ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

ছাত্রজীবনের অবসান (১৪ ডিসেম্বরের পর) এতে পরবর্তীকালে গ্রীস এবং তুরস্কও যোগ দেয়। ‘ডধৎংধি চধপঃ’ সম্পাদিত হওয়ার পর আদর্শগতভাবে পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। অনেকেই বলেন, এই বিভক্তির অবসান হয় ১৯৭৯ সালে যখন বার্লিন প্রাচীর ভেঙ্গে দিয়ে পশ্চিম এবং পূর্ব জার্মানি একত্রিত হয়। ১৯৫৫ সালের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল পাকিস্তানের সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক ঝড়। এ সম্বন্ধে কিছুটা আগেই বলেছি। ১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর দুর্বৃত্ত বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে ইতোমধ্যে প্রণীত সংবিধান কার্যকরী করার কাজটি পিছিয়ে দিলেন। লাট বাহাদুরের পদক্ষেপ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমার বিবরণ ইতোমধ্যেই কিছুটা দিয়েছি। ১৯৫৫ সালের ১০ মে সুপ্রীমকোর্টের সাংবিধানিক পরামর্শ অনুযায়ী ২১ জুন ৮০ সদস্যের একটি নতুন গণপরিষদ নির্বাচিত হলো। ৮ আগস্টে শুরু হলো এই গণপরিষদের অধিবেশন। ১১ আগস্টেই নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। তার মন্ত্রিসভায় ছিলেন তাকে নিয়ে ১৪ জন মন্ত্রী আর ৩ প্রতিমন্ত্রী। এতে মোট বাঙালী ছিলেন ৬ মন্ত্রী ও ২ প্রতিমন্ত্রী। মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় থাকে মাত্র ১৩ মাস, ১৯৫৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আগেই বলেছি, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী ১৯৫৪ সালেই সংবিধান রচনা সমাপ্ত করেছিলেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী শুধু একটি পরিবর্তনই আনলেন। ২৩ আগস্ট তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে এক প্রদেশ স্থাপনের উদ্দেশ্যে উত্থাপন করলেন একটি ইউনিট বিল এবং তা পাস হলো ৩০ সেপ্টেম্বর। ১৯৫৬ সালের ৮ জানুয়ারি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বিলটি গণপরিষদে পেশ করেন। আর তা পাস হলো ২৯ ফেব্রুয়ারি। এ সংবিধানই কার্যকরী হলো ২৩ মার্চে। নয় বছরে অবশেষে সংবিধান রচনা সম্পন্ন হলো। আমি জানি না আর কোন গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধান রচনায় এত সময় লেগেছে কি-না। অবশ্য প্রতিবেশী নেপাল এখন এ বিষয়ে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের শুরুতেই ১ জানুয়ারি হলো ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট টেস্ট খেলা। সে সময় টিকেটের হার ছিল ছাত্রদের জন্য মাত্র ৩ টাকা। আর ভাষ্যকারের পাশে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ১৫ টাকায় টিকেট পাওয়া যেত। ভারত-পাকিস্তানের খেলা স্বাভাবিকভাবে খুবই উত্তেজনাকর বিষয় ছিল এবং খেলাটি শেষ হয় অমীমাংসিতভাবে। খেলার চারটি দিনই আমি স্টেডিয়ামে কাটাই। মাসের শেষ দুইদিন হলো আন্তঃকলেজ ক্রীড়ানুষ্ঠান আর ফেব্রুয়ারির শুরুতে চলল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিকেট মেনিয়া। আমার মনে হয় এ বছর খেলার দিকে আমি বিশেষ নজর দিই। জানুয়ারি মাসে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল দুই বছরের বার্ষিক হল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। আমাদের পূর্ববর্তী হল ইউনিয়ন কমিটির নির্বাচন হয়েছিল ১৯৫৪ সালের ১৯ জানুয়ারি এবং তার ঠিক আগেই পূর্ববর্তী কমিটি বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান করে। তাই আমরা দুই কমিটি মিলে ১৪ জানুয়ারি হল ইউনিয়নের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান করি। আমরা এই অনুষ্ঠানে দু’টি রেকর্ড স্থাপন করি। প্রথমটি হলো ঢাকায় এই প্রথমবারের মতো অলিম্পিক টর্চ একদল রানার মাঠে নিয়ে এসে স্থাপন করেন। দ্বিতীয়টি হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র কাজী আবদুল আলিম একটানা ছয় বছর এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হলেন। কাজী আবদুল আলিমের অসাধারণ এই কৃতিত্ব অনেক উদীয়মান ক্রীড়াবিদের অসুবিধার কারণ হয়। সেজন্য পরবর্তী বছরে ঠিক হলো প্রতি ক্রীড়াবিদের জন্য সর্বোচ্চ কতটি প্রতিযোগিতায় তিনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন তা নির্ধারণ করে দেয়া হবে। বছরের শেষ দিকে নবেম্বরে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের আয়োজনে ডেকাথলন চ্যাম্পিয়ন বব মেথায়াস ঢাকা বেড়াতে আসেন। মার্কিন তথ্যকেন্দ্র এজন্য আমার সহায়তা কামনা করে এবং বব মেথায়াসের কার্যক্রম প্রণয়ন ও নিশ্চিত করতে আমাকে আবার কিছু সময় ব্যয় করতে হয়। আমি এবার বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানে হাই হার্ডল দৌড়ে একটি পুরস্কার পাই। সব বছরই নানা দৌড়ে, এমনকি লম্ফঝম্পতেও আমি প্রতিযোগিতা করতাম; কিন্তু শেষ বছরে একটি চমৎকার পুরস্কার পেলাম। কাজী আবদুল আলিমই আমার জন্য এই সুযোগটি করে দেন। তিনি বেশ কিছুদিন আগে আমাকে বললেন, ঐ বছরে এই দৌড়ে তিনি অংশ নেবেন না এবং তার ধারণা একটু অনুশীলন করলে এই দৌড়ে আমি সফল হব। আলিম ভাই বললেন, ‘আপনি তো দৌড়ের চেয়ে বেশি লাফালাফি করেন। আমি আপনাকে হাই হার্ডল এবং লো-হার্ডল দৌড়ে প্রশিক্ষণ দেব।’ তার মাত্র কয়েকদিনের প্রশিক্ষণেই আমি এক্ষেত্রে বেশ দক্ষতা আহরণ করি। কলেজ জীবন থেকেই আমার আসল খেলা ছিল টেনিস এবং আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে লন টেনিসই খেলতাম। এসব টেনিস মাঠ পাকা হতে শুরু করে বেশ পরে। সম্ভবত ১৯৫৯ অথবা ১৯৬০ সালে। ১৯৫৪ সালে সলিমুল্লাহ হলে আমার পার্টনার শাহ মনওয়ারুল ইসলাম চ্যাম্পিয়ন আর আমি হই রানার-আপ। দ্বৈত খেলায় আমাদের জুটি হয় চ্যাম্পিয়ন। ১৯৫৫ সালেও আমাদের জুটি আবার চ্যাম্পিয়ন এবং মনওয়ার একক খেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়। আমি কিন্তু একক খেলায় কিছুই করতে পারলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক বছর ফারুক চৌধুরী এবং আমি পার্টনার হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হই। আমরা সেবার মনওয়ার এবং তার পার্টনার কবীরকে পরাজিত করি। আমাদের খেলা দেখতে গুরুজনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য ড. ওয়ালটার জেনকিন্স এবং প্রভোস্ট ড. ওসমান গনি। মনওয়ার কয়েক বছরই চ্যাম্পিয়ন ছিল। তার বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর এই গৌরবের অধিকারী হলেন আসাদুজ্জামান খসরু এবং তিনি বেশ কয়েক বছর তার কৃতিত্বের নিদর্শন দিয়েই চলেন। শরত থেকে বসন্তকাল, বাস্তবে অক্টোবর থেকে শুরু করে এপ্রিলের শুরু পর্যন্ত ছিল শুষ্ক মৌসুম। এই মৌসুমে খেলাধুলার মধ্যে জনপ্রিয় ছিলÑ ভলিবল, বাস্কেট বল, টেনিস এবং ফিল্ড ও ট্র্যাক খেলা। আমি প্রায়ই বেলা দুই বা আড়াইটার মধ্যে মাঠে চলে যেতাম। সেখানে আমার প্রধান আকর্ষণ ছিল টেনিস। যদিও আরও কয়েকটি খেলা আমি প্রায়ই খেলতাম। আমার হল জীবনে টেনিস, ভলিবল আর হকি- এই তিনটি খেলায়ই এক বছর করে ক্যাপ্টেন ছিলাম। টেনিস আর ভলিবলে এই সুযোগ আমি পাই যোগ্যতার কারণে। আর হকিতে শুধু শূন্যস্থান পূরণের জন্য। হকি আমি তেমন খেলতাম না; কিন্তু দায়ে পড়ে সেখানে গোলরক্ষক বনে গেলাম। এদিকে ২১ ফেব্রুয়ারি আগত। আমরা সেজন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাদের কার্যক্রম ছিল গতানুগতিক। অর্থাৎ খালি পায়ে গোরস্তানে যাওয়া, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সভা-সমিতি করা ইত্যাদি। এবারে কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ সম্বন্ধে কোন আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হলো না। আমরা ভাবলাম, এটা গত বছরের মতোই অনুষ্ঠিত হবে। সে সময় পূর্ব বাংলার অস্থায়ী গবর্নর ছিলেন বিচারপতি এম শাহাবুদ্দিন (২২ ডিসেম্বর ১৯৫৪ থেকে ১৪ জুন ১৯৫৫ সাল)। কিন্তু পূর্ব বাংলায় ক্ষমতার চাবিকাঠি নিয়ন্ত্রণ করত জঙ্গী ও দেশশত্রু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল ইসকান্দার মীর্জা। তার হুকুমে পূর্ব বাংলা সরকার সিদ্ধান্ত নিল যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনটিকে দমিয়ে রাখতে হবে। এই উদ্যোগের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ১২ ফেব্রুয়ারি ভোর বেলা আমরা ৭ ছাত্রনেতা ও সংশ্লিষ্ট ২Ñ১ জনকে গ্রেফতার করা হলো। ভোর রাতে আমাদের ৬ জনকে বিভিন্ন হল থেকে ধরে নিয়ে লালবাগ থানায় রাখা হলো। চলবে...
×