ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জামায়াতী প্রতিষ্ঠান রক্ষার তদবিরে ক্ষমতাসীন নেতারা

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫

জামায়াতী প্রতিষ্ঠান  রক্ষার তদবিরে ক্ষমতাসীন নেতারা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ জামায়াতের আর্থিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সরকারী ঘোষণার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। দেশজুড়ে অসংখ্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শিক্ষা সেক্টরে জামায়াত বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুললেও এবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে স্বরাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পরই বিভিন্ন মহলে শুরু করেছে দৌড়ঝাঁপ। এদিকে পরিস্থিতি সামলাতে নিজেদের ‘জামায়াত-শিবিরপন্থী’ অপবাদ ঘোচাতে কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন তারা। ‘জামায়াতের প্রতিষ্ঠান নয়’ বলে প্রমাণ করতে প্রতিষ্ঠানে সরকার সমর্থক প্রভাবশালীদের যুক্ত করে তাদের দিয়ে শুরু করেছে তদ্বির। আওয়ামী লীগ নেতারাও অনেকে না বুঝে আবার কেউ সুবিধার বিনিময়ে জামায়াতী প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে তদ্বির শুরু করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংককে অর্থ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পাঠানোর পর গত এক সপ্তাহে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও তার অধীন দফতরগুলোতে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই হয় নিজেরা না হয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দিয়ে চলছে দৌড়ঝাঁপ। একই অবস্থা দেখা গেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও। রবিবার স্বরাষ্ট্র এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনেককে দেখা গেছে ‘ওই প্রতিষ্ঠান জামায়াত নয়’ বলে তদ্বির করতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসা লোকজনের কাছে ঘটনা জানতে চাইলেও সাংবাদিক পরিচয় পেলে কথা বলতে রাজি হননি। তবে মন্ত্রণালয়ে কর্মরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তদ্বির করতে আসা লোকজনের মধ্যে অধিকাংশই কোন না কোন জেলা বা উপজেলার স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা। তারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বোঝাতে চাইছেনÑ জামায়াত নিয়ন্ত্রিত যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তালিকাভুক্ত করেছে, তা ঠিক নয়। পত্র-পত্রিকায় যেসব নাম এসেছে তাতে ভুল আছে, এ প্রতিষ্ঠান আমাদেরÑ ইত্যাদি ইত্যাদি। গেল বৃহস্পতিবার জামায়াতের একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদ্বির করতে এসেছিলেন এক নেতা। প্রতিষ্ঠানটির নাম মানারাত ইউনিভার্সিটি। এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্ততা প্রকাশ্যে। বহুবার জামায়াত-শিবিরের কর্মসূচীতে দেখা গেছে এর কর্ণধারদের। এর চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির অন্যতম পরামর্শক সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান। অন্যতম সদস্য হিসেবে আছেন ইসলামী ব্যংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইবনেসিনা ফার্মসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামায়াত নেতা এ এন এম এ জাহের। এরপরও তার পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ধরনা দিচ্ছেন সরকার সমর্থক নেতারা। মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা হতাশা প্রকাশ বলে বলছিলেন, সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য আটঘাট বেঁধে মাঠে নামলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে জামায়াতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে চাইছেন। এটা কিভাবে সম্ভবÑ জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, মাঠপর্যায়ের কোন জামায়াতী প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার জন্য তার পরিচালনা পর্ষদে টাকার লোভ দেখিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতাকে যুক্ত করেছে। পরে জামায়াতীদের কথামতো প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হওয়া আওয়ামী লীগ নেতা মন্ত্রণালয়ে তদ্বির করতে আসেন। ফলে সরকার এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইলেও সবসময় তা পারে না। বিভিন্ন সময় নাশকতার সঙ্গে যুক্ত জামায়াতের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নিলে একই অবস্থা দেখা গেছে। সম্প্রতি সরকারের নির্দেশের পর এখন বিষয়টি বেশি দেখা যাচ্ছে। এদিকে একই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও তদ্বির চলছে। রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় দেখা হয় ওই প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডে ‘সদস্য’ হিসেবে যুক্ত করা এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে। আসার কারণ জানতে চাইলে অবশ্য তিনি এমনি এসেছেন বলে দাবি করেন। প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, দেখেন অনেকেইতো এভাবে যুক্ত আছেন তাদের ‘জামায়াতের’ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। সরকার যদি ব্যবস্থা নেয় তবে অবশ্যই আমরা সহযোগিতা করব বলে দাবি করলেও এই নেতা বলেন, আসলে এখনও তো বিষয়টি পরিষ্কার নয় ভাই। জানা গেছে, একই মালিকানায় মানারাত ইন্টারন্যশনাল স্কুল নিয়েও মন্ত্রণালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে শুরু হয়েছে দৌড়ঝাঁপ। হঠাৎ করে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গেও যোগাযোগ বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। এদিকে এখানেই শেষ নয়। রাজধানীতে অবস্থিত জামায়াতের আরেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ইসলামিক ইউনিভার্সিটির পক্ষেও চলছে তদ্বির। সেখানেও যুক্ত করা হয়েছে সরকারের আস্থাভাজন একাধিক ব্যক্তিকে। অথচ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হচ্ছেন একাত্তরের ঘাতক জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় নিজ নামে অনুমোদন নিয়েছিলেন এই জামায়াত নেতা। এখন তার পরিবারই এর মূল মালিক হিসেবে আছে। গেল ৬ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামী নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন আর্থিক, সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। আদালতে ‘ক্রিমিনাল দল’ হিসেবে জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের দাবির মধ্যে এ নির্দেশ আসে। এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও এ সংক্রান্ত একটি চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর পাঠানো হয়। এ চিঠির একটি অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের কাছেও পাঠানো হয়। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও তাদের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের খোঁজখবর নেয়া শুরু করে। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় আছে অসংখ্য জামায়াত নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম। এর বাইরে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, গণজাগরণ মঞ্চ, সেøাগান ৭১ প্রকাশ করে জামায়াতের প্রতিষ্ঠানের তালিকা। যেখানে আছে অনেক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কোচিং সেন্টার, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও প্রকাশনা সংস্থা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তে উঠে আসা জামায়াতের ১২৭ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে ২২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
×