ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৌঃ আঃ মঃ শারফুজ্জামান

৪০ বছরেও যে জাতীয় পুরস্কার দেয়া হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫

৪০ বছরেও যে জাতীয় পুরস্কার দেয়া হয়নি

স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৫-এর ২৫ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের ১৮ জন এবং ভারতীয় ৪ জন বিশিষ্ট শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী ও বেতারকর্মীর নামে বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা বেতার, টিভি এবং সংবাদপত্রে গুরুত্ব সহকারে প্রচার এবং প্রকাশ করা হয়। ভারতীয় ৪ জনকে এই পদক হাইকমিশনের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ১৮ জন এ পদক আজ পর্যন্ত পাননি। কেন পাননি সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে ৭৫-এর ২৫ মার্চের তথ্য বিবরণী নং ১০০০৮-এর কিছু অংশে চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। ২৫ মার্চ প্রকাশিত ওই তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে চূড়ান্ত বিজয়ে উত্তীর্ণ করার জন্য বেতার মাধ্যমে সে সব শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী ও বেতারকর্মী তাদের সৃষ্টি বা তৎপরতা দ্বারা অসামান্য অবদান রেখেছেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান তাদের বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক প্রদান করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৮ জন বিশিষ্ট শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী ও বেতার কর্মীসহ মোট ২২ জনকে বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক দেয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে।’ তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী, জাতীয় সংসদ সদস্য উপরন্তু কর্মকর্তা সমন্বয়ে গঠিত ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি এদের নির্বাচন করে। পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত শিল্পীরা হলেন বাংলাদেশের সর্বজনাব মরহুম রাজু আহমেদ, মরহুম আলতাফ মাহমুদ, মরহুম সর্দার আলাউদ্দিন, বেলাল মাহমুদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, আব্দুল্লাহ আল-ফারুক, মোস্তফা আনোয়ার, রেজাউল করিম চৌধুরী, রাশিদুল হোসেন, আমিনুর রহমান, কাজী হবিব উদ্দিন, আঃ মঃ শারফুজ্জামান, সৈয়দ আব্দুর শাকের, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, এমআর আকতার মুকুল, আপেল মাহমুদ, শ্রী রথীন্দ্রনাথ রায় ও শ্রী সমর দাস। ভারতের শ্রী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রী গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্রী প্রণবেশ সেন ও শ্রী অংশুমান রায়। নির্বাচিত শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী ও বেতারকর্মীরা সবাই বেতার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এদের ভূমিকা দেশবাসীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনুপ্রাণিত করে। চট্টগ্রামের কালুরঘাটের ১০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার থেকে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল ‘৭১-এর ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭-৪০ মিনিটে। এই অনুষ্ঠান প্রচারে যে ১০ বেতারকর্মীর অবদান ছিল অসামান্য তাঁরা হলেন সৈয়দ আবদুশ শাকের, বেলাল মাহমুদ, মোস্তফা আনোয়ার, মোঃ রাসেলদুল হোসেন, আমিনুর রহমান, রেজাউল করিম চৌধুরী, আঃ মঃ শারফুজ্জামান, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ ও আব্দুল্লাহ আল-ফারুক। ৩১ মার্চ ১০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারটি ডিসমেন্টাল করে ট্রাকে পটিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। ট্রান্সমিটারটি পটিয়ায় রেখে উপরোক্ত ১০ জন ইন্সটল করার স্থান নির্বাচনের জন্য রামগড় সীমান্তে চলে যান ৩ এপ্রিল এবং ঐ দিনই তারা চলে যান আগরতলা। আর ভারতীয় সরকারের দেয়া প্রথমে ২০০ ও পরে ৪০০ ওয়াট ক্ষুদ্র তরঙ্গ শক্তির ট্রান্সমিটার থেকেও এ দিনই (৩ এপ্রিল, ১৯৭১) অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। এই অনুষ্ঠান শুরু হবার পরে অনেক নিবেদিতপ্রাণ সংস্কৃতি কর্মী একে একে যোগ দেন। তাদের মধ্যে আলতাফ মাহমুদ, রাজু আহমেদ, সর্দার আলাউদ্দিন, আপেল মাহমুদ, সমর দাস, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, শ্রী রথীন্দ্রনাথ রায় এবং ভারতের শ্রী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রী গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার, শ্রী প্রণবেশ সেন ও অংশুমান রায়। সে সময় সৈয়দ আবদুশ শাকের ছিলেন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের বেতার প্রকৌশলী। মোস্তফা আনোয়ার ছিলেন অনুষ্ঠান প্রযোজক (পিপি)। কবি বেলাল মুহাম্মদ চট্টগ্রাম বেতারের নিজস্ব পা-ুলিপি রচয়িতা। আবুল কাসেম সন্দ্বীপ অধ্যাপনা করতেন। প্রয়াত কাজী হাবিবউদ্দিন (মনি) ব্যবসা করতেন। আমিনুর রহমান, মোঃ রাশিদুল হোসেন ছিলেন বেতারের টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট (টিএ)। আঃ মঃ শারফুজ্জামান (লেখক) ও রেজাউল করিম চৌধুরী ছিলেন বেতারের টেকনিক্যাল অপারেটর (টিও)। আলতাফ মাহমুদ সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। রাজু আহমেদ ছিলেন ‘জল্লাদের দরবার’-এর শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। সর্দার আলাউদ্দিন আহমেদ ছিলেন লোকসঙ্গীত শিল্পী। গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি রচনার প্রেক্ষিতে পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। এম আর আকতার মুকুল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত জনপ্রিয় কথিকা চরম পত্রের লেখক ও পাঠক। কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদের গাওয়া ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি ও তীর হারা এ ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব’ গান তিনটি বাঙালী জাতিকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করে। সুরকার সমর দাস ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল; আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব গানের সুর দিয়েছেন। রথীন্দ্রনাথ রায় লোকসঙ্গীত শিল্পী। ভারতের দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আকাশবাণীর কথক। ‘শোনো একটি মজিবরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি’ গানটির গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। শ্রী দেবদুলালের কণ্ঠে আকাশবাণী থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে যে সব উদ্দীপনাময় কথিকা প্রচারিত হতো সেগুলোর রচয়িতা শ্রী প্রণবেশ সেন। কণ্ঠশিল্পী অংশুমান রায়ের গাওয়া ‘শোনো একটি মুজিবের কণ্ঠ থেকে’ গানটি তখন অপূর্ব আবেদন সৃষ্টি করেছিল। বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক কেন দেয়া হয়নি? এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা মন্ত্রণালয়ে কোন চিঠি বা লিখিত কিছু পাওয়া গেছে কিনা, আর পাওয়া গেলে তার কারণই বা কি এ সম্পর্কে সবার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়েছিল। প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়ে মোঃ রাশিদুল হোসেনের মতো সবাই বলেছেন, কোন কর্মকর্তা বা মন্ত্রণালয় থেকে আজ পর্যন্ত কেউ কোন চিঠিপত্র পাননি এবং এ সম্পর্কে তাদের কোন প্রতিক্রিয়াও নেই। জনাব হোসেনের কথা, স্বাধীনতা যেখানে পেয়েছি সেখানে স্বর্ণপদক পাওয়া না পাওয়াটা গৌণ। বেলাল মোহাম্মদের প্রতিক্রিয়া : ব্যক্তিগতভাবে আমি এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়ার ব্যাপারে উৎসাহবোধ করিনি। এর জন্য আমার মধ্যে কোনরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। রথীন্দ্রনাথ রায় মনে করেন, বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক প্রাপ্তির সংবাদ খাঁটি ধাতব বস্তু স্বর্ণের চেয়েও অনেক মূল্যবান। এমআর আকতার মুকুল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে আজও পর্যন্ত কোন চিঠি পাননি। তার বক্তব্য : বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই স্বর্ণপদক না পাওয়ার ব্যাপারে আমার মনে কোন প্রশ্নই উত্থাপিত হয়নি। কেন না আজ ৩১ বছর ধরে তো আমাদের সমাজে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানকেই বিতর্কিত রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আপেল মাহমুদ ও মোস্তফা আনোয়ারের কণ্ঠেও একই প্রতিধ্বনি : যখন বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন তখন বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক প্রাপ্তি আকাশকুসুম বৈকি! মোস্তফা আনোয়ারের প্রতিক্রিয়া : যদি আমাকে পদক দিতে হয় তবে আমি বঙ্গবন্ধু পদক ছাড়া অন্য পদক নেব না। এ প্রেক্ষিতে আপেল মাহমুদ কিছু একটা উদ্ঘাটন করে বলেন, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তারাই দেশের হাল ধরে বসেছিল। ওরা বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদককে স্বাধীনতা পদকে রূপান্তরিত করল। সুতরাং যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল তারা আবার বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক দেয় কি করে। এ পদক কেন দেয়া হয়নি তা অনেকের মতো আব্দুর শাকেরের কাছেও তা দুর্জ্ঞেয় রহস্য। তবে এতটুকু জানি যে, এই পদকগুলো তৈরি হয়েছে কেবিনেট ডিভিশনের তত্ত্বাবধানে এবং সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল প্রদান করার জন্য। কাজী হাবিবউদ্দিন মনি এ প্রশ্ন সরকারকেই জিজ্ঞেস করতে বলেছেন। এ প্রশ্নে রেজাউল করিম চৌধুরীর মন্তব্য : এ সম্বন্ধে ভারতে গেলে খারাপ লাগে, লজ্জাবোধ হয়। সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি করুণা হয়। আবুল কাসেম সন্দ্বীপ জানিয়েছিলেন কিছু ভিন্ন তথ্য : আমি রাষ্ট্রপতি জিয়াকে ঘোষিত পুরস্কারগুলো বিতরণ করা উচিত বলে লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম। সরকারের পক্ষ থেকে আমার বক্তব্য সত্য কি-না এবং বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদকপ্রাপ্তদের তালিকায় আমার নাম আছে কিনা এটি সরকারীভাবে জানতে চাওয়া হয়েছিল এবং সমবায় সমিতিসমূহের তৎকালীন নিবন্ধক সাহেব সরকারকে এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য জানিয়েছিলেন। এ বিষয়ে আমি বাংলাদেশ সরকারের কোন কোন বিশেষ সচিব ও যুগ্ম সচিবের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। এদের অনেকে আমাকে বলেছিলেন, সরকার যখন একবার ঘোষণা করেই ফেলেছেন এই স্বীকৃতি ও পুরস্কার আপনারা অবশ্যই পাবেন। এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ প্রশ্নে আমিনুর রহমান দিয়েছেন আর একটি তথ্য : ৭৮-এ আমি তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরীকে অবহিত করেছিলাম। কিন্তু উত্তর পাওয়া যায়নি। এ পদক বিতরণ না হওয়া সম্পর্কে জনাব রহমানের প্রতিক্রিয়া জাতীয় বীরদের সম্মান করা বা দেয়া সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। হয়ত একদিন এ পুরস্কার পাব এই আশা রাখি। জাতি আমাদের অবদানের মূল্যায়ন করবে। লেখক : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা
×