ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিজয়ের ৪৪ বছর ॥ এগিয়েছি অনেক

প্রকাশিত: ০৬:১২, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫

বিজয়ের ৪৪ বছর ॥ এগিয়েছি অনেক

সময়টা একেবারে কম নয়; সাড়ে চার দশকের কাছাকাছি। আমরা বিজয়ের ৪৪ বছর পার করে ফেললাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই সময়কার সরকার (৭১-৭২) শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাই করেনি, সত্তর দশকের সূচনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। ফা’ল্যান্ড ও পারকিনসন নামক দুই বিদেশী অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশকে একটি ‘পরীক্ষা ক্ষেত্র’ (ঃবংঃ পধংব) হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাঁদের মূল্যায়ন অনুযায়ী বাংলাদেশের পরিস্থিতি এতই সঙ্গিন ছিল যে, এ দেশের উন্নয়ন হলে বুঝতে হবে পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশেরই উন্নয়ন সম্ভব। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়েছিল। ভাগ্যও আমাদের কিছুটা পক্ষে ছিল। একটি হলো, ১৯৭৪ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদনকারী আরব দেশগুলোয় শ্রমিক রফতানির সুযোগ এবং তার ফলে রেমিট্যান্স (ৎবসরঃধহপব) তথা প্রবাসী আয়ের সমাগম ঘটে। কালক্রমে এই প্রবাসী আয় আজ বার্ষিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আজ আমরা শত্রুর মুখে চুনকালি দিয়ে বিশ্ব অগ্রগতির মহাসড়কে। গোল্ডম্যান স্যাকসের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি আশু সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ১১টির মধ্যে রয়েছে। জেপি মরগ্যান এক কদম এগিয়ে বলছে, বাংলাদেশ অগ্রসর দেশগুলোর মধ্যে ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’। সিটি গ্রুপ যা বলছে তা আরও উৎসাহব্যঞ্জক; ‘বাংলাদেশ এখন থ্রিজি অর্থাৎ থ্রি গ্লোবাল গ্রোথ জেনারেটর গ্রুপে’। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, ‘লিঙ্গভিত্তিক আয় সমতায় দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ।’ বিশে^র ১৪৫টি দেশের মধ্যে নারী-পুরুষের আয় সমতায় বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪। এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ১০৮ আর পাকিস্তানের ১৪৪-এ। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি জনতা, ছাত্র, যুবকরা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে গিয়েছিল। বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়, এই স্বাধীনতার জন্যে অনেক সখিনা বিবির কপাল ভেঙ্গেছে। অনেক হরিদাসীর সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে। রক্তের আখরে লেখা আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু হিসাব মিলাতে আমরা অনেক সময় হোঁচট খাই। এখনও এদেশে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিরা সক্রিয়, বিত্ত-বৈভবে তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পৃথিবীর অনেক দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আছে, বর্ণবাদী দলও আছে। কিন্তু সেই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধিতা করেছে এমন কোন দল রাজনীতি করার সুযোগ পায় না। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। বাংলাদেশে আজ যাদের বয়স ২৫-এর নিচে তারাই পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি। তারাই দিন বদলের সংগ্রামের অগ্রসৈনিক। জিপি মরগ্যান থেকে শুরু করে সিটি ব্যাংক সমস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব অর্থনীতির মহাসড়কে। সাউথ ইস্ট এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ শীর্ষে। দেশের শ্রমজীবী মানুষের অবদানেই এই অর্জন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কম করে ৮০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা ছিল কৃষকের সন্তান। আজও অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামে এই কৃষকের সন্তানরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তারাই দেশের বাইরে গিয়ে দিনান্ত পরিশ্রম করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায়। তাদের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার। এদেশের শ্রমজীবী মানুষ কখনই অন্যায় নির্দেশ মানে না। অসাম্প্রদায়িক চেতনা মনে-প্রাণে ধারণ করে। পহেলা বোশেখে তাদের বাধা দিতে পারে না। সমগ্র দেশে এদিন মানুষ ঈদের আনন্দে মেতে ওঠে। বিজয় দিবসের দিনে মাদ্রাসার ছাত্ররা মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। এই দেশ অপার সম্ভাবনাময় এক দেশ- পুরনো ধ্যান-ধ্যারণার মানুষগুলো তা বিশ্বাস করে না। এই তো সেদিন ২০০৪ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্ক জাকারবার্গ আবিষ্কার করলেন ‘ফেসবুক’। মাত্র বারো বছরে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২৩ কোটির উপরে। বাংলাদেশে ১ কোটি ৮০ লাখের কাছাকাছি সংখ্যার মানুষ ‘ফেসবুক’ ব্যবহার করছেন। ব্যবহারকারী সংখ্যা হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৩৯তম। এই ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। আর এই বয়সের ছেলে-মেয়েদের আমরা বলি নতুন প্রজন্ম। এই নতুন গতবার যেই দলকে পছন্দ করেছে তারাই জয়লাভ করেছে। এই বয়সী গ্রুপের পরে আছে ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা। বাংলাদেশে গার্মেন্টসে কর্মরত মানুষদের অধিকাংশের বয়সও ২৫ থেকে ৩৫ বছর। অতএব, আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অংশ অর্জিত হয় এই বয়সী বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। অর্থাৎ নতুন প্রজন্ম এই দেশকে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আশঙ্কা প্রকাশ করছে আসছে দশকে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। এজন্য প্রত্যেক দেশকে এ খাতে অনেক বেশি দেশীয় বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছে। বিগত বছরে উন্নত দেশগুলো জৈব জ্বালানির ব্যবহার বাড়িয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে মারাত্মকভাবে। সবই নতুন প্রজন্মকে ভাবায়। সময়টা এখন চ্যালেঞ্জ ও অপরচুনিটির; প্রয়োগ ও বাস্তবায়নটাই বড় কথা। নতুন প্রজন্মের সদস্যরা আজ তাই এ ব্যাপারে বিস্তর গবেষণাও করছে। যে বিশ^ব্যাংক পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে তিন বছর ব্যবধানে বিশ^ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে দারুণ দারুণ মন্তব্য করছেন। গণবক্তৃতায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এখন চীনের সঙ্গে নেক টু নেক’ পাল্লা দিচ্ছে। ১০ বছর আগে এটি ছিল অচিন্তনীয়। ’ দুই. কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে (বঙ্গবন্ধুর ভাষায়) রাখতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশে সুশাসনের অভাব রয়েছে। বলা ভাল ‘সুরাজনীতি’র অভাব রয়েছে। কিন্তু বিএনপির মতো একটা বিরোধী দল থাকলে দেশে ‘সুরাজনীতি’ প্রতিষ্ঠিত হওয়া বেশ কঠিন। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিএনপি এখনও আন্তঃবিনাশের মহাযাত্রায় শামিল হয়েছে। সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায়ের পর বিএনপি মুখপাত্র বলেছেন, ‘সাকা চৌধুরীর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি কমিটমেন্ট ছিল।’ এসব কথাবার্তার মধ্য দিয়ে বিএনপির আত্মহনন মনস্কতা প্রকটভাবে ফুটে ওঠে। বিএনপির কমিটমেন্ট নিয়েও বাংলাদেশের মানুষ সন্দিহান হয়ে ওঠে। আমাদের সমাজের ভাল অংশ আওয়ামী লীগের সফলতার দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা দরকার এই জাতির ভাল অংশ খুবই নিষ্প্রভ, এরা দূর থেকে দেখতে ভালবাসে। প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে এদের নানান সংশয়। এ কারণে শত শত বছর এই জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধা ছিল। খুব আশ্চর্যের বিষয় এই জাতির শিক্ষিতের একটা বড় অংশ এখনও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জিয়াউর রহমানের তুলনা করেন। তাদের অনেকের উপলব্ধিতে বোধ হয় নেই বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ বহু আগে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতিতে পরিণত হতো। জাতীয় চার নেতা বেঁচে থাকলেও জাতির এই লেজে-গোবরে অবস্থা হতো না। কেননা বঙ্গবন্ধু এই জাতীয় চার নেতার ভেতরে নেতৃত্বের অভিস্রবণ ঘটাতে পেরেছিলেন। একথা কেউ স্বীকার করবেন, কেউ স্বীকার নাও করতে পারেনÑ এটাই সত্য। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই জাতির ভেতরে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন- ‘আশা ছেড়ে তবু আশা রেখে দাও’। আমাদের হতাশ হওয়ার কারণ আছে। কিন্তু এটা মেনে নিলেও আমরা যখন দেখি আধিপত্যের নানান আয়ুধ- সুযোগবঞ্চনা ও তাকে যৌক্তিক করে তোলার জন্য নানান অযুক্তির সমাহার- এগুলোর বিরুদ্ধে সমাজের অন্তরে বয়ে চলেছে একটা গণযুক্তির ধারা, তখন আশান্বিত না হয়ে পারা যায় না। বঞ্চনা, অবমাননা, অস্বাধীনতার মধ্যেও সমাজের ভেতর থেকে উঠে আসে একটা তার্কিক কণ্ঠস্বর- জীবনের একটা জীবন্ত ব্যাখ্যা, যাকে বলছি লোক প্রজ্ঞা। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×