত। কলকাতায় সাক্ষাত হয় এম মনসুর আলীর পুত্র আমাদের অগ্রজ নেতা মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে। কয়েকদিন কলকাতায় থাকার পর মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে বিভিন্ন যুব ক্যাম্পের পরিস্থিতি দেখার জন্য রওনা হই। বিভিন্ন যুব কাম্পে আমরা যুবকদের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য কথা বলতাম। দেশের অভ্যন্তরের খবর অনেক যুবকই জানতেন না। তারা ভারতে গমন করেছেন মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে। কিন্তু তাদের মন ছিল ভারাক্রান্ত, কিন্তু চোখে ছিল দীপ্ত শপথ এবং অসীম তেজ। কারণ তারা তাদের বাড়িঘর এবং স্বজনদের রেখে গেছেন। স্বজনরা কে কেমন আছে এই ছিল তাদের চিন্তা। বাড়িঘর পাকিস্তানী হানাদাররা পুড়িয়ে দিয়েছে, অনেকের বাবা-মা ভাই-বোনকে হত্যা করেছে। বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণরত যুবকেরা ছিলেন শোকাহত। কিন্তু তাদের ছিল দুরন্ত সাহস। মোহাম্মদ নাসিম এবং আমি তাদের উদ্দেশে অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতা দিতাম। যুবকদের তখন বেশ উজ্জীবত হতে দেখেছি। দেশমাতৃকার জন্য তাদের কষ্ট এবং ত্যাগের কথা কখনও ভুলব না। প্রশিক্ষণরত যোদ্ধারা অস্বস্তিতে থাকলেও যুদ্ধের সময় চরম সাহসিকতা, ধৈর্য ও মনোবল স্বাধীনতাকামীদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মধ্য অক্টোবরে ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে যুদ্ধকালীন সময়ের যুবকমান্ড নেতা তোফায়েল আহমেদের কাছ থেকে অস্ত্র গ্রহণ করার পর সেখানে আমাদের বিদায় দেন বেবী ইসলাম। মোহাম্মদ ইকবালের নেতৃত্বে প্রাগপুর সীমান্ত অতিক্রম করে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হয়ে পাবনা শহরের পশ্চিম দিকের পদ্মার আফতাবনগর চর এবং চর গড়গড়িতে অবস্থান নেই। সেখানে আমরা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেই। কিন্তু প্রথমেই আমরা বাঁধার সম্মুখীন হই। সেই পুরনো শত্রু তখনও আমাদের পিছু ছাড়েনি। পাবনা শহরের পশ্চিম দিকের পদ্মা নদীর চর সানিরদিয়ারে অবস্থানরত নকশালরা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আমাদের ক্যাম্পের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমরাও পাল্টা গুলি করতে থাকি। নকশালদের সঙ্গে যোগ দেয় পাকিস্তানী মিলিশিয়া বাহিনী। সারারাত যুদ্ধ চলে। আমাদের অকুতভয় গেরিলা যোদ্ধারা সামান্য গোলাবারুদ দিয়েই তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। পরে পাকিস্তানী সৈন্যরা নকশালদের সঙ্গে যোগ দেয় ভারি অস্ত্র নিয়ে। তখন আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। আমরা নিরাপদ স্থানে ঈশ্বরদীর দাদাপুর চরে চলে যাই। এই যুদ্ধে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ। যুদ্ধে নকশালদের দুজন নিহত হয়। তার মধ্যে একজন ছিলেন টিপু বিশ্বাসের ভাই। ওই যুদ্ধে রফিকুল ইসলাম বকুল, মোহাম্মদ ইকবাল ছাড়াও অংশ নেন ফজলুল হক মন্টু, ইসমত হোসেন, আবুল কালাম আজাদ বাবু, মকবুল হোসেন সন্টু, হাবিবুর রহমান হাবিব, শাহাদত হোসেন সন্টু, জহুরুল ইসলাম বিশু, অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু, সেলিম, মোহন, সোটকা, রুকু, জিন্নাহ, রাজ্জাক, আব্দুর রহিম পাকন, শরীফ, শহিদুল্লাহ প্রমুখ সাহসীযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের পাবনাবাসীকে তথা মুক্তিযোদ্ধাদের একাধারে তিন শত্রুকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। প্রথমত চীনপন্থী বা মাওবাদী নকশালদের, তারপর হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের এবং মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীদের। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল হিসেবে আমরা আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করি। রফিকুল ইসলাম বকুল এবং জহুরুল ইসলাম বিশু একটি গ্রুপ নিয়ে সুজানগর এলাকায় অবস্থান নেয়। এর পর আমি চলে যাই কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোডের বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কার্যালয়ে। থিয়েটার রোডের কার্যালয়ে আমরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতাম। কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল অতিথিদের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করা। বিশেষ করে বিদেশী সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরের পরিস্থিতি তুলে ধরা এবং তাদের সঙ্গে শরণার্থীদের কথা বলার সুযোগ করে দেয়া। এর বাইরেও আমরা ক’জন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতাম। কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কলকাতা শহরে ব্লাক আউট। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী এবং বিবিসি রেডিওতে আমরা পাকিস্তানীদের পরাজয়ের খবর শুনে ক্যাম্পে বসে উল্লাস করি। ঢাকার দিকে মিত্র সেনাদের অগ্রযাত্রা। যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন। আমি কলকাতা থেকে ১৪ ডিসেম্বর কেচুয়াডাঙ্গা যাই। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে। ১৭ ডিসেম্বর আমরা প্রস্তুতি নিলাম এবং ১৮ ডিসেম্বর কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্প গুটিয়ে একটি ট্রাক ভরে তাঁবু, তৈজসপত্র, কম্বল, মশারির স্ট্যান্ডসহ যাবতীয় দ্রব্যাদি নিয়ে পাবনা ফিরলাম। ওইসব দ্রব্যাদি পাবনা জেলা স্কুলের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রফিকুল ইসলাম বকুল এবং মোহাম্মদ ইকবালের কাছে হস্তান্তর করি। পরে সেগুলো পাবনা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের (বর্তমান ক্যাডেট কলেজ) ভারতীয় সেনাদের ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হয়। লেখক : কমিশনার বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন, ঢাকা অনুলিখন : হাবিবুর রহমান স্বপন
×